চেনা বামুনের গলায় ‘রঙিন পৈতা’ পরাল কারা?
বিমল সরকার
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যেখানে ‘পৈতা’ লাগানোরই দরকার ছিল না বা নেই, সেখানে তা লাগানো হলো, তা-ও আবার ‘রঙিন পৈতা’! এর কি আদৌ কোনো দরকার ছিল? এতে কি সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠানের মান-মর্যাদা কিংবা শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে? বেড়ে থাকলে তা কতটুকু? যে প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর, এমনকি দশকের পর দশক কেবল ‘স্কুল’ বা ‘কলেজ’ নামে পরিচিত ছিল, সময়-পরিক্রমায় তা হয়ে গেল ‘পাইলট স্কুল’, ‘মডেল স্কুল’ কিংবা পাইলট ও মডেল দুটোই। আর কলেজের ক্ষেত্রে ‘ডিগ্রি কলেজ’, ‘অনার্স কলেজ’, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’। স্কুলের নামের সঙ্গে পাইলট বা মডেল যুক্ত করাটা বোধকরি সরকারি কোনো স্কিম বা প্রজেক্টের ব্যাপার। এলাকায় যাতায়াত করার সময় বয়স্করা যার যার প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির মূল ফটকের দিকে তাকালে এমনটা লক্ষ করে থাকবেন। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে নাম ছিল ‘উচ্চবিদ্যালয়’। স্কিম বা প্রজেক্টের আওতাধীন এমন অনেক বিদ্যালয়ের নাম বদলে হয় প্রথমে ‘পাইলট’ ও পরে ‘পাইলট মডেল’ উচ্চবিদ্যালয়। অনেক খবরই আমরা রাখি না, ইদানীং ‘উচ্চবিদ্যালয়’ নামের অনেক প্রতিষ্ঠানই সরকারি হয়েছে। বিদ্যালয়ের নাম ‘সম্প্রসারণ’ করার দেশব্যাপী এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যেমন ‘সরকারি পাইলট মডেল’। কলেজের ক্ষেত্রেও একই রকম। ১৯৭৫-১৯৭৬ শিক্ষাবর্ষে আমি যথাক্রমে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ও নেত্রকোনা কলেজে পড়াশোনা করি। আর ১৯৭৭-১৯৭৮ শিক্ষাবর্ষে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে। ১৯৮৪ সালে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করি নিজ জেলার (কিশোরগঞ্জ) বাজিতপুর কলেজে। আমার প্রিয় তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই খুব সাদামাটা নাম এবং এভাবেই আমরা দশকের পর দশক ধরে চিনে আসি। অথচ তিনটিই ‘পূর্ণাঙ্গ’ (ডিগ্রি স্তরে বিএ, বিএসএস, বিএসসি ও বিবিএস কোর্স) কলেজ বলে পরিচিত। অন্য তিনটি দেরিতে হলেও ঐতিহ্যবাহী আনন্দ মোহন কলেজ সরকারি হয় সেই ষাটের দশকের প্রথমার্ধে। তাছাড়া একই সময় অনার্স ও স্বাধীনতার অব্যবহিত পর মাস্টার্সও চালু হয় দেশপ্রসিদ্ধ এ কলেজটিতে। কিন্তু নামের সঙ্গে কোনো ‘মেদ’ যুক্ত করা হয়নি কখনো। তবে ইদানীং আর কারও যেন তর সয় না। ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় নতুন পরিচয়ে ডাকাডাকি ও লেখালেখি : সরকারি কলেজ, অনার্স কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ...।
কেবল উল্লিখিত তিন-চারটি প্রতিষ্ঠানই নয়, খ্যাতনামা এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে দীর্ঘদিনে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও যেগুলোর নামের কোনো এদিক-সেদিক করা হয়নি। ঢাকা কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, করটিয়া সা’দত কলেজ, ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমুদিনী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, রাজশাহী কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ-রয়েছে এমন অসংখ্য নাম। উল্লিখিত বিখ্যাত সব কলেজের মূল ফটকের লেখাগুলো লক্ষ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও হালজমানার শিক্ষকরা কি এমন ‘সাদামাটা’ পরিচয়ে তুষ্ট থাকতে পারেন?
দেশের প্রথম সরকারি কলেজ হলো ঢাকা কলেজ (১৮৪১)। কালক্রমে ডিগ্রি পাশ, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদানকারী ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অনেক খ্যাতি রয়েছে। এমনই চট্টগ্রাম কলেজ (১৮৫৭) এবং রাজশাহী কলেজেরও (১৮৭৩)। লিখতে এবং বলতে গিয়ে পরিচয় যেভাবেই দেওয়া হোক, শিক্ষার্থী শিক্ষক ও অভিভাবকরা কি খেয়াল করে দেখেছেন এসব প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকের মধ্যস্থিত নামটি কীভাবে লেখা রয়েছে?
আমাদের সময় (১৯৭৭-১৯৭৮) বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুল ও শেরপুর জেলা) সরকারি কলেজ ছিল একটি-ই-আনন্দ মোহন কলেজ। ডিগ্রি পাশ কোর্সের পাশাপাশি ছিল ৮টি বিষয়ে অনার্স ও ৩টি বিষয়ে মাস্টার্স পড়া ও পড়ানোর ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত। কত দূর-দূরান্ত বা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে একেকজন শিক্ষার্থীর আগমন। কিন্তু না, খাতাপত্রে কিংবা কোনো নথিপত্রে ‘ডিগ্রি কলেজ’, ‘অনার্স কলেজ’ ও ‘মাস্টার্স কলেজ’ তো দূরের কথা, এমনকি ‘সরকারি কলেজ’ বলতে, লিখতে বা পরিচয় দিতেও কাউকে বলতে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। এএম কলেজ বা আনন্দ মোহন কলেজ-এটিই ছিল গর্বের এবং সত্যিকারের পরিচয়। ১৯৮১ সালে ‘আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ’ লেখা শিরোনামে আমার নামে ইস্যু করা অনার্স পাশের প্রশংসাপত্রে (যা আজও আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে) স্বাক্ষর করা অধ্যক্ষের সিলমোহরেও কেবল ‘আনন্দ মোহন কলেজ’-ই উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষকদের সত্যায়িত করা কোনো কিছুতে ব্যবহৃত সিলেও আমরা ‘সরকারি’ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে, এমনটি লক্ষ করা যায়নি। আজকাল যথারীতি স্বাক্ষর ও সিল দেওয়া থাকলেও ‘সরকারি’ শব্দবর্জিত কোনো সার্টিফিকেট কি কোথাও অ্যালাও করা হবে? সে সময় বিভাগে থাকলেও অনেক শিক্ষক বাসাবাড়িতে বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে কোনো সিলই রাখতেন না। একবার কী একটা কাজে ছবি সত্যায়নের দরকার হলো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান শ্রদ্ধেয় শামসুল হকের বাসায় গেলাম। ব্যবহৃত সিলটিতে লক্ষ করলাম লেখা রয়েছে কেবল আনন্দ মোহন কলেজ, ‘সরকারি’ শব্দটিই এখানে অনুপস্থিত।
আর সে তুলনায় হালজমানায়? ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বারণ থাকা সত্ত্বেও ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’, ‘অনার্স কলেজ’, এমনকি ‘ডিগ্রি কলেজ’ লেখা ও বলায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কোনো থামাথামি আছে? এভাবেই আজকাল দেশজুড়ে নামের সঙ্গে বাড়তি বিশেষণযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি। স্বাধীনতার পর সরকারিকরণ হয়েছে এমন একটি কলেজের শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি ‘সরকারি’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। আগে-পরে যখনই হোক, কলেজ যেখানে সরকারি, সে হিসাবে ‘সরকারি’ তারা লিখতেই পারেন। তবে বারণ করা সত্ত্বেও নামের সঙ্গে অযথাই বাড়তি ‘মেদ’ লাগানোর হেতু কী? গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, গোলাপ গোলাপই। স্বভাব-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সুগন্ধ সে ছড়াবেই। শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রশাসন, এমনকি যার যার কর্মকাণ্ড নিয়ে শিক্ষকরাও আজ মোটা দাগে প্রশ্নের সম্মুখীন। সবচেয়ে হতাশার কথা হলো, এসব নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ-প্রচেষ্টা খুব একটা নজরে পড়ে না। আমরা সবাই যেন স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে চলেছি। কেবল বাগাড়ম্বরই সার।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক