নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
আমানতকারীদের শনির দশা কবে কাটবে?
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমানতকারীদের ঠকিয়ে ব্যাংক মালিকরা যে আনন্দ পান তা বোঝা যায়। তারা তাদের বশংবদ নির্বাহীদের দিয়ে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ আদায় করেন ভালোই। কিন্তু তার সুবিধা আমানতকারীদের মালিকরা দেন না। এই এক অবিচার চলছে দীর্ঘদিন ধরে। অনেক অভিযোগ, আপত্তি, লেখালেখি হয়েছে; কিন্তু ‘ত্রাণকর্তা’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো কিছু করেনি। ফলে অবিচারটি বহু পুরোনো হয়েছে। আগে তো সুদ সব নির্ধারণ করে দেওয়া হতো। এবং তা করত বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ১৯৯০-এর দশকে সুদ নির্ধারণের দায়িত্ব স্ব স্ব ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। বলা হয় বাজারের কথা, ‘মার্কেটের’ কথা। বাজার অর্থনীতির অধীনে সুদের হার নির্ধারিত হবে। আমানত ও ঋণ-উভয়ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে।
শুরু হলো সেই প্রথা। বাজার অর্থনীতির কথা বলা হলো ঠিকই, এর ফল আমানতকারীরা কিন্তু সেভাবে পেল না। মালিকরা তাদের স্বার্থ ঠিকই রক্ষা করল নানাভাবে। আমানতকারীদের ঠকালো। ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ ভালো মতোই আদায় করল। সেই সুবিধা তারা কাজে লাগাল ভিন্ন এক খাতে। খারাপ ঋণের বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখতে হয় মুনাফার টাকা থেকে। তারা আমানতকারীদের ঠকালো, ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ভালো সুদ আদায় করল। সেই টাকা দিয়ে তারা তাদেরই সৃষ্ট খেলাপি ঋণের (ক্লাসিফায়েড লোন) বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখল। বড় মজার ব্যবসা, যে কারণে সবাই ব্যাংকের মালিক হতে চায়। লাভেই লাভ। ৪০০-৫০০ কোটি টাকা পুঁজি দরকার হলেও ব্যাংক মালিক হওয়ার মতো লোকের অভাব হয় না। এমনকি প্রবাসী একশ্রেণির বাংলাদেশি ধনকুবেরও ব্যাংকের মালিক বনে গেল। ব্যাংক বানিয়ে অনেকে লুট করে দেশত্যাগ করেছেন। তাদের ‘বোর্ড মিটিং’য়ে মাথাপিছু লাগত-ডিনার খরচেই হাজার হাজার টাকা। এসব খবর আমরা কাগজে পড়ি আর অবাক হই, বিস্মিত হই। বিস্মিত হই বাঙালির ‘উন্নতি’ দেখে। এরই মধ্যে চলছে ব্যাংক ব্যবসা। শুধু ‘সুদ’ নয়, ব্যাংক মালিকরা ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে নানাভাবে নানা ধরনের চার্জ আদায়ও শুরু করেন।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখে প্রকাশিত যুগান্তরের একটি খবরের শিরোনাম ছিল : ‘সিঙ্গেল ডিজিটে শুভঙ্করের ফাঁকি : ব্যাংক ঋণের বিপরীতে ৪৪ ধরনের চার্জ’। এই ৪৪ ধরনের ‘চার্জের’ মধ্যে একমাত্র শুধু আমদানি-রপ্তানিতেই কাটা হচ্ছে ২৯ ধরনের ‘চার্জ’ বা ‘কমিশন’। এছাড়া দেশীয় পর্যায়ে ঋণের ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ ধরনের মাশুল গুনতে হয় ঋণগ্রহীতাকে। এ ঘটনা কখনকার? সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একজন খুবই বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু তিনি অর্থমন্ত্রী হিসাবে কতটা সফল ছিলেন, সেটা একটা প্রশ্ন। তিনি আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী নীতি করলেন-‘নয়-ছয়’। আমানতকারীদের আমানতের ওপর সুদ দেওয়া হবে ৬ শতাংশ হারে, আর এর বিপরীতে ঋণ দেওয়া হবে ৯ শতাংশ হারে। ব্যাংকের ‘মার্জিন/স্প্রেড’ থাকবে ৩ শতাংশ। অথচ বাজারে তখন মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের অনেক উপরে। এবং এ ঘটনাটি তিনি করলেন একটি হোটেলে এক মিটিংয়ে বসে। যা করার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, তা করলেন অর্থমন্ত্রী। ‘নয়-ছয়’ সুদনীতির কারণে সঞ্চয় নিরৎসাহিত হলো। আমানতের বাজার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলো। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের বাজারও তছনছ করা হলো। সেই থেকে আমানতের বাজার এখনো টালমাটাল। মূল্যস্ফীতি, মানুষের জীবনধারণের ব্যয়ভার ইত্যাদি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এই যে ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি, তা কিন্তু বাজার অর্থনীতি বা ‘মার্কেট ইকোনমি’র বিরুদ্ধ ধারণা। অথচ সরকারের ঘোষিত ও অনুসৃত নীতি হচ্ছে বাজার অর্থনীতি। বাজার অর্থনীতির নীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে হলো বিপদ। বিপদে পড়ে গেলাম আমরা ‘ত্রাণকর্তা’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে। তারা ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসাবে বলল, সুদ ধার্য হবে বাজারে। চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে। আর তাই ৪৭০ বিলিয়ন ডলারের একটা অর্থনীতিকে মাত্র ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য কঠিন কঠিন বদহজমি সব শর্ত মানতে হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পাগলপ্রায় ওইসব শর্ত পালন করতে গিয়ে। অথচ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সামনে। এ এক যুদ্ধ। স্ববিরোধী সব টার্গেট আইএমএফের। বাকিতে খেলে যেমন দোকানিদের কথামতো পণ্য কিনতে হয়, তেমনি হয়েছে আমাদের অবস্থা। নড়াচড়ার জায়গা নেই!
এরই মধ্যে চালু হয়েছে নতুন সুদনীতি। আমানত ও ঋণের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েও ‘কারিগরি’ করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিল। তা বোধহয় সম্ভব হয়নি। এখন সুদের বাজারে চলছে নৈরাজ্য। ব্যাংক মালিকদের অবিচার। তারা আমানতের ওপর সুদ দিচ্ছে কম। ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ আদায় করছে বেশি ঠিকই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণের ওপর সুদের হার মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। এই হারে সুদ দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। অথচ দুঃখের কথা, সেই সুবিধার ছটাকও আমানতকারীদের দিচ্ছে না ব্যাংক। এর উদাহরণ হচ্ছে সর্বশেষ তথ্য/পরিসংখ্যান। চলতি মাসের ৬ তারিখের একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আমানতের ওপর গড় সুদের হার ছিল ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর বিপরীতে ঋণের ওপর গড় সুদের হার ছিল ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকের হাতে ‘স্প্রেড’ ছিল ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কী অবস্থা ছিল? অর্থাৎ ৮ মাস পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক খাতে আমানতের ওপর গড় সুদের হার ছিল ৫ দশমিক ০১ শতাংশ। বিপরীতে ঋণের ওপর গড় সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। এসব তথ্য আব্দুর রউফ তালুকদার সাহেবের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাতে কী দেখা যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে ‘স্প্রেড’ সর্বশেষ হচ্ছে ৫ দশমিক ০৪ শতাংশ। অর্থাৎ ৮ মাসে আমানতের ওপর সুদের হার বেড়েছে সামান্য। বেড়েছে অনেক বেশি ঋণের ওপর সুদের। ফলে ‘স্প্রেড’ বেড়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য হারে।
এর অর্থ কী? অর্থ হচ্ছে, ব্যাংক মালিকরা ঋণের ওপর সুদ চার্জ করছেন বেশি বেশি, বিপরীতে আমানতকারীদের ঠকাচ্ছেন কম সুদ দিয়ে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি যেমন ছিল সঞ্চয় নিরুৎসাহী নীতি, তেমনি বর্তমান অবস্থাও অবিচারমূলক। মুক্তি নেই আমানতকারীদের, সঞ্চয়কারীদের। এ কারণেই প্রশ্ন জাগে, এটাই কি বাজার অর্থনীতির নীতি? সঞ্চয়ের কী দরকার, খাও দাও ফুর্তি করো! পয়সা কোথায়? পয়সা দেবে ব্যাংক। অবশ্যই ঋণ হিসাবে। ক্রেডিট কার্ড আছে। ‘ক্যাশলেস’ ইকোনমি হবে। ‘নো ক্যাশ’, ক্রেডিট অ্যান্ড ক্রেডিট! আমানতের দরকার নেই, সঞ্চয়পত্রের দরকার নেই! সঞ্চয়ের দরকার নেই!
এই যে নীতি, এর পরিণতি কী? শুনেছি আমেরিকার মতো দেশে নাকি মৃত্যুর পর কফিন/কবরের টাকাও লোকেরা ঋণ করে জোগাড় করে রেখে যায়। জন্ম থেকে মৃত্যু-বাড়ি-ঘর, ফ্ল্যাট, জমি, গাড়ি, এমন আরাম-আয়েশ-সবই ঋণ। ঋণ আর ঋণ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ঋণী দেশ। মার্কিনিদের মাথাপিছু ঋণ সবেচেয়ে বেশি। তারা এ শিক্ষাই দিচ্ছে বিশ্বকে-আইএমএফ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, গুগলের সিইও সুন্দর পিচাইয়ের মাধ্যমে। বিয়ে-শাদি নেই, পরিবার নেই। ছেলেমেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ফ্রিজ আছে, তা চলে না, কারণ বিদ্যুতের পয়সা নেই। থাকার জায়গা নেই-তাই দুইতলা, তিনতলা বিছানা। এ যেন ‘ফ্লোর’ থেকে লেভেল’ হওয়া।
এ পথই কি আমরা বেছে নিচ্ছি? ব্যাংক মালিকরা কি আমাদের এই পথেই নিয়ে যাচ্ছেন? জানি না। কিন্তু প্রশ্নের তো শেষ নেই। কেন মূল্যস্ফীতির হারের নিচে হবে আমানতের ওপর সুদের হার? মূল্যস্ফীতি সরকারিভাবেই ১০ শতাংশ। আমানতের ওপর সুদের হার কেন হবে ৫ শতাংশ? ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন, তাহলে ঋণের ওপর সুদের হার বেশি কেন? আমানতকারীদের ঠকানো হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিঘ্ন ঘটানো হচ্ছে। ব্যাংক মালিকরা আসলে কী চান? ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, আমদানি-রপ্তানি কম। কিন্তু প্রতিদিন দেখছি ব্যাংকের মুনাফা বাড়ছে। আরও কথা আছে। ব্যাংক মালিকরা সঞ্চয়ী আমানতের ওপর সুদ দিতেই চান না। অথচ এই আমানতই হচ্ছে ‘কোর আমানত’। এই অ্যাকাউন্টে ধীরে ধীরে ব্যালেন্স বাড়ে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সঞ্চয়ী আমানতের ৮০-৮৫ শতাংশ মেয়াদি আমানত হিসাবে গণ্য করে। অথচ এর ওপর কোনো সুদ দিতে চায় না ব্যাংকগুলো। আর আমানতের সুদের ওপর, আমানতের ওপর কত রকমের ‘চার্জ’? অবিচার আর অবিচার শুধু।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়