Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে পারে বিনামূল্যের সার

Icon

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে পারে বিনামূল্যের সার

ফাইল ছবি

খাদ্যপণ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি (বিআইডিএস) নিয়ে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর শেষ হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সাধারণ মানুষ অধিক কষ্টে দিনাতিপাত করছে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ক্রমেই চরম আকার ধারণ করছে। সামনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র সমাধান হতে পারে বিনামূল্যে সার বিতরণ। পৃথিবীর অষ্টম জনসংখ্যা অধ্যুষিত ও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিতে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণের শর্ত পূরণের জন্য সরকার মূল্যস্ফীতির বোঝা জনগণের ওপর স্বাভাবিকের তুলনায় আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। চারদিকে হাহাকার থাকার কারণে কৃষকরা শস্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না, ফলে তারা কৃষিকাজ থেকে দিন দিন মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থায় কৃষিব্যবস্থা ক্রমেই আমদানিনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ফলে সোনার ফসল ফলা জমি পতিত জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। দেরিতে হলেও উন্নয়নশীল বিশ্ব শিল্পায়নের পাশাপাশি কৃষির ওপর গুরুত্বারোপ করছে। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হলে কৃষিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিনামূল্যে সার বিতরণ কৃষির ওপর গুরুত্বারোপের পূর্বশর্ত। বিভিন্ন কারণে সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, আগামী অর্থবছরে কৃষিতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সার ভর্তুকির জন্য ১৭ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। উন্নত জাতের বীজ বিতরণের জন্যও সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও কীটনাশক, সেচ, কৃষিঋণ ও বিদ্যুতেও সরকার ক্রমাগত ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। পরোক্ষভাবে সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, মৎস্য ও পশুপালন, কৃষি গবেষণা ও কৃষি বিমায় ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে থাকে। সরকারের এ মহৎ কার্যক্রমের জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য হলেও দুর্নীতির কারণে অনেকাংশে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ভর্তুকির বিশাল অর্থ সাধারণ মানুষের কাজে আসে না, তা জনাকয়েক মানুষের ব্যাংক হিসাবে জমে আর বিলাসিতার কাজে ব্যয় হয়। তাই সরকারের পরিশ্রমকে সার্থক করার জন্য কৃষিতে ভর্তুকি এমনভাবে দিতে হবে যাতে দুর্নীতি করার উপায় না থাকে। কাজেই বিনামূল্যে সার সরবরাহ করার পাশাপাশি সারের গুণগত মান নিয়ে কোনো আপস করা যাবে না। সেই সঙ্গে কৃষিসংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। তবেই ২০৪১ সালে আমরা পাব স্মার্ট বাংলাদেশ।

বিনামূল্যে সার সরবরাহে সুবিধা ছাড়া অসুবিধা নেই বললেই চলে। বিনামূল্যে সার সরবরাহ করলে কৃষকরা বেশি সার ব্যবহার করতে সক্ষম হবে এবং সারের অভাবে কৃষিজমি পতিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়বে এবং দেশের মোট খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ফলে কৃষি খাতে সরকারের আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ে কৃষিপণ্য রপ্তানি করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষকদের আয়ও বাড়বে। কৃষি খাতে উন্নয়ন ঘটলে গ্রামীণ অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব করে গ্রাম।

২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপির ১৩.৩৫ শতাংশ আসে কৃষি থেকে, যা টাকার অঙ্কে ছিল ৬১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিনামূল্যে সার সরবরাহ করলে কৃষকরা আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ক্রয় করার ক্ষমতা অর্জন করবে, ফলে ফসলের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। বিনামূল্যে সার সরবরাহ করলে কৃষকদের কৃষিঋণের ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং ঋণের ওপর নির্ভরতা কমে যাওয়ায় তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় অর্থনীতি গতিশীল হবে। ফলে কৃষকরা তাদের সন্তানদের যেমন উচ্চশিক্ষা প্রদানে আগ্রহী হবে, তেমনি হবে স্বাস্থ্যসচেতন। কৃষকদের সন্তানদের এখন বিদ্যালয়ে আনার জন্য অর্থ প্রণোদনা দিতে হয়, তা আর দিতে হবে না।

বিনামূল্যে সার সরবরাহ করলে কৃষকরা জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত হবে, যা পরিবেশের জন্য ভালো। জৈব সার ব্যবহারে মৃত্তিকার উর্বরতা বাড়বে। জৈব সার ব্যবহারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব হবে। বিনামূল্যে সার সরবরাহ করা হলে কৃষিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে সরকারি ভর্তুকি কমে আসবে। কৃষি খাত থেকে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার কৃষিবিষয়ক গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে পারবে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষিসংশ্লিষ্ট দুর্নীতিগুলো রোধ করা সহজ হবে। সর্বোপরি অর্থনীতির চাহিদা ও সরবরাহ বিধি অনুসারে খাদ্যপণ্যের মূল্য কমে আসবে, যার জন্য সরকারকে কোনো প্রকার বাহ্যিক হস্তক্ষেপ করতে হবে না, অর্থাৎ খোলাবাজারে পণ্য বিক্রিসহ বিভিন্ন প্রকার ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করা লাগবে না। পণ্যের ক্রয়মূল্য কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ অধিক সঞ্চয় করতে পারবে এবং মূলধন বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। দেশেও অর্থনীতিতে চাঙাভাব দেখা দেবে। সেই সঙ্গে ছোটখাটো অপরাধ ও দুর্নীতি কমে যাবে, কারণ দারিদ্র্য অপরাধের জননী। দেশীয় অর্থনীতিতে অর্থাৎ মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান দিন দিন বাড়তেই থাকবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারও শান্তিতে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।

বিনামূল্যে সার সরবরাহ দেশের কৃষিক্ষেত্র, কৃষক, পরিবেশ ও সরকারের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার ১ম বাজেটে বিনামূল্যে সার সরবরাহ ব্যবস্থা করায় পরবর্তী ৫ বছর মূল্যস্ফীতি সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। কৃষক বাঁচলে, বাঁচবে দেশ-সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশের প্রথম ভিশন হোক স্মার্ট কৃষিব্যবস্থা।

মো. শাহাদাত হোসেন : প্রভাষক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং

hossainshahadat1985@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম