ইউরিয়া সাশ্রয়ে ন্যানো প্রযুক্তির সম্ভাবনা কতটা

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
আধুনিক কৃষির ঊষালগ্নে ইউরিয়া সার প্রয়োগের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ‘রাসায়নিক সার যুগ’। ফসলের বৃদ্ধি, বিকাশ ও ফলনে জাদুকরী প্রভাব বিস্তারকারী শুভ্র বর্ণের রাসায়নিক সারটি এখনো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রাসায়নিক সার (৬২ শতাংশ)। ষাটের দশকের সবুজবিপ্লব ঘটাতে বারুদের কাজ করেছিল ইউরিয়া দানা। গত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বে ইউরিয়া সারের ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। ক্রমবর্ধমান চাহিদা, অস্থির আমদানি বাজার, পরিবর্তনশীল বিশ্ব বাণিজ্য, জ্বালানি নিরাপত্তা ও কার্বন ইস্যুতে ইউরিয়া সার ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।
বাংলাদেশে এক বস্তা ইউরিয়া সার এখনো কৃষকের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য এক কৃষি উপকরণ। বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ইউরিয়া সার সরবরাহ সরকারের একটি অগ্রাধিকার ইস্যু। সারা দেশে বিসিআইসি সার ডিলার ও খুচরা সার বিক্রেতার মাধ্যমে ভর্তুকিমূল্যে ইউরিয়া সার সরবরাহ করা হয়। জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিসিআইসিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করে এর বাজারমূল্য ও বিতরণ।
বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তর ইউরিয়া সার ব্যবহারকারী দেশ বাংলাদেশ তার চাহিদার ৭০ শতাংশ মেটায় আমদানি দিয়ে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউরিয়া সারের কৃষিজ ব্যবহার ছিল ২৭ লাখ টন; যা ২০২০-২১ সালের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। দেশীয় উৎপাদন ছিল মাত্র ১০ লাখ টন। সার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, উৎপাদন দক্ষতা কমে যাওয়াসহ নানা কারণে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি ঘোড়াশাল নরসিংদী ইউরিয়া সার কারখানার ব্যাপক সংস্কার ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে; কিন্তু এতদসত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না দেশীয় উৎপাদন দিয়ে। ইউরিয়া সার উৎপাদনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ২০তম (১.২ মিলিয়ন টন)। বিশ্বে প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলো হচ্ছে ভারত (২৪.২ মিলিয়ন টন), রাশিয়া (৮.১ মিলিয়ন টন), ইন্দোনেশিয়া (৭.৭ মিলিয়ন টন), পাকিস্তান (৫.৮ মিলিয়ন টন), যুক্তরাষ্ট্র (৫.৭ মিলিয়ন টন) ও ইরান (৫.৫ মিলিয়ন টন)। ইউরিয়া সারে ভর্তুকি দিয়ে এর বাজারমূল্য কৃষকের সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউরিয়া সারে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ইউরিয়ার দাম ওঠানামার প্রভাব পড়ে আমদানিকারক দেশগুলোয়।
২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪৫-৫০ লাখ টন। দেশীয় উৎপাদন দিয়ে বড়জোর ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটানো যেতে পারে। অন্যান্য সারের তুলনায় ইউরিয়ার ফল দ্রুত পাওয়া যায়। এ জন্য কৃষক এ সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া ইউরিয়ার ব্যবহার দক্ষতা (৩০-৩৫ শতাংশ) অন্যান্য রাসায়নিক সারের তুলনায় অনেক কম। প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৬৫-৭০ শতাংশ অপচয় হয়ে যায় নাইট্রিফিকেশন, অ্যামোনিফিকেশন, উদ্বায়ীকরণ, চোয়ানো ও পারকোলেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
ইউরিয়া সারের অপচয় হ্রাস ও ব্যবহার সুষম করার জন্য গত ত্রিশ বছর নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গুটি ইউরিয়া সারের প্রয়োগ সবচেয়ে সাড়া জাগানো। গবেষণায় দেখা গেছে, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে ধান চাষে ইউরিয়া সারের ব্যবহার অর্ধেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব এবং ফলন ১৫-২৫ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। খুবই আশাব্যঞ্জক তথ্য। এর প্রচার-প্রসারে সর্বাÍক ব্যবস্থাই নেওয়া হলো সরকারি-বেসরকারিভাবে। সারা দেশে সহস্রাধিক ব্রিকেট যন্ত্র সরবরাহ করা হলো। ২০০৫ সাল থেকে গুটি ইউরিয়া সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলো। দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করল গুটি ইউরিয়া নিয়ে। সারা দেশে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কৃষক-কৃষানিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। মিডিয়াতে গুটি ইউরিয়ার সফলতার গল্প নিয়ে ডকুমেন্টারি, নিউজ হলো। পাঁচতারা হোটেলে সভা-সেমিনার হলো। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে প্রয়োগঘটিত সমস্যার কারণে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করার যন্ত্র আবিষ্কার, সম্প্রসারণ ও বিপণন করা হলো। দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য পত্রিকায় প্রচার, মেলায় প্রদর্শনসহ নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো এবং কৃষক গ্রহণও করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাগসই এ প্রযুক্তিটিও টিকলো না সময়ের পরীক্ষায়। কৃষক আবার ফিরে গেল পুরোনো পদ্ধতিতেই। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালের মধ্যেই গুটি ইউরিয়া বিদায় নিল কৃষকের মাঠ থেকে। এখনো হয়তো কিছুটা আছে গবেষণা, প্রকাশনা ও রিপোর্টে।
ইউরিয়ার ব্যবহার সাশ্রয়ে লিফ কালার চার্চ বা এলসিসি প্রযুক্তিও একসময় খুব প্রচার ও প্রসার পাচ্ছিল। নতুন প্রযুক্তি বলে অনেকে চেষ্টাও করলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ প্রযুক্তিটাও জনপ্রিয়তা পায়নি। সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে মৃত্তিকা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ভ্রাম্যমাণ মাটি পরীক্ষাগারের মাধ্যমে কৃষকের মৃত্তিকা নমুনা পরীক্ষা করে ‘মৃত্তিকা স্বাস্থ্য কার্ড’ দেওয়া হলো। সারের এ প্রেসক্রিপশনকে কৃষকরা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন না। মিনি সয়েল টেস্টিং কিটও এখন জাদুঘরে।
শেষ পর্যন্ত ‘ডিএপি কৌশলের’ মাধ্যমে ইউরিয়া সারের ব্যবহার সুষম করার জন্য সর্বশেষ যে উদ্যোগটা নেওয়া হলো, সেটিও কাঙ্ক্ষিত ফল নিয়ে আসতে পারল না। ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি যৌগিক সার নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সরবরাহ করে। ডিএপি সারে ১৮ শতাংশ নাইট্রোজেন বিদ্যমান অর্থাৎ ২.৫ কেজি ডিএপি সার প্রয়োগে এক কেজি ইউরিয়ার কাজ করে। ২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশে মোট ১৯.২৭ লাখ টন ডিএপি সার ব্যবহৃত হয়েছে, যা ২০১৩ সালে ছিল মাত্র ৩.১ লাখ টন। গণিতের হিসাবে ২০২২-২৩ সালে ডিএপি থেকে ইউরিয়া সার পাওয়া গেছে ৭.৫ লাখ টন। কিন্তু ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমেনি, উলটো বেড়েছে তিন লাখ টন। গণিতের হিসাব আর মাঠের হিসাব মেলেনি।
এখন বড় একটা জিজ্ঞাসা-আর কী পদক্ষেপ নিলে ইউরিয়া সারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার লাগাম টেনে ধরা যাবে। সব নীতি-কৌশল অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর আর কী প্রযুক্তি বাকি আছে? সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে উৎপাদিত ইফকো ন্যানো তরল সার সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলেছে। এটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার শুরু হয়েছে ভারতে; সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে ন্যানো তরল ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা নিয়ে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। ইফকো ন্যানো বায়োটেকনোলজি রিসার্স সেন্টার থেকে উদ্ভাবিত এ সারের ৫০০ মিলিলিটার ৪৫ কেজি ইউরিয়া সারের সমান কাজ করতে পারে বলে তাদের দাবি। যদিও বাংলাদেশে তরল সারের ব্যবহার অনুমোদিত নয়, তবুও অ্যাগ্রো কেমিক্যাল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ট্রায়াল শুরু করেছেন। করপোরেট জগৎ বড় একটা ব্যবসার সম্ভাবনা দেখছে ভারতের ইফকো ন্যানো তরল সার আমদানি ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে; বড় কোম্পানির পাশাপাশি ছোট অনেক কোম্পানি এবং ব্যক্তি পর্যায়েও উজ্জীবিত এর ব্যবসা সম্ভাবনা নিয়ে। তারা আশা করছে, ন্যানো ইউরিয়া সার কৃষক গ্রহণ করবে ‘হট কেকে’র মতো। গুটি ইউরিয়া যেখানে মাত্র একবার প্রয়োগ করলেই আবাদ হয়ে গেছে, সেটিও এদেশে জনপ্রিয়তা পায়নি। শুধু ন্যানো তরল ইউরিয়া দিয়ে আবাদ হবে না, প্রথম দুটি ডোজ দানাদার ইউরিয়া দিতে হবে, স্প্রে করতে অতিরিক্ত মজুরি খরচ লাগবে।
আমদানির ওপর নির্ভর না করে দেশেই ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ত্বরান্বিত করা দরকার। এ প্রযুক্তি গবেষণায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ন্যানো মেটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আমাদের সক্ষমতা এখনো অনেক কম। বুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শুরু করছে এ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা। এ খাতে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করা সম্ভব হলে তা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ড. মো. রওশন জামাল : কৃষিবিদ ও প্রাবন্ধিক
roushonjamal@yahoo.com