Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

এসএসসির ফলাফলে এমন ‘হ্যাটট্রিক’ অপ্রত্যাশিত

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এসএসসির ফলাফলে এমন ‘হ্যাটট্রিক’ অপ্রত্যাশিত

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, সিলেট স্থাপিত হয় ১৯৯৯ সালে। অন্য বোর্ডগুলোর পাশাপাশি সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীনেও ২০০১ সাল থেকে এসএসসি বা এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পরীক্ষায় (সিলেট শিক্ষা বোর্ডের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা এসএসসি ২০০১) সাধারণ ৭টি বোর্ডে গড় পাশের হার ছিল ৩৫.২২। পাশের হার বিবেচনায় বেশির ভাগ বোর্ডকে টপকিয়ে সিলেট বোর্ড তৃতীয় স্থানটি দখল করে নেয়। বোর্ড হিসাবে নতুন; রাজশাহী ২৬.৭৪, কুমিল্লা ৩০.৯৬, বরিশাল ৩৪.৮০ ও যশোর বোর্ডে যখন এসএসসিতে পাশের হার ৩৬.১৮, তখন সিলেট বোর্ডের ৩৯.০৩ ভাগ পরীক্ষার্থী সাফল্যের মুখ দেখে। সিলেটের উপরে ছিল কেবল চট্টগ্রাম (৪৪.৮৮) ও ঢাকা (৪৩.৫০)। পরের বছরের (২০০২) এসএসসি পরীক্ষায়ও সিলেট বোর্ড আগের অবস্থানটি (তৃতীয় স্থান) ধরে রাখতে সক্ষম হয়। সেবার গড় পাশের হার যেখানে ৪০.৪৩, সেখানে সিলেট বোর্ডে ৪১.৯৭। যশোর (৫০.৭২) ও ঢাকা (৪৩.৮০) ছাড়া বাকি ৪টি বোর্ডেই ফলাফলে বলতে গেলে বিপর্যয় ঘটে। এ ৪টি বোর্ডের কোনোটিই গড় পাশের হারটি স্পর্শ করতে পারেনি (রাজশাহী ৩৯.৯৪, চট্টগ্রাম ৩৭.৮০, বরিশাল ৩৬,৩৯ ও কুমিল্লা বোর্ডে পাশের হার ২৯.২৪)। আরও বিস্ময়কর হলো, প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় সিলেট বোর্ড শীর্ষস্থান দখল করেছিল। ২০০৩ সালের পরীক্ষায় ৭টি সাধারণ বোর্ডে গড়ে পাশের হার যেখানে ৩৫.৯১, সেখানে সর্বোচ্চ ৪৫.১৫ ভাগ পাশ করে সিলেট বোর্ড (রাজশাহী ৩০.১২, কুমিল্লা ৩২.৬০, বরিশাল ৩২.৮০, চট্টগ্রাম ৩৫.১২, ঢাকা ৪০.০৪ ও যশোর বোর্ড ৪২.১৪) বিজয়ের হাসি হাসে।

সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কেবল এসএসসি নয়, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও সিলেট শিক্ষা বোর্ড দীর্ঘদিন সাফল্যের এমন ধারা বহন করেই এগিয়ে চলে। যেমন ২০০১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডে পাশের হার ৩০.৬৩। অন্যদিকে সেবার (২০০১) রাজশাহী ২৪.৭৬, চট্টগ্রাম ২৩.৮৮, বরিশাল ১৮.৮৫ ও কুমিল্লা বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষায় পাশের হার ছিল ১৮.২৭। একইভাবে ২০০২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও সিলেট বোর্ডে পাশের হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো; ২৮.৬৯ ভাগ। পাশাপাশি বরিশাল ২২.৫৮, চট্টগ্রাম ২২.৩৫, রাজশাহী ১৮.১৮ ও কুমিল্লা বোর্ডে পাশের হার ১৭.১৩।

তবে যে কারণেই হোক, হঠাৎই ঘটে সিলেট বোর্ডের এ সাফল্যের ছন্দপতন, বলতে গেলে অবিশ্বাস্য রকমের ছন্দপতন। কী কারণে বছরের পর বছর একের পর এক তা ঘটে চলেছে, তা খুঁজে বের করা খুবই জরুরি বলে মনে করি।

এক বছর নয়, বিরতি দিয়েও নয়, এক নাগাড়ে ঘটে চলেছে পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডের ফল বিপর্যয়। অন্যসব কিছুর মতোই শিক্ষাক্ষেত্রেও করোনা মহামারির বিরূপ প্রভাব পড়ে। তা সত্ত্বেও ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ময়মনসিংহ ও সিলেট বোর্ডে সর্বোচ্চ ৯৭ ভাগ পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু এরপর কী থেকে যে কী হয়ে গেল! সিলেট বোর্ড যেন মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না! না পাশের হারে, না জিপিএ-৫ পাওয়াদের সংখ্যায়। ২০২২, ২০২৩, ২০২৪; এ যেন ‘সিরিজ বিপর্যয়’! তিন বছরই অন্য সব বোর্ডের তুলনায় সাফল্যের একেবারে তলানিতে সিলেট বোর্ড! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কোথাও কেউ নেই দেখার, কোথাও কেউ নেই কিছু বলার; চলছে তো চলছেই! নেই কোনো প্রতিকার-প্রতিবিধান!

২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড়ে পাশের হার ছিল ৮৭.৪৪। পাশের হারে শীর্ষে যশোর ৯৫.১৭ আর সবার নিচে সিলেট ৭৮.৮২। বিপর্যয় কেবল পাশের শতকরা হারে নয়, জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও। সে বছর (২০২২) এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় রেকর্ডসংখ্যক, ২ লাখ, ৬৯ হাজার ৬০২ জন জিপিএ-৫ পায়। সাধারণ অন্যান্য শিক্ষা বোর্ড তো বটেই, এমনকি মাদ্রাসা (জিপিএ-পাঁচ ১৫ হাজার ৪৫৭ জন) এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডও (জিপিএ-পাঁচ ১৮ হাজার ৬৫৫ জন) পাশের হার ও জিপিএ-৫ পেয়ে ভালো একটি চমক দেখায়। অথচ জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সিলেট বোর্ড সবার নিচে; মাত্র ৭ হাজার ৫৬৫ জন। ২০২৩ ও ২০২৪ সালেও ঠিক আগের মতোই-‘যথা পূর্বং তথা পরং’। ২০২৩ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাশের হার ৮০.৩৯। সর্বোচ্চ বরিশাল বোর্ডে ৯০.১৮ ভাগের বিপরীতে সবার নিচে সিলেট বোর্ড ৭৬.০৬। ১১টি বোর্ডের মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সিলেট বোর্ডের বেশ করুণ দশা; সবচেয়ে কম, মাত্র ৫ হাজার ৪৫২ জন। আর এবার (২০২৪) সিলেট শিক্ষা বোর্ডের ঘোর অমানিশা যেন কাটতেই চাইছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল (২০২৪) পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১১টি বোর্ডে গড়ে পাশের হার ৮৩.০৪। সর্বোচ্চ যশোর বোর্ডে ৯২.৩৩ ভাগের বিপরীতে সবার নিচে রয়েছে সিলেট বোর্ড ৭৩.৮৮। জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সিলেট শিক্ষা বোর্ডের দুর্ভাগ্যজনক ধারাবাহিকতা। সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। কিন্তু ১১টি বোর্ডের মধ্যে সিলেট বোর্ডে সবচেয়ে কম জিপিএ-৫, মাত্র ৫ হাজার ৪৭১ জন!

পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয় আমাদের দেশে নতুন নয়, স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫২ বছর ধরেই কোনো না কোনোভাবে আমরা তা দেখে আসছি। বোর্ডভিত্তিক পাশের উচ্চহার ও নিম্নহারের মধ্যকার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এ যেন ‘কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি’। বিপর্যয় ব্যক্তি পর্যায়ে হলে তবু মেনে নেওয়া যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক হলেও বাস্তবতার নিরিখে মেনে নিতে হয়। কিন্তু গোটা শিক্ষা বোর্ডের এমন ধারাবাহিক বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা কী?

এসএসসি তথা পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে চমকের কোনো শেষ নেই। চারপাশে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ১০টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাশের হার যেখানে ৭৮.৩৩ ভাগ, সেখানে সর্বোচ্চ মাদ্রাসা বোর্ডে ৯৪.০৮ ভাগ। আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ঢাকা বোর্ডে সর্বোচ্চ ৮৪.৫৪ ভাগের বিপরীতে যশোর বোর্ডে পাশ করে মাত্র ৬০.৫৮ ভাগ পরীক্ষার্থী। এমন ফল বিপর্যয়ের দায় বহনকারী যশোর বোর্ড এবার (২০২৪) এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হারে সবার শীর্ষে। যশোর বোর্ডের এমন সাফল্য বেশ আশার কথা; কিন্তু একসময় সবার শীর্ষে থাকা সিলেট বোর্ড এসএসসি পরীক্ষায় পাশের নিম্নহারে ‘হ্যাটট্রিক’ করল কীভাবে, তা আমার বোধগম্য নয়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকার বিশেষ একটি বোর্ডের অধীন শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর এমন খারাপই বা করতে থাকবে কেন? প্রতি বছর আমরা বেশ ঘটা করে ফল প্রকাশ করি। এমন বিপর্যয় বা মহাবিপর্যয়ের দিকে সবার দৃষ্টি দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম