Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে যা করতে হবে

Icon

ড. রাজীব চক্রবর্তী

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে যা করতে হবে

বাংলাদেশের চাপে পড়া সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অধোগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি, রপ্তানি আয় কমে যাওয়া, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি, রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট, ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট ঘাটতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বেকায়দায় ফেলেছে। এছাড়া আগেই প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলায় শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ৬-৯ সুদের হার সীমা তুলে দিয়েও স্বস্তি মিলছে না। বাস্তবে, সরকারের ৬ শতাংশ আমানতকারীর জন্য ৯ শতাংশ ঋণ গ্রহীতার জন্য সুদের হার প্রবর্তনের পেছনে বেশ কিছু সদিচ্ছা ছিল। যেমন-১. ব্যাংক মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফা কমানো, ২. ক্ষুদ্র ও সাধারণ ঋণগ্রহীতাকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া, ৩. বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ৪. ঋণহার ও আমানত হারের মধ্যে বিস্তার বা স্প্রেড কমিয়ে ব্যাংক মালিকদের মুনাফায় কিছুটা লাগাম টানা। আর ২০২০ সালে দেশের মূল্যস্ফীতিও ৫ বা ৬ ভাগের বেশি ছিল না। কিন্তু প্রথমে করোনা এবং তার পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার বৈশ্বিক অর্থনীতিকে চাপে ফেলে। অভ্যন্তরীণ কারণ ছাড়াও বৈশ্বিক অস্থিরতা, যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের ঊর্ধ্বমূল্য, পণ্যের জোগান কমে যাওয়া ও দাম বৃদ্ধি দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে।

পণ্যের আমদানি কর বৃদ্ধির ফলে যেমন আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে, তেমনি দেশীয় শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যায়। আবার অর্থনৈতিক সংকটে অনেক দেশ আমদানি কমিয়ে দেয় যা আমাদের মতো দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পকে বিপদে ফেলে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি দেখা যায়, যা আবার বাজারকে অস্থির করে তোলে। তাই প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, যা এখন আমাদের দেশে দুই ডিজিট ছুঁইছুঁই। তবে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতি যে শুধু বাংলাদেশে বিদ্যমান, তা কিন্তু নয়। যেমন ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ১০ ভাগে পৌঁছেছিল। কিন্তু তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরমি পাওয়েল রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য দফায় দফায় সুদ হার বাড়িয়েছিলেন। অথচ মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনের কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন চাননি যে, সুদহার বেড়ে বিনিয়োগ কমে গিয়ে প্রবৃদ্ধি কমে যাক। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা না করে স্বাধীন ফেডারেল রিজার্ভের নেওয়া নীতি সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিয়েছিল। মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত ভাগে নেমে গিয়েছিল। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে শুরুতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রা সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ নীতি সুদহার (রেপো) বাড়িয়ে বাজারে অর্থের জোগান কমানো। স্বাভাবিকভাবেই নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংক ঋণ ব্যয় বেশি হয়ে পড়ে এবং বাজারে টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি কমে যায়। আবার টাকা যখন সস্তা হয়ে যায়, তখন ব্যক্তিগত ঋণ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পায়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে ৪টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা জানায় : ১. মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ, ২. ব্যাংকের তারল্যের জোগান বাড়ানো, ৩. খেলাপি ঋণ কমানো এবং ৪. ডলার সংকট মোকাবিলাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো। পরবর্তীকালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের নিম্নমুখী প্রবণতার ফলে বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও আমাদের দেশে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। বিশ্বব্যাংকের চোখে মূল্যস্ফীতির ৪টি প্রধান কারণ হলো-১. আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম না কমা, ২. সঠিক মুদ্রানীতি প্রণয়নে ব্যর্থতা, ৩. টাকার ক্ষয় বোধ করতে না পারা, ৪. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটের কারণগুলো, যেমন-খেলাপি ঋণের আধিক্য, রিজার্ভ ক্ষয়, অনিয়মিত রপ্তানি, আয়, রেমিট্যান্স আনয়নে দুর্বলতা, ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থাহীনতা, তারল্য সংকট, মূলধন ঘাটতি, অত্যধিক আমদানিকর, শেয়ারবাজারে অনিয়ম, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার, অতিরিক্ত আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার পাচার। মূলত অর্থনীতিতে এ ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে এ খাতে ঘটে যাওয়া কিছু অপনীতির কারণে। আর সেগুলো হলো-১. স্বাধীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে না পারা, ২. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভাগে পরিণত হওয়া, ৩. ব্যাংক পরিচালকদের পরিবারতন্ত্র বজায় থাকা এবং ৪. খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাতে নিত্যনতুন খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার নবায়ন। অর্থাৎ মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে ৮০ হাজার কোটি টাকা থেকে এখন প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকায় ঠেকেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। পরিসংখ্যান বলছে যেখানে গত ২০২২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০২৩-এর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে। তাই অর্থনীতির স্বাস্থ্য মজবুত করার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ থাকতে হবে। ট্যারিফ রেট, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের ৬ শতাংশের কাছাকাছির বিপরীতে বাংলাদেশে প্রায় ৩ গুণের বেশি, বাজারে প্রতিযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করের সীমা ঠিক রেখে করের আওতা বাড়াতে হবে।

ব্যাংকিং খাতের সুদের হারের নয়ছয়ের দিন শেষ। ব্যাংক ঋণের সুদ এরই মধ্যে ১৩ শতাংশ ছুঁয়েছে। এক দেশে দুই নিয়ম চলতে পারে না। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১১ শতাংশের বেশি সুদ হার এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে কম সুদ হারের ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকছে না। গরিব, বিধবা, মধ্যবিত্ত ও স্থির আয়ের মানুষকে সুবিধা দেওয়ার বিপরীতে আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ী ৯ শতাংশে সস্তা ঋণ নিয়ে এতদিন উচ্চ হারের সুদে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছে। ফলে দিনদিন অলস সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিনিয়োগকে ব্যাহত করছে। উচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ করে স্থির আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল আরও বিস্তৃত করা দরকার। মোদ্দাকথা, ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্টে যাতে কোনো ফসকা গেরো না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এতেই আস্তে আস্তে অর্থনীতিতে সুদিন ফিরে আসবে।

ড. রাজীব চক্রবর্তী : গবেষক ও লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম