আইনের প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা জরুরি
ড. মো. রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
মানবসমাজে দিন দিন অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ইদানীং মহামারি আকার ধারণ করছে। একদিকে সমাজ ও সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন এ প্রবণতা বেড়ে চলেছে; অন্যদিকে নারীর অবমাননা বা নারীর ওপর নির্যাতন সমাজে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। নারী নির্যাতন রোধে দেশে বহু আইন রয়েছে। তবুও কেন এত সহিংসতা?
নারী নির্যাতন বলতে সাধারণত নারীদের ওপর দৈহিক, মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতন বোঝায়। আরও সহজভাবে বলা যায়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নারীরা যখন অন্যের দ্বারা জোরপূর্বক বঞ্চনার শিকার হয় এবং শারীরিক, যৌন ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সে পরিস্থিতিকে নারী নির্যাতন বলা যায়। তথাপি নারীর যে কোনো অধিকার খর্ব বা হরণ করা এবং নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেওয়া বা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত।
দেশে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। এ আইনকে ২০১৩ সালে সংশোধন করে শাস্তি আরও কঠোর করা হয়। এ আইনে বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী ও শিশু অপহরণ, নারী ও শিশু পাচার, নারী ও শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানো ও যৌনপীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো এবং ভিক্ষাবৃত্তিসহ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে অঙ্গহানি করা হলে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের ফলে জন্মলাভকারী শিশুসংক্রান্ত বিধানসংবলিত অপরাধের বিশেষ বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বরে সর্বশেষ সংশোধন করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী নির্যাতন আইন সংশোধন করা হলেও সেখানে আইনের অনেক ফাঁকফোকর ও বৈষম্যমূলক ধারা রয়েছে। বিশেষত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।
নারী নির্যাতন একদিকে যেমন নারীর শারীরিক ও মানবিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে, অন্যদিকে তার পরিবার, সন্তানাদি ও অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে কোনো জায়গায়ই নারীরা নিরাপদ নয়। সব জায়গায় নারীরা নির্যাতনের শিক্ষার হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করলে ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবাদকারীর প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। কাজেই বর্তমানে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের বেশ অভাব, ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া ভাব ও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নারীর প্রতি সহিসংসতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তবে যুগ যুগ ধরে নারীদের মনে যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজ নারীদের জন্য নয়; নারীরা ঘরের বাইরে গেলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ধ্বংস হবে। এখনো এ ধারণা বদ্ধমূল রাখার চেষ্টা চলছে।
অনেক সময় আইনের আশ্রয় নিলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী বা তাদের পরিবারের সদস্যদের চাপে অনেক ধর্ষণের তথ্য চাপা পড়ে যায়। এর প্রকৃত চিত্র অধরাই থেকে যায়। আজ অবধি কতজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এর সঠিক তথ্য কিন্তু জাতি জানতে চায়। সত্যিকার অর্থে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ঠিকই বেরিয়ে যায়। এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়েছে। উৎপাদন, পেশাগত ও শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয়তা বাড়ছে। এর পরও নারীরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এক্ষেত্রে আইনের দ্বারস্থ হলেও মামলার দীর্ঘসূতার কারণে অনেকে বিচার পাচ্ছে না। এর কারণ রাজনীতিকদের সদিচ্ছতার বড় অভাব। তাছাড়া সমাজে নানা কুসংস্কার বিদ্যমান। এর মধ্যে ধর্মীয় প্রভাব, অশিক্ষা ও কন্যাসন্তানকে সমাজের অভিশাপ বলা হয়। এ ধরনের কুসংস্কারের কারণে সমাজের ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞরা নারীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। তাছাড়া সমাজে একশ্রেণির কিছু মানুষও রয়েছে, যারা সমাজে নারীদের বোঝা ও ভোগের পণ্যসামগ্রী মনে করে। কিন্তু তারা বুঝতে চায় না নারীরাও সমাজের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বর্তমান যুগে নারীরা বোঝা নয়, বরং উন্নয়নের অংশীদার। এর শত শত উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর থেকেই নারীর জীবনমানে অকল্পনীয় পরিবর্তন এসেছে। তবুও দেশে সামাজিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে নারীরা রাস্তাঘাটে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর পাশাপাশি উঠতি বয়সের যুবকরা রাস্তাঘাটে ও মাঠে-ময়দানে এবং স্কুল-কলেজের আঙিনায় ইভটিজিং করছে। অনেক সময় মোবাইলে ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি যুবসমাজকে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রথমেই সামাজিক সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
নারী নির্যাতন নিরসনে নারীসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে আগে। এর পাশাপাশি পুরুষদের চাই উদার মনোভাব আর নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, অক্ষরজ্ঞান ও শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করা এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করাও সমাজ তথা দেশের সব মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতার সঙ্গে উন্নয়ন ও শান্তির সংগ্রামে নারী সমাজের অংশগ্রহণ। যদি নারীদের শিক্ষার সঙ্গে সামাজিক রীতিনীতি, লোকাচার, নিরাপত্তা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, তাহলে নারী নির্যাতন অনেকাংশে কমে আসবে বলে অনেকের ধারণা। এর সঙ্গে বাল্যবিয়ে রোধ, যৌতুক প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার, রেজিস্ট্রিকৃত বিয়ে সম্পর্কে জ্ঞানদান, দ্বিতীয় বিয়ে রোধে আইনের সংস্কার, অ্যাসিড, ধর্ষণ ও স্ত্রী হত্যার মতো সামাজিক ব্যাধি সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইনগত ও সামাজিক ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় ও মহল্লায় বিভিন্ন ধরনের ক্লাব, সভা ও সেমিনারের আয়োজন করা বিশেষ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রচার মাধ্যমগুলোয় আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে আর প্রয়োজনে লিফলেট বিতরণ করতে হবে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানসিক পরিবর্তন এবং দেশের রাজনীতির নামে অপরাজনীতির দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। নারীদের ধর্মীয় কুসংস্কার ও অশিক্ষার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এজন্য নিজেদের অধিকার নিজেদেরই আদায় করে নিতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য গত তিন দশকে বাংলাদেশে বিভিন্ন আইন হয়েছে। কিন্তু এ সহিংসতা বন্ধের জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন দরকার, তেমনি সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন। কোনো নারী যদি নির্যাতনের শিকার হয়, সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ আইনের সহায়তার জন্য জাতীয় জরুরি সেবাগুলো চালু রয়েছে। এ জরুরি সেবাগুলো ট্রিপল নাইন এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন রয়েছে। তাই যে কোনো সময়ে নির্যাতিত নারীরা সহায়তা চাইতে পারেন। বিশেষ করে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে এর কোনো প্রতিকার কখনো হবে না বলে সুশীল সমাজ মনে করে। এজন্য সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে শিশু ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে সব কর্মকর্তা-কর্মচারকে নারীর প্রতি সহনশীল আচরণের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেই সঙ্গে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। আর সমাজের প্রতিটি পরিবার তাদের সন্তানকে নৈতিকতা এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য অবশ্যই শিক্ষা দিতে হবে। এর পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও নারীর প্রতি সম্মানের মানসিকতা সৃষ্টির জন্য প্রতিনিয়তই নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। বিশেষত শিশু ও নারী নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজনে শাস্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রশাসনের নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বিশেষ করে সব ধরনের নারী নির্যাতনের বিচার কাজ তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। তাছাড়া ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর নির্যাতিত শিশু ও নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম