Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ক্ষুদ্র্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম : একটি প্রস্তাবনা

Icon

শুভ্র জ্যোতি চাকমা

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষুদ্র্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম : একটি প্রস্তাবনা

পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে দেশে পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয় ২০১৭ সালে। স্বাধীনতার প্রায় ৪৬ বছর পর দেশে এ ধরনের কার্যক্রম সরকারিভাবে প্রথম চালু হওয়ায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। অনেকে মনে করেন, ভাষাগত কারণে দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা পেছনে পড়ে থাকে। শিক্ষাবিদরাও মনে করেন, শিশুর বিকাশ মাতৃভাষায় হওয়ায় এ কার্যক্রম অত্যন্ত সময়োপযোগী। এরপরও যে উপকারটি হয়েছে সেটি হচ্ছে, গতি হারানো ভাষাগুলো এ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করবে। স্ব স্ব ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতির ভাষাগুলোর মধ্যে সাবলীলতা আসবে-এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সাহিত্য সৃষ্টি না হলে ভাষার সজীবতা রক্ষা করা কঠিন।

মহৎ এ শিক্ষা কার্যক্রমটির সাত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য সাতটি বছর পর্যাপ্ত সময়। অগ্রগতি, ব্যর্থতা মূল্যায়ন করার উপযুক্ত সময়। অধিকন্তু এ কার্যক্রমের ব্যর্থতাগুলোকে শোধরানোর জন্য আগামীর করণীয় যদি নির্ধারণ করা না যায়, তাহলে আমরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হব না। স্পষ্টভাবে বলি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সংশ্লিষ্ট ভাষিক জাতির একজন হয়ে, অধিকন্তু চাকমা হরফ চর্চাকারী হিসাবে আমি এখন পর্যন্ত এ কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। লক্ষ্যহীনভাবে চলছে মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম। আমার মনে হয় না, এ কার্যক্রমটির লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা এখনো সুনির্দিষ্ট কৌশল নিরূপণ করতে সক্ষম হয়েছি। প্রতিবছর পাঠ্যবইগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে বিতরণ করে দায় সারছি। শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন কি না, মনিটরিং হচ্ছে কি না, তাও জানি না। স্মর্তব্য, চাকমা বা মারমা হরফ জানা না থাকলে মনিটরিংয়ের কাজ সঠিকভাবে হবে না। আমি নিশ্চিত, এ কার্যক্রমটি মনিটর করার যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে নেই। যা হোক, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষা কার্যক্রমটি শুরুর প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা এবং পাঠ্য উপকরণ সম্পর্কে আলোচনা করছি।

দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই দায়সারা ভাব নিয়ে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রমটি শুরু করা হয়েছে। পাঠ্যবই মুদ্রণ ছাড়া অন্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়নি। যারা পাঠদান করবেন সেই শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়নি। ফলে পাঠ্যপুস্তকগুলো কারা বা কে পড়াবে, তা নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের হয়তো ধারণা ছিল যে, সংশ্লিষ্ট জাতির শিক্ষক হলেই পাঠ্যবইগুলো পড়াতে সক্ষম হবেন। এ কারণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি তারা হয়তো হালকাভাবে নিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, চাকমা বা মারমাদের নিজস্ব হরফ থাকার পরও চর্চা বা শিখনের সুযোগ না থাকায় তাদের অধিকাংশই নিজস্ব হরফে পড়তে বা লিখতে পারেন না। কর্মরত শিক্ষকদের বেলাও একই বাস্তবতা। এ বাস্তবতায় শিক্ষা কার্যক্রমটির সন্তোষজনক অগ্রগতি অবশ্যই হোঁচট খাবে। ফলে সাত বছর পরও এ বিষয়ে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে মনে করার কারণ নেই।

আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, মাতৃভাষার বইগুলো পড়ানোর জন্য এখনো উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি হয়নি। এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। মাতৃভাষার বই পড়ানোর বিষয়ে অধিদপ্তর প্রদত্ত রুটিনে উল্লেখ নেই। বিদ্যালয় ভেদে যে যার মতো বইগুলো দায়সারাভাবে পড়াচ্ছেন। এই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই হতাশ হব। হতাশা থেকে উত্তরণের পন্থা শিগ্গিরই বের করা না গেলে মহৎ এ শিক্ষাক্রমের সুফল আগামী সাত বছরেও পাওয়া যাবে না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে মাতৃভাষা শিক্ষাক্রম নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে, যেখানে মনিটরিং সেল গঠন করা একান্ত অপরিহার্য। এ সেলে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠী থেকে বিজ্ঞজনদের যুক্ত করা প্রয়োজন। দেশের এ বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেক শিশু বেসরকারি বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। এসব বিদ্যালয়ে মাতৃভাষার পাঠ্যবই পড়ানো হয় কি না আমরা এখনো জানি না। এই শিক্ষা কার্যক্রম সেখানে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে। তাদেরকে এ শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টি হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

একজন শিশু শিক্ষার্থীর শিখনের যত ধরনের উপকরণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তার পাঠ্যবই। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে সে নিজেকে আবিষ্কার করে আনন্দ লাভ করে, জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। শিখন উপকরণ যদি তার কাছে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে না পারে, অধিকন্তু গ্রহণযোগ্যতা আনয়নে সক্ষম না হয়, তাহলে সে সেগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকবে-এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। এজন্য শিশুর সৃষ্টিশীল মননকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য পাঠ্য উপকরণকে তার পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা করা হয়। এ কারণে শিক্ষাবিদরা মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর বিকাশকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এখন যে প্রশ্নটি বারবার আমাদের সামনে আসে সেটি হচ্ছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের পাঠ্যবইগুলো কতটুকু শিশুবান্ধব হয়েছে? এনসিটিবির সঙ্গে পাঠ্য উপকরণ উন্নয়ন কাজে জড়িতদের মতে, তাদের শুধু বাংলায় রচিত পাঠ্যবইকে ক্ষুদ্র জাতির ভাষা ও বর্ণে অনুবাদ করতে বলা হয়েছে। নতুন কনটেইন যুক্ত না করার নির্দেশনা তো আছেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎসব, ব্যক্তি ও পরিবেশের কিছু তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে মাত্র। আমাদের পাঠ্যপুস্তক অনুবাদক বা লেখকরা এ ধরনের কাজটিও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পাঠ্যবইয়ে বাংলা ভাষার প্রভাব স্পষ্টভাবে বিদ্যমান, বিশেষত চাকমা পাঠ্যবইয়ে। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা করে শিখনের যে রীতি পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে, তা চাকমা হরফ শিখনে কোনোকালে ছিল না। হরফের যে চার্ট ছাপা হয়েছে, সেটিও ভুল। বর্ণের অবস্থান ঠিক নেই। একটি লাইনে চারটি হরফ সাজানো হয়েছে, যেখানে ব্রাহ্মী হরফের সেটিংকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চাকমা মাজ্যাপাতের আদি রীতিকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। এর জন্য আমরা কাকে দায়ী করব?

সব কথার শেষ কথা হলো, আমাদের স্বজাতীয় লেখক বা অনুবাদকদের দুর্বলতা কিংবা যোগ্যতার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। তাদের কারও কারও যোগ্যতার বিষয়টি আমাদের স্বজাতীয়দের অনেকে বুঝতে পারলেও হয়তো এনসিটিবি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্তারা বুঝতে পারছেন না। সম্পাদনা পরিষদ গঠন করে দিলে এ সমস্যার সমাধান অনেকাংশে কমে যাবে। আমাদের জানা প্রয়োজন, শুধু চাকমা হরফ লিখতে বা পড়তে পারলেই তিনি লেখক বা অনুবাদক হতে পারেন না। ভাবী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে আমরা এমন ভুলে ভরা পাঠ্য উপকরণ পড়তে দিতে পারি না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কাম্য।

শুভ্র জ্যোতি চাকমা : রিসার্চ অফিসার, ক্ষুদ্র্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি

shuvrachakma71@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম