আরাকানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহাসিক পটভূমি
ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরাকান রাজ্যের পটভূমি রচিত হয়েছিল উত্তর ভারতের বিহার রাজ্যে, মৌর্য সম্রাট অশোকের সময় থেকেই। কলিঙ্গের যুদ্ধে বিজয়ের মালা ছিনিয়ে আনলেও সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানিতে ভীষণ মর্মাহত হলেন সম্রাট অশোক।
অহিংস নীতির পথে হাঁটলেন, গ্রহণ করলেন বৌদ্ধধর্ম। দেশে দেশে অহিংস ধর্মের বাণী নিয়ে দূত পাঠালেন। মৌর্য সাম্রাজ্যে তো বটেই, সাম্রাজ্যের বাইরেও বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়ল প্রতিবেশী বাংলার সমতট আর হরিকেল জনপদে। কুমিল্লার শালবনবিহার আজও তারই স্মৃতি বহন করছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ সালে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হলো। পুরো উত্তর ভারতে নেমে এলো প্রায় ৫০০ বছরব্যাপী এক অন্ধকার যুগ। ছোট ছোট অসংখ্য রাজ্যের হিন্দু উগ্রবাদীরা নির্বিচারে বৌদ্ধ নিধনে মত্ত হলো। বৌদ্ধরা দলে দলে পালিয়ে আশ্রয় নিল অজন্তা আর ইলোরা গুহায়। শুধু বিহার রাজ্যের বৈশালী জেলার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লিচ্ছাভি রাজবংশটি তখনো টিকে ছিল কোনোমতে। এরপর ৩২০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্তরা ক্ষমতায় এলো।
সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের আমলে বৌদ্ধ নিধন চরমে পৌঁছাল। এমনকি লিচ্ছাভিরাও একসময় ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো। কোথায় পালাল তারা? নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা ছিল একটাই-পূর্ব-দক্ষিণে, গাঙ্গেয় উপত্যকা ধরে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে, গৌড় হয়ে বাংলার পথে, বৌদ্ধদের অভয়ারণ্য সমতট আর হরিকেল জনপদে।
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলল এ মাইগ্রেশন। অবশেষে চতুর্থ শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে বিহারত্যাগী অভিবাসীদের দীর্ঘ যাত্রা গিয়ে শেষ হলো উত্তর আরাকানে। লিচ্ছাভিরা আরাকানের মাটিতে গড়ে তুলল প্রথম নগররাষ্ট্র। পেছনে ফেলে আসা স্মৃতিবিজড়িত প্রিয় স্বদেশভূমি বৈশালীর অনুকরণে নগররাষ্ট্রটিরও নাম রাখল তারা ‘বৈশালী’। রাজা দেবেনচন্দ্রের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলো চন্দ্র বংশ।
একটি নগররাষ্ট্র বিনির্মাণে প্রয়োজন হয় বিপুল জনশক্তির। কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমার, স্থপতি, নির্মাণ শ্রমিক, সেচকর্মী, লিখিয়ে এবং আরও কত কী! কোত্থেকে আসবে এ জনশক্তি, এ স্থপতি আর স্থাপত্যবিদ্যা? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল সেকালের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ গৌড়।
সূচনালগ্নে তাই আরাকানে শুধু দুটি সম্প্রদায় বসবাস করত। বিহার থেকে পালিয়ে আসা রাখাইন সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরা এবং গৌড় থেকে নিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরা। এরপর বেশ কয়েকশ বছরের ইতিহাস-আরাকানে এ দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস। মাঝে সপ্তম শতাব্দীতে আরবরা এলো। রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। রাখাইনরা রয়ে গেল বৌদ্ধধর্মেই। তবে ধর্মের ভিন্নতা কখনই এ দুটি সম্প্রদায়ের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেনি। বরং ইতিহাসবিদদের একটি বড় অংশের ধারণা, রাখাইন রাজা মহাতাইনচন্দ্রের হাত ধরেই আরাকানে ইসলামের প্রবেশ এবং বিস্তার লাভ।
৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের রাম্বরী উপকূলে ঝড়ের কবলে পড়ে আরবদের বেশ কটি বাণিজ্যতরি বিধ্বস্ত হয়। বেঁচে থাকা আরব নাবিকরা তীরে এসে রাজা মহাতাইনচন্দ্রের কাছে সেদেশে বসবাসের অনুমতি চায়। রাজা শুধু তাদের বসবাসের অনুমতিই দিলেন না, স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে সংসার করারও অনুমতি দিলেন। শুধু শর্ত দিলেন একটাই-যদি কখনো তারা আরব দেশে ফিরে যেতে চায়, স্ত্রী কিংবা সন্তানদের নিয়ে যাওয়া যাবে না; তাদের রেখে যেতে হবে আরাকানেই। বলাই বাহুল্য, আরবরা থেকে গেলেন, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে মনোনিবেশ করলেন।
এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী আরাকানে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায় কোনো রকম বিরোধ ছাড়াই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছিল। পার্শ্ববর্তী বাংলা ভূখণ্ডের সঙ্গে ছিল তাদের নিবিড় বন্ধুত্ব, অবাধ বাণিজ্য। বার্মিজদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না আরাকানে। বস্তুত আরাকানের পূর্বদিকের বিশাল পর্বতমালা আর দক্ষিণের আন্দামান আর মারতাবান উপকূলে মানুষখেকো আদিমদের ব্যাপক উপস্থিতি এ অঞ্চলটিকে বর্তমান মিয়ানমারের ইরাবতী উপত্যকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিহার ছেড়ে পালিয়ে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে পৌঁছার পর লিচ্ছাভিদের ছোট একটি অংশ সুরমা উপত্যকা ধরে সিলেট-মনিপুর হয়ে ইরাবতী উপত্যকার উত্তরাংশে গিয়ে পৌঁছে। সেখানেও তখন পর্যন্ত বার্মিজ সম্প্রদায়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ‘পিউ’ নামের অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস ছিল সেখানে। বিহার থেকে আসা অভিবাসীরা পিউদের ব্রহ্মধর্মে দীক্ষিত করে। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ব্রহ্মধর্মে দীক্ষিত এ জনগোষ্ঠীই একসময় ব্রাম্মা এবং পরে ম্রাম্মা নামে পরিচিত হয়। ম্রাম্মা সম্প্রদায়ের নাম থেকেই একসময় ভূখণ্ডটির নাম হয়ে পড়ে ম্রাম্মাও, মিয়াম্মাও এবং সবশেষে মিয়ানমার।
বার্মিজরা প্রথম পিউ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ৮৩২ সালে। এরা আসে পশ্চিম চীনের নানচাও রাজ্য (বর্তমানে ইউনান প্রদেশ) থেকে। এরা ছিল নানচাওয়ের সাধারণ প্রজা। চীনারা এদের জানত ‘মিয়েন’ নামে। মিয়েনরা (বর্তমানে বার্মিজ) নানচাও থেকে পিউদের ওপর সংঘবদ্ধ ও সুপরিকল্পিত হামলা চালায়। ইতিহাসে নানচাও রেইড নামে পরিচিতি সেই কুখ্যাত আক্রমণে প্রায় ৩০০০ পিউ প্রাণ হারায়। পিউ ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম বার্মিজ রাজ্য ‘পাগান’। পরাজিত পিউরা দক্ষিণের দিকে সরে আসে। ইরাবতীর দক্ষিণাংশে তখন আরেকটি শক্তিশালী রাজ্য-পেগু। ধারণা করা হয়, পিউ জনগোষ্ঠী এবং সেই সঙ্গে সুদূর অতীতে বিহার ছেড়ে আসা লিচ্ছাভি বংশের উত্তরসূরিদের একটি বড় অংশ তখন উপয়ান্তর না দেখে পর্বতমালা ডিঙিয়ে আরাকানে এসে স্বগোত্রীয়দের সঙ্গে মিলিত হয়।
৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো পাগান থেকে বার্মিজদের একটি অগ্রবর্তী দল পর্বতমালা পেরিয়ে আরাকানে এসে প্রবেশ করে। তবে এ দলটির কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু লুটপাট করা। তারা সাকুল্যে আঠারো বছর আরাকানে অবস্থান করে আবারও পাগানে ফিরে যায়। এরপর পাগান থেকে আরও বেশ কটি হামলা চালানো হয় আরাকানের ওপর। যদিও কোনটিই সফল হয়নি, উপর্যুপরি হামলা এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরাকানকে বেশ দুর্বল করে ফেলে। অবশেষে একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পাগান রাজা অনুরাধা একটি সফল অভিযান চালিয়ে আরাকানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। ১০১৮ সালে এক পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে রাজা অনুরাধা পাগানে ফিরে যান। প্রায় ৬৫০ বছর ধরে স্বাধীন আরাকান এই প্রথম একটি বিদেশি রাষ্ট্রের করদরাজ্যে পরিণত হয়। তবে আরাকানের ওপর পাগানের নিয়ন্ত্রণ স্থায়ী হয় মোট ৬০ বছর।
এরপর থেকে ১২৮৭ সালে পাগান রাজ্যের পতন হওয়া পর্যন্ত পুরো ইরাবতী উপত্যকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল বেশ গোলমেলে। কোনো রাজ্যই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। বারবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। এরই মধ্যে রাজা মিন্থি আরাকানের শাসনক্ষমতায় আসেন। পাগান যখন ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, রাজা মিন্থির নেতৃত্বে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল আরাকান। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, পাগানের ধ্বংসস্তূপের ওপর ১৩৬৪ সালে নতুন করে আভা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বার্মিজদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন যে অসাধারণ বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, তিনি ছিলেন আরাকানেরই যুবরাজ মিন-ক্যী-সোয়া-স-কিইই (Min-kyi-swa-saw-kei)। তবে বার্মিজরা তাদের প্রতি আরাকানের সেই অসাধারণ আনুকূল্যের কথা স্মরণ রাখেনি।
ইরাবতীর উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যে চিরকালই সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল। যুগে যুগে উত্তরের পাগান, আভা কিংবা ইন্নোয়া রাজ্যের সঙ্গে দক্ষিণের পেগু, হংসবতী কিংবা রমনদেশ রাজ্যের সংঘাত লেগেই ছিল। ফলে দক্ষিণের সমুদ্রপথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের কোনো সুযোগ পাগান, আভা কিংবা ইন্নোয়া রাজ্যের ছিল না। সেক্ষেত্রেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আরাকান। নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বার্মিজদের বঙ্গোপসাগর হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছিল। সেটাও বার্মিজরা মনে রাখেনি। আরাকানিদের হাতে গড়া আভা রাজ্য থেকেই ১৪০৪ সালে বার্মিজরা আবারও হামলা চালায় খোদ আরাকানেই। রাজা মিন-স-মন ওরফে নরমেখলা ক্ষমতাচ্যুত হন।
বার্মিজদের কাছে বারবার প্রতারিত আরাকানরাজ ফিরে তাকান শতাব্দীর পর শতাব্দী পরিচিত, পুরোনো, পরীক্ষিত বন্ধু বাংলার দিকে। বাংলার সুলতান আহমেদ শাহের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন, নিজ রাজ্য ফিরে পেতে সামরিক সহযোগিতা চান। সুলতান বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে নরমেখলাকে তার হারানো রাজ্য ফিরে পেতে সাহায্য করেন। কৃতজ্ঞতার আতিশয্যে নরমেখলা নিজের নামটাই পালটে ফেলেন। রাজার নতুন নাম হয় সোলায়মান শাহ। সোলায়মান শাহের নেতৃত্বে আরাকানে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন রাজ্য ম্রক-উ। পরবর্তী সাড়ে তিনশ বছর (১৪৩০-১৭৮৪) ম্রক-উ তথা আরাকান নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে যেতে থাকে সমৃদ্ধির পথে।
এর মধ্যে ইরাবতী উপত্যকায় উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে, বার্মিজ ও মগ সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বহুবার। অবশেষে ১৭৫৭ সালে বার্মিজ রাজা আলোংপায়া প্রথমবারের মতো উত্তর ও দক্ষিণকে এক করে কোনবং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৮৪ সালে কোনবং রাজা বোদাওপায়া আরাকান আক্রমণ করে। দুই লক্ষাধিক মানুষ আরাকান ছেড়ে পালিয়ে আসে বাংলায়। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা যেমন ছিল, তেমনই ছিল রাখাইন। আরাকান আবারও স্বাধীনতা হারায়। আরাকানের ওপর বার্মিজদের এ বিজয়টিও স্থায়ী হয়নি। মোট ৪০ বছর পরেই ১৮২৪ সালে ব্রিটিশরা আরাকান আক্রমণ করে উপনিবেশ স্থাপন করে।
ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কে কী নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল, কিংবা স্বাধীন ইউনিয়ন অব মিয়ানমারে বার্মিজ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কূটকৌশল স্থানীয় পর্যায়ে রাখাইন-রোহিঙ্গা সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলেছিল, তা বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যায়, দীর্ঘ দুই হাজার বছরের ইতিহাসে অন্তত রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তাদের মধ্যে কখনোই জাতিগত বিদ্বেষ ছিল না। তারা ছিল পরস্পরের উন্নয়ন সহযোগী। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ দুটি সম্প্রদায় আরাকানের মাটিতে গড়ে তুলেছে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। একের পর এক তৈরি করেছে বৈশালী, ধন্যবতী, সাম্বাওয়াক, পারীন, হ-ক্রিট, লংরেত এবং তুংগু নাইনজারার মতো সমৃদ্ধ নগরী এবং সবশেষে ম্রক-উ রাজ্য।
বস্তুত রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গার কোনো সুযোগই ছিল না, কারণ তাদের মধ্যে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিল না। আরাকানের আর্থসামাজিক কাঠামোতে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিল ভিন্ন ভিন্ন স্তরে। রাখাইনরা রাজনীতি, ব্যবসা, ধর্ম ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারটা দেখত। পক্ষান্তরে রোহিঙ্গারা দেখত কৃষি, সেচ, নির্মাণ, লিপিকর্ম, শিল্প-সাহিত্য এবং সর্বোপরি নগরায়ণের বিষয়গুলো। প্রত্যেক পক্ষ তাদের নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী আরাকানের সমৃদ্ধিতে অবদান রেখে গেছে। পেশার ভিন্নতা থাকায় নিজেদের মধ্যে কখনো স্বার্থের সংঘাত হয়নি।
রাখাইন-রোহিঙ্গা সম্পর্কের কালো দিক তুলে ধরতে কেউ কেউ হয়তো ২০১২ সালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্ধৃতি দেবেন। একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, ওটা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে হয়নি। ২০১২-এর দাঙ্গার নেপথ্যে তিনটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমটি রাজনৈতিক। প্রাদেশিক নির্বাচনে রাখাইনদের ভূমিধস বিজয় ঠেকাতে জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে, যা রাখাইনদের ক্ষুব্ধ করেছে। দ্বিতীয়টি ধর্মীয়। মিয়ানমারজুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতিগোষ্ঠীগুলোকে একসূত্রে গাঁথার নিষ্ফল প্রয়াসে উগ্রবাদী ভিক্ষু-সমর্থিত সরকার তেরোবেদ বৌদ্ধধর্মের ভিত্তিতে পুরো জাতিকে এক করার চেষ্টা করে। আশ্বিন উইরাথুর মতো সন্ত্রাসী ভিক্ষুরা ইসলামকে একটি আগ্রাসী ধর্ম হিসাবে চিত্রায়িত করে মিয়ানমারজুড়ে মুসলিম নিধনকে উৎসাহিত করে। তৃতীয় কারণটি ছিল মামুলি একটি ক্রাইম। তিনজন অপরিণামদর্শী রোহিঙ্গা যুবক এক রাখাইন যুবতিকে ধর্ষণ করে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইন্ধনে যখন পুরো আরাকান তেতে আছে, এ ছোট একটি ঘটনাই তখন বিস্ফোরকের কাজ করে। জান্তার নোংরা রাজনীতি কিংবা সন্ত্রাসী ভিক্ষুদের ইন্ধন না থাকলে এ মামুলি ক্রাইমের প্রতিক্রিয়া এতটা ভয়াবহ হতো না।
রাখাইনদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইচ্ছার একটি জাজ্বল্যমান উদাহরণ হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠনের নামকরণ। রাখাইনরা যদি রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়েই আরাকানের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন চাইত, তাহলে তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের নাম ‘ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান’ না হয়ে ‘ইউনাইটেড লিগ অব রাখাইন’ হতো; আর তাদের সামরিক সংগঠনের নাম ‘আরাকান আর্মি’ না হয়ে ‘রাখাইন আর্মি’ হতো। আরাকানের নাম রাখাইন হওয়ার পক্ষে পাশ্চাত্যের ভূরিভূরি বুদ্ধিজীবীর অজস্র প্রকাশনা ও প্রচারণাকে উপেক্ষা করে রাখাইনরা দেশটিকে আজও আরাকান ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর আরাকানের ইতিহাস মানেই রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের হাজার বছরের সৌহার্দ, সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্বের ইতিহাস। অন্যদিকে এ দুটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে বার্মিজদের সম্পর্ক ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা ও নির্যাতনের।
সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়। ভারতীয়রা ব্যাপক বৌদ্ধ নিধন চালিয়ে রাখাইনদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল। চীনাদের তত্ত্বাবধানে মিয়েনরা (আজকের বার্মিজ) ম্রাম্মাদের নির্বিচারে হত্যা এবং পিউ ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করেছিল। বার্মিজ জান্তা জাতিগত নিধন চালিয়ে কয়েক মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করেছে। অন্যদিকে আরাকানের বুকে প্রথম নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে আভা রাজ্যের আগ্রাসন থেকে আরাকান পুনরুদ্ধার, ম্রক-উ রাজ্য প্রতিষ্ঠা, কোনবং রাজা বোদাওপায়ার আক্রমণের সময় দুই লাখ রাখাইন-রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া এবং সবশেষে জাতিগত নিধনের শিকার দুই মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো প্রতিটি কঠিন সময়ে আরাকানবাসীর প্রতি পরম মমতা, বিশ্বস্ততা আর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যারা, তারা আর কেউ নয়, আরাকানের দুই হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রতিবেশী-বাংলা, আজকের বাংলাদেশ। কাজেই দুই মিলিয়ন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন প্রশ্নে অন্য কারও পরামর্শে নয়, বাংলাদেশকে এগোতে হবে আরাকানের সঙ্গে হাজার বছরের পরীক্ষিত সম্পর্কের ভিত্তিতে।
ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শান্তি ও সংঘাত বিশ্লেষক
yusuf.researcher.68@gmail.com