Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকুক

Icon

ড. রাজীব চক্রবর্তী

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকুক

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হয়ে চলমান রয়েছে। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২৩ আসনে জয়ের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬২টি আসন পেয়েও সংসদের বিরোধী দলের স্বীকৃত পেয়েছে ১১টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা সংসদ শুরুর আগে দেখা করেছিলেন এবং সংসদ নেতা তাদের (স্বতন্ত্র সংসদ- সদস্যদের) জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র হিসাবে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। যদিও নবনির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য একে আজাদ কিছুদিন আগে বলেছিলেন, যদি সব স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য নিয়ে একটি মোর্চা গঠনের সুযোগ পাওয়া যায়, তবে তারা (স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা) সংসদে জাপার চেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।

বেশিরভাগ স্বতন্ত্র প্রার্থীর দলীয় পরিচয় থাকলেও দলীয় মার্কাবিহীন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উত্থান ও বিজয় অবশ্যই রাজনীতিতে নতুন কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও যথাসম্ভব অংশগ্রহণমূলক করার তাগিদে ক্ষমতাসীন দল কিছুটা দুর্বল ও নড়বড়ে প্রার্থীদের প্রথমে মনোনয়ন না দিলেও পরে মনোনয়নবঞ্চিতদের মার্কাবিহীন স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দলীয় মার্কা না পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিভিন্ন সময়ে দলীয় মার্কা পাওয়া প্রার্থীদের জোর নির্বাচনি প্রচারণার মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত করে রেখে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামও হয়েছেন। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনি এলাকায় সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। তারপরও ব্যবসায়ী একে আজাদ, সাজেদুল হক সুমন, তাহমিনা বেগমসহ অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের হেভিওয়েট প্রার্থীদের হারিয়ে নির্বাচনে বড় ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় দলীয় মার্কা ছাড়া যারা নির্বাচন করে জিতেছেন, তাদের নিশ্চয় তুলনামূলকভাবে অন্য প্রার্থীর চেয়ে একটি আলাদা ব্যক্তি ইমেজ ছিল, যার জন্য দলীয় ভোটারদের একটা অংশ ক্ষমতাসীন দলের বিগত সংসদ-সদস্যদের কার্যকলাপে নাখোশ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের আরেকটি অংশ যারা কোনো দলের না হয়েও তুলনামূলকভাবে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা জনগণের কাছে যে নির্বাচনি ওয়াদা করেছিলেন, তা পূরণ করার।

পত্রিকা মারফত আগেই জানা গিয়েছিল, বেশিরভাগ স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য বিরোধী দলে বসার বিপক্ষে। যদিও স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা একটি নির্দলীয় জোট গঠন করে তাদের বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়ার জন্য সংসদের স্পিকারের কাছে আবেদন জানানোর সুযোগ শুরুতেই হাতছাড়া করেছেন। উলটো এবার খোদ সরকারি দল থেকেই স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের সংসদে স্বতন্ত্র হিসাবে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা তাদের নির্বাচনি এলাকায় নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, যা স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী-লীগের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি উসকে দিচ্ছে। এটা পেশাদার রাজনীতিবিদদের জন্য এক ধরনের প্রচ্ছন্ন বার্তাও বটে। ব্যক্তি আর ব্যক্তি মিলে যখন ৬২ জনের মতো একটি বড় প্ল্যাটফর্ম দাঁড়ায়, তখন বোঝা যায় ব্যক্তি ইমেজে জয়ী হওয়া প্রার্থীদের ওপর ভোটাররা কতটা ভরসা রাখে। যদিও বা এ স্বতন্ত্রদের বেশিরভাগই প্রথাগত রাজনৈতিক দলের অনুসারী, তথাপি জনগণের বিশ্বাস, তারা সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যতিক্রম কিছু করবেন।

তাই স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের এখন থেকেই সজাগ থাকতে হবে তাদের নিজের কাজ সম্পকের্, যাতে করে তারা সঠিক ও জনমুখী, মিতব্যয়ী প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারেন। তাহলেই শুধু স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা তাদের স্বাতন্ত্র্য ও নিজেদের নির্বাচনি এলাকায় জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারবেন। বিগত সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা মাঝেমধ্যে তির্যক বক্তব্য দিয়ে সরকারের কাজের সমালোচনা করতেন। বস্তুত সমালোচনা করা এবং সমালোচনা করে সরকারি দলকে ব্যতিব্যস্ত রাখা (যা জাতীয় পার্টি করতে পারেনি) দুটো দুই বিষয়।

সংসদে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য কীভাবে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা শুধু সংসদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হলেই বোঝা যাবে। যেহেতু স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা কোনো জোট গঠন করতে পারেননি, তাই বিক্ষিপ্তভাবে কোনো কিছুর বিরোধিতা (যদি করেন) আদতেই সরকারের কাজের জবাবদিহিতা কীভাবে নিশ্চিত করবে তা শুধু সময়ই বলবে। সরকারি দলের হয়েও সংসদে সরকারের অংশ হতে না পারা, স্থানীয় রাজনীতিতে মার্কার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্থানীয় নেতাদের বিরাগভাজন হওয়া-এসব কারণে স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের সামনে তাই এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন বরাদ্দ আনতে না পারলে নির্বাচনি এলাকার উন্নয়ন আটকে যেতে পারে। আবার গড্ডালিকা প্রবাহের প্রচলিত রাজনীতিতে চললে এখন অনেকটা দলের বহিরাগত হিসাবে পরিচিতি পাওয়া স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের দলীয় রাজনীতির জোয়ারে হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। বিপরীতে ভালো কাজ করে জনগণের মন জয় করার পাশাপাশি সংসদে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারলে সরকারের নজরে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই বড় বড় দলের মুখাপেক্ষী না হয়ে একা নির্বাচন করে এ বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা যে ভিন্ন ধারার রাজনীতির চর্চা শুরু করেছেন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তারা যেন জনগণের কাছে রোল মডেল হওয়ার সুযোগ না হারান, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা।

ড. রাজীব চক্রবর্তী : গবেষক ও লেখক

keralamphil@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম