মিয়ানমার পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি ফেরানোর সুযোগ নেই
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মিয়ানমার বর্তমানে একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনের অন্তত ৬০ শতাংশ আরাকান আর্মির (এএ) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে এবং পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনসহ মিয়ানমারের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তাদের হামলার তীব্রতায় টিকতে না পেরে জান্তা সেনারা একাধিক স্থান থেকে পালিয়ে গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ রাজ্যের দখল নিতে সেখানে সংগঠিত হচ্ছে জান্তা বাহিনী। আরাকান আর্মি অপারেশন ১০২৭-এর অংশ হিসাবে গত ১৩ নভেম্বর রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এএ ২০২২ সালের নভেম্বরে জান্তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে রাখাইনে সেনাবাহিনীর ওপর এ আক্রমণ চালায়। ১৬ নভেম্বর এএ’র যোদ্ধারা রাখাইন রাজ্যের পাউকতাও শহরের পুলিশ স্টেশন দখল করে নেয়। ২১ নভেম্বর জান্তার অবস্থানে আক্রমণ চালায় এএ এবং পাউকতাও শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ৩ জানুয়ারি দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপের চিন লেট ওয়াতে জান্তা ফাঁড়ি দখলে নেয় এএ। ৬ জানুয়ারি তারা কিয়াউকতাউ টাউনশিপের বড় তাউং শায় তাউং ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় এবং একটি জান্তা ফাঁড়ি দখল করে নেয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ৭ জানুয়ারি রাখাইন রাজ্যের চকপিউ টাউনশিপের দানিয়াওয়াদ্দি নৌঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়, ৮ জানুয়ারি চকপিউ টাউনশিপসংলগ্ন রামরি শহরেও সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৪ জানুয়ারি এএ চিন রাজ্যের পালেতোয়ার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং একাধিক সামরিক ফাঁড়ি দখল করে। ১৫ জানুয়ারি রাথেডাং টাউনশিপেও সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৬ জানুয়ারি জান্তা গানবোট থেকে বোমার আঘাতে মিনবিয়া টাউনশিপের একটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ১৪ জানুয়ারি এএ মংডু শহরে একটি ঘাঁটি দখল করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করে। তারা রাখাইন রাজ্যের চকপিউ সমুদ্রবন্দর প্রকল্প এলাকায় নভেম্বর থেকে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এএ প্রতিবেশী চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহর এবং উত্তর রাখাইন ও পালেতোয়া টাউনশিপের ১৬০টিরও বেশি সামরিক জান্তা ঘাঁটি ও ফাঁড়ি দখল করেছে।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স জানিয়েছে, রাখাইনের ছয়টি শহরের দখল নিয়ে জান্তা ও এএ’র মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়েছে, এএ দানবতীতে নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টারেও হামলা চালিয়েছে। এই হেডকোয়ার্টারটির কাছে চীনের একটি বৃহৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। নৌবাহিনীর স্থাপনায় হামলার পর একটি গানবোট আশপাশের অঞ্চলে নির্বিচারভাবে গোলাবর্ষণ করেছে। রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ের মিনবায়া এলাকার চারটি ঘাঁটিতে নতুন করে ৮০০ সেনা এসেছে। রাখাইনে জান্তাবাহিনীর কাছে সাগরপথে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে। এতে বোঝা যায়, জান্তার সহজে রাখাইন হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছা নেই এবং সংঘর্ষ আরও দীর্ঘায়িত হবে।
এএ কালাদান নদীর তীরে অবস্থিত বন্দরনগর পালেতোয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শহর। সামরিক জান্তার সঙ্গে এএ’র চলমান সংঘর্ষ নতুন মাত্রা লাভ করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের রামরি শহরে বোমারু বিমান দিয়ে এএ’র ওপর হামলা চালায়। রাখাইনের বুচিডং ও ফুমালিতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের কারণে রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। সংঘর্ষ চলাকালীন অনেক সময় রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। রাখাইনের চলমান সংঘর্ষে রোহিঙ্গাদের বসতিতে নিয়মিত অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এএ’র সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে এমন সন্দেহ থেকে হেলিকপ্টারে অনবরত গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রাখাইনে এএ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের ভেতরে বেশকিছু মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ছে এবং সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির আওয়াজে স্থানীয়রা আতঙ্কে রয়েছেন। গোলার আঘাতে দুজনের মৃত্যুও হয়েছে।
২০২২ সালের অগাস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। তখন অনেক মানুষ আতঙ্কে সীমান্ত ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশ সেসময়ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশে যেন এর প্রভাব না পড়ে সেজন্য আমাদের সীমান্তরক্ষীদের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং তারা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানা গেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সীমান্ত এলাকাজুড়ে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন সংঘাত চলমান থাকায় সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার আছে এবং সীমান্তের কাছাকাছি সংঘর্ষ চলার কারণে তা আরও জোরদার করা হয়েছে। অনেকের মতে, মিয়ানমারে ফেরা বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি রাখাইনকে দ্রুত রোহিঙ্গাশূন্য করতে রোহিঙ্গা বসতিতে হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
২৬ জানুয়ারি আরাকান আর্মি রাখাইনের বন্দরনগরী পকতাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ম্রাউক উ, মিনবিয়া, কিয়াকতো ও রাথিডং শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু করে। কিয়াকতো সেনাবাহিনীর নবম কমান্ডের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এএ’র সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর লড়াইয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইনের কয়েক হাজার অধিবাসী রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে। ২৬ জানুয়ারি রাখাইনের বুচিডং ও ফুমালি এলাকায় এএ ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয় ও সমগ্র রাখাইনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের মংডু ও বলিবাজার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অবস্থান করছে রোহিঙ্গারা। কিছু রোহিঙ্গা ডিঙি নৌকা করে নাফ নদীতে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ না করে, সেজন্য বাংলাদেশ সতর্ক ও প্রস্তুত রয়েছে। উল্লেখ্য, আরাকানে এখনো পাঁচ থেকে ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে।
বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে থাকা মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) প্রায় সবকটি ক্যাম্প বিদ্রোহী গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে এবং বাকি কয়েকটি দখলের চেষ্টা চলছে। আরাকান আর্মি ২৮ জানুয়ারি রাখাইন রাজ্যের মিনবিয়া শহরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩৮০ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর দখলে নিয়েছে। আরাকান আর্মি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জান্তার এএ’র সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্য নেই। তারা এখন আর্টিলারি ও মর্টার হামলার পাশাপাশি বিমান হামলা চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, জান্তার ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বার্ষিকী সামনে রেখে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান শুরু করেছে। জান্তা একযোগে বিমান, নৌ ও স্থল অভিযান চালানোর পর ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও এএ’র মধ্যে সংঘাত বন্ধে অস্ত্রবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করছে চীন। অস্ত্রবিরতি হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবার আলোচনার পথ সুগম হবে বলে জানিয়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। মিয়ানমারে জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী যারাই ক্ষমতায় থাকুক, বাংলাদেশের ফোকাস হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। জান্তা সরকার বা বিদ্রোহী, কারও পক্ষে বাংলাদেশ অবস্থান নেয়নি। এ ইস্যুতে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকায় আছে। এ নিরপেক্ষতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র জোরালো করার সম্ভাবনা তৈরিতে সহায়ক হবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়, তারা ২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে সমাবেশ করে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানায়। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে রোহিঙ্গারা একজোট হয়ে মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়।
রাখাইন রাজ্যটি ভূ-কৌশলগত কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ কারণে জান্তা বাহিনী এ রাজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পুনরায় আক্রমণ শুরু করেছে এবং তা চালিয়ে যাবে। আরাকান আর্মিও এ রাজ্যে সক্রিয় এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ চলবেই। এ প্রেক্ষাপটে রাখাইনে শিগ্গিরই স্থিতিশীলতা আসার সম্ভাবনা কম। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সব পক্ষকে আরাকান আর্মি এবং জান্তা উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে হবে। এ অঞ্চলে জাপান ও চীনের স্বার্থ রয়েছে এবং আশা করা যায় চীন এ রাজ্যের স্থিতিশীলতায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এর আগে জাপানের মধ্যস্থতায় বেশকিছু সময় এখানে আপাত শান্তি বিরাজ করছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্তে সতর্ক থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং শান্তি ফিরে আসার পর প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুতে এখন থেকেই সবাইকে নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ রাখাইন রাজ্য এবং মিয়ানমারে স্থায়ী শান্তি ফিরে আসুক-এটাই চায়।
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক