মার্কিন-চীন বাণিজ্য দ্বৈরথ ও বাংলাদেশ
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যসংক্রান্ত কমিটি গঠনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত তার এক খোলা চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রকে এ মর্মে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন যে, বহির্বিশ্বের জন্য চীনের দুয়ার খোলা থাকবে। বাজারমুখী ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করা হবে। মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে আরও বেশি সুবিধা পাবে। (প্রথম আলো, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩)। ধারণা করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশকিছু দিন ধরেই চীনের বিরুদ্ধে অন্তর্মুখী বা রাষ্ট্রমুখী কিংবা রক্ষণশীল ধারার অর্থনৈতিক নীতি বহাল রাখার যে অভিযোগ করে আসছিল, এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট বস্তুত তারই জবাব দিলেন। তার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে চীন-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ক সাময়িক হলেও কিছুটা উন্নত হবে বলে অনুমান করা যায়। তবে সেটি কী মাত্রায় হবে এবং কতদিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তদুপরি এ বক্তব্য তাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত কিনা, সেটি বোঝার জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, শি জিন পিংয়ের ওই বক্তব্যের আলোকে চীন সত্যি সত্যি তার অর্থনৈতিক নীতিকাঠামোতে কতটুকু সংস্কার আনবে এবং এর বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী দাঁড়াবে তা দেখার জন্য আগামী কিছুদিন দু’দেশই পরস্পরের দিকে সতর্ক নজর রাখবে। আর ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ দুটির মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ পরিসরে হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসার যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়েও আশাবাদী হওয়ার বাস্তব কারণ রয়েছে। অবশ্য সে পরিবর্তনের কারণে তাদের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে তেমন কোনো হেরফের ঘটবে না, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে দেশ দুটির মধ্যকার বিরাজমান উত্তেজনা প্রশমনে এ উদ্যোগ শিশিরবিন্দুর মতো স্বল্পস্থায়ী জলকণা হয়ে হলেও কিছুটা ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বর্তমানে যথেষ্ট মাত্রায় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিরোধ থাকলেও এরাই আবার পরস্পরের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার। ফলে কথার ও কূটনীতির বাদানুবাদে এরা যত সরবই থাকুন না কেন, এদের কারও পক্ষেই কাউকে ছেড়ে বা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তারপরও যে এতটা বাদানুবাদ, তার খানিকটা কূটনৈতিক কৌশল আর বাকিটা পরস্পরের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ব্যবসায়িক দরকষাকষি। আর সে দরকষাকষিতে কে কাকে কতটা ছাড় দেবে বা কে কার ওপর কতটা বিজয়ী হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থা ও সংশ্লিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। ধারণা করা যায়, শি’র এ বক্তব্যের সূত্র ধরে একদিকে চীনে কর্মরত মার্কিন কোম্পানিগুলো সেখানে বাড়তি নীতিগত সহায়তা (বিশেষত কর ও শুল্ক) লাভের ব্যাপারে যেমন সচেষ্ট হবে, অন্যদিকে চীনে বিনিয়োগ নেই এরূপ মার্কিন কোম্পানিগুলোও তেমনি সেখানে নতুন করে বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহ দেখাবে।
কোনো মার্কিন কোম্পানির চীনে নতুন করে বিনিয়োগের অর্থ হচ্ছে, চীন তাদের কাছে নিজেদের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও অন্যান্য সামগ্রী ও উপকরণ বিক্রির সুযোগ পাবে, বিপুলসংখ্যক চীনা কর্মীও সেখানে কাজ করার সুযোগ পাবে, যা দেশটির কর্মসংস্থান পরিস্থিতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। আবার চীনে বিনিয়োগকারী মার্কিন কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিদেশে রপ্তানির মধ্য দিয়ে চীনের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার বাড়তি স্ফীতি পাবে বলেও ধারণা করা চলে। তাছাড়া এসব পণ্যের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি হবে বলে আশা করা যায় এবং সেই সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যও অনেকাংশে চীনের অনুকূলে যাবে বলেও ধারণা করা যেতে পারে। অধিকন্তু এসব কোম্পানির যেসব পণ্য অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে, সেসব দেশের সঙ্গেও চীনের বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যে চীন বহুলাংশে এগিয়ে থাকবে।
এবার আসা যাক চীনা অর্থনীতির সাম্প্রতিক পটভূমি ও সেই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট শি’র ঘোষণার সূত্র ধরে চীনের অর্থনৈতিক নীতিমালায় আনীতব্য উদারীকরণ উদ্যোগগুলোর ফলে চীনের আমদানি বাণিজ্য কতটা প্রসারিত হতে পারে সে প্রসঙ্গে। বস্তুত এখানেই নিহিত রয়েছে চীনের অন্তর্মুখী বা রাষ্ট্রমুখী বা রক্ষণশীল অর্থনৈতিক নীতিমালার মাহাত্ম্য। আর সেটাই এখানে সামান্য খোলাসা করা যাক। চীন প্রসঙ্গে এটা মোটামুটি সবারই কম-বেশি জানা যে, ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ও সেপ্টেম্বরে চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পরই বস্তুত চীনে সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ের অবসান ঘটে এবং মাও-উত্তর চীন ক্রমান্বয়ে কিছুটা উদারপন্থার দিকে এগিয়ে যায়। আর সে যাত্রায় দেং জিয়াও পিংয়ের (পরবর্তীতে বানান সংশোধিত হয়ে তেং শিয়াও পিং) আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্বের অধিষ্ঠান ঘটে ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। দেং জিয়াও পিং ও তার অনুসারীদের এ নয়া যাত্রায় দেশটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির ব্যাপক যোগাযোগ গড়ে ওঠে, যা ছিল তাদের জন্য সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা। তবে ভালো-মন্দ মিলিয়ে সে অভিজ্ঞতা তাদের বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সাহস তৈরি করে দেয়। যে প্রস্তুতি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটি বিশেষ ধারায় পরিচালিত হতে থাকে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিই এককেন্দ্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রূপ নিলে এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসাবে অনেকটা বাধ্য হয়েই চীনকেও আরেক দফা বাণিজ্য উদারীকরণের পথে হাঁটতে হয়। যেটিকে মাও-উত্তর চীনা রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বিতীয় পর্যায় হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে এবং সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। বস্তুত এ ধারার আওতাতেই চীন কেন তার অভ্যন্তরীণ বাজার ও বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যবস্থায় আরও নমনীয়তা আনছে না, সেটাই তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অভিযোগ। খোদ মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন সম্প্রতি চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তারা যেন অর্থনীতির রাষ্ট্রমুখী প্রবণতা থেকে সরে আসে। আর এখানটাতেই বাজার অর্থনীতির ভেতরে বসবাস করেও চীনকে কৌশলী ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বজায় রাখার কৃতিত্ব প্রদান করতে হয়; যা থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
চীন ২০০১ সাল থেকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এবং এর ফলে তারা ডব্লিউটিও’র সব অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য হলেও অত্যন্ত সুকৌশলে সে তার রাষ্ট্রমুখী অর্থনৈতিক কাঠামো ও নীতিমালা বজায় রেখে চলেছে। এবং সে কারণেই এ সময়ের মধ্যে তার দেশজ শিল্প ও উৎপাদন ঈর্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্থানীয় শিল্প ও বাজারকে অনাকাঙ্ক্ষিত বহিঃপ্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়নি। আর এরই মধ্যে দেশটি তার মৌলিক শিল্পের ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত করে ফেলার পর এখন যদি মার্কিনি অনুরোধ ও আহ্বানে কিংবা ডব্লিউটিও’র অনুশাসন মেনে চীন যদি তার বাজার পুরোপুরিও উন্মুক্তও করে দেয়, তাহলেও সে বৈশ্বিকভাবে প্রতিযোগিতা করে দাপটের সঙ্গেই টিকে থাকতে পারবে। অন্যদিকে এ পর্যায়ে এসে নীতি-উদারীকরণের ফলে চীনে যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পায়, তাহলে সে বিনিয়োগের সুবাদে সেখানে তাদের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্যের বিক্রয়ই শুধু বাড়বে না-বেড়ে যাবে পণ্য উৎপাদনও, যার সূত্র ধরে বাড়বে রপ্তানিও। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনের ভারসাম্য নিজেদের অনুকূলে রেখে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে এর চেয়ে উত্তম কৌশল আর কী হতে পারে!
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, চীনের ওই কৌশলী অর্থনৈতিক নীতির তাৎপর্যটিই বাংলাদেশ কখনো বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারেনি। এ দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকরা ১৯৯০ দশকের গোড়া থেকেই বাজার অর্থনীতির দুর্বোধ্য খপ্পরে পড়ে ক্রমাগতভাবে ভ্রান্তনীতির আওতায় দেশের অর্থনীতিকে পরিচালনা করে আসছেন। বস্তুতই তারা বাজার অর্থনীতির ভালো-মন্দকে ঠিকমতো বোঝার ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জ্ঞান, সামর্থ্য ও দক্ষতা কোনোটাই দেখাতে পারেননি। ডব্লিউটিও, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পরামর্শে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে তার বাজারকে এতটাই যুক্তিহীনভাবে উদার করে দিয়েছে, যার কারণে স্থানীয় শিল্প এখানে আর কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আর এসব উদারতার মধ্যে রয়েছে ঢালাও হারে শুল্ক হ্রাস, আমদানি নিরুৎসাহিতকরণ ও নিষিদ্ধকরণ তালিকা সংক্ষিপ্ততম পর্যায়ে নিয়ে আসা, বৈদেশিক বিনিয়োগনীতিতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য বিন্দুমাত্র কোনো বাড়তি সুযোগ অবশিষ্ট না রাখা ইত্যাদি। তদুপরি শিল্পনীতিতে সেবামূলক কার্যক্রমকে শিল্প (ম্যানুফেকচারিং) হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে সেসবকেও সমসুবিধা দিয়ে স্থানীয় শিল্পকে বেকায়দায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, যা চীন করেনি।
মোটকথা, মাও সে তুং অনুসৃত অতিরক্ষণশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে দেং জিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে ১৯৭০ দশকের শেষার্ধ্বে আধা-মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া-উত্তর সময়ে ১৯৯০ দশকের গোড়াতে আধা-মুক্তবাজার থেকে পরিপূর্ণ মুক্তবাজার ব্যবস্থায় যোগদানের পরও চীন কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সঙ্গে রাষ্ট্রমুখী ও অন্তর্মুখী চেতনার আলোকে দক্ষতার সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর তারই সুফল হিসাবে চীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। কিন্তু ১৯৯০ দশকের গোড়া থেকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গেলেও তাদের অর্থনৈতিক নীতি-পরিকল্পনা ও কাঠামো দেখে বাংলাদেশ বলতে গেলে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে পারেনি। বরং জ্ঞান ও ধারণার পরিপক্বতার অভাবে এ দেশের অর্থনৈতিক নীতিপ্রণেতারা কখনো অতিউৎসাহের বশে, আবার কখনো বা সংকীর্ণ লোভ-লালসায় পড়ে প্রায় ১৮ কোটি ভোক্তার এ দেশটিকে বিদেশি পণ্যের বাজার হিসাবে গড়ে তুলেছেন-পণ্যের উৎপাদক বানাতে পারেননি।
এখন বাংলাদেশ হয়তো বলবে, একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র থেকে বাজার অর্থনীতির দিকে মুখ করা চীনের পক্ষে যা সম্ভব ছিল, একটি অ-সাম্যবাদী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের পক্ষে সেটি সম্ভব ছিল কিনা। বলতে হয়, বাংলাদেশের পক্ষে তা আরও বেশি করে সম্ভব ছিল। কারণ বাংলাদেশ সাম্যবাদী রাষ্ট্র না হলেও ১৯৯০ দশকের গোড়াতে সে যখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে, তখন এটি ছিল অনুন্নত দেশের তালিকায় এবং এসব দেশের জন্য ডব্লিউটিওসহ অন্যান্য সংস্থা ও দেশের পক্ষ থেকে ব্যাপক ছাড় ছিল। আর সে ছাড় সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে অন্তর্মুখী বা রাষ্ট্রমুখী অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ খুবই সম্ভব ছিল; কিন্তু বাংলাদেশ সেটি গ্রহণতো করেইনি, বরং অতিউৎসাহ দেখিয়ে শুল্ক উদারীকরণের ক্ষেত্রে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকেই ব্যাপক দূরত্বে ছাড়িয়ে যায়। আর এখন তো বাংলাদেশ আর অনুন্নত দেশের তালিকায় নেই। তারপরও নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও দুর্বলতার বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে এখনো রাষ্ট্রমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি উদ্যোক্তাদের অতিউৎসাহ নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে সীমিত পর্যায়ের কর্মসংস্থান ব্যতীত বাংলাদেশ কি আর কোনোভাবে তেমন একটা লাভবান হতে পেরেছে, যেমনটি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও দক্ষ শ্রম বিক্রি করে হতে পেরেছে চীন?
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যসংক্রান্ত কমিটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শি জিন পিং যুক্তরাষ্ট্র ও বহির্বিশ্বের উদ্দেশে যে বার্তা তুলে ধরেছেন, সেটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কাছে ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু এ পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত চীন যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ কি নিজেদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে একটি উৎপাদন-শিল্পনির্ভর টেকসই স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করার লক্ষ্যে সেদিকটির প্রতি মনোযোগ সহকারে তাকাবে? সে ক্ষেত্রে সবকিছুই চীনের মতো হতে হবে-এমনটি অবশ্যই নয়। কিন্তু তাদের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা যে বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই ফলদায়ক হতে পারে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ শুধু চীনের কাছ থেকে ঋণ, পণ্য, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল ধার নেবে; কিন্তু লাভজনক ধারণা ও অভিজ্ঞতা গ্রহণ করবে না-এটি কোনো দূরদর্শিতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও অর্থনীতির চিন্তকরা কি তাহলে বহুলাংশে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সংকটের ভেতর দিয়েই যাচ্ছেন?
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)