১০ জানুয়ারি ১৯৭২। বাংলার নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসছেন। এ এক অন্যরকম অনুভূতির দিন। পুরো জাতির স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার দিন। কখন আসবেন কবি! সেদিন বাতাসে ছিল মুক্তির বারতা। সুদীর্ঘ নয় মাস ধরে অপেক্ষমাণ বাংলামাতা আদরের খোকাকে কাছে পাবে জেনে ছলছল চোখে অধীর উন্মাদনার প্রহর গুনছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ২৫ মার্চ ঘুমন্ত, নিরস্ত্র, নিরপরাধ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু করে নির্বিচারে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সেই রাতেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে রাত ১টা ৩০ মিনিটে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। গ্রেফতার হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন : ‘This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must be go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’ (এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে)।
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর প্রথমে ঢাকার আদমজী স্কুলে এবং পরে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে আটক রাখা হয়। ঢাকায় গ্রেফতারের তিনদিন পর ২৯ মার্চ তাকে বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বন্দি। এজন্য তাকে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণের বিষয়েও তারা কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুকে পাঞ্জাবের লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) জেলে অপরিসর একটি কুঠুরিতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে মিয়ানওয়ালি জেলে।
পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবকে ভয় দেখিয়ে আপস করতে বাধ্য করা এবং তার মুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের অন্য নেতাদের মীমাংসায় আসতে চাপ দেওয়া। বিশ্বব্যাপী এই বিচার-প্রহসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। পাকিস্তান সরকার নিজেই উদ্যোগী হয়ে তার আইনজীবী হিসাবে নিয়োগ দেয় এ কে ব্রোহিকে। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে মানসিক চাপে ফেলার জন্য জেলখানার সেলের পাশে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। রায় নির্ধারিত বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃপক্ষকে বললেন, ‘আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও।’
ত্রিশ লাখ বাঙালি শহিদ আর দুই লাখ মা-বোন নির্যাতিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। ভুট্টো বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবের কিছু হলে বাংলাদেশে বন্দি পাকিস্তানি সৈন্য, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের অনুগতরা সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। ভুট্টো ১৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে সাক্ষাৎ করেন। প্রথম সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, ‘আমি মুক্ত কিনা বলুন।’ ভুট্টো বলেন, ‘আপনি মুক্ত, কিন্তু আমি আপনাকে যেতে দেওয়ার আগে কয়েকদিন সময় চাই।’ ২৬ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে হেলিকপ্টারে করে সিহালা অতিথি ভবনে নিয়ে আসা হয়। পরদিন ভুট্টো সেখানে এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে মুক্তির সংবাদ দেন।
৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তৃতীয় এবং শেষবারের মতো দেখা করতে যান। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, ‘হয় আমাকে মুক্ত করুন, নয় হত্যা করুন।’ দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তান জঙ্গিশাহির জিন্দাখানার অন্ধ প্রকোষ্ঠে নারকীয় বন্দি জীবনযাপনের পর বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মণি, নিপীড়িত জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি মুক্তি পান। পাকিস্তান সরকারের চার্টার্ড করা একটি বিশেষ সামরিক বিমানে (বোয়িং ৭০৭) গোপনে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লন্ডনে সময় তখন ভোর ৬টা ৩৬ মিনিট এবং বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিট। বিশেষ বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ না করা পর্যন্ত ঢাকা অথবা নয়াদিল্লি কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর গন্তব্য সম্পর্কে কিছুই জানত না।
৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’ বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানকার ভিআইপি লাউঞ্জে। সেখানে ছিলেন ইয়ান সাদারল্যা›ড। তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারত বিভাগ দেখতেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমি বেঁচে আছি। আমি সুস্থ রয়েছি। এ মুহূর্তে আপনারা শুধু আমাকে দেখুন, কোনো কিছুই শোনার আশা করবেন না। তাই এখন আর বেশি কিছু বলতে চাই না।’ সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসাবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্লারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট।’ ৮ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে যান। বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন এবং তাকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী, ওইদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তার কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২। স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ২টা ৫০ মিনিট)। এরপর ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর শ্বেতশুভ্র বিমানটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করে। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি হয়েছিল। প্রায় কালো-ধূসর স্যুট এবং কালো ওভারকোট পরিহিত বঙ্গবন্ধুকে বিমান থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথমে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে তাদের আলাপ-আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু রওয়ানা হন ঢাকার উদ্দেশে। বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা জানান ভারতের সরকার, নেতাদের এবং জনগণের কাছে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এবং যুদ্ধে প্রশিক্ষণ ও সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য। সেদিন অসাধারণ আবেগময় কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-
বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় তুমি আজ
ঘরে ঘরে এত খুশি তাই।
কী ভালো তোমাকে বাসি আমরা, বলো কী করে বোঝাই।
এদেশকে বলো তুমি বলো কেন এত ভালোবাসলে,
সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের এত কাছে কেন আসলে,
এমন আপন আজ বাংলায় তুমি ছাড়া কেউ আর নাই
বলো, কী করে বোঝাই।
শ্বেতশুভ্র ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট বিমানে করে ১০ জানুয়ারি যিনি বঙ্গবন্ধুকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের পাইলট মি. কুক। স্কোয়াড্রন লিডার কুকের কাছে ঢাকা অবতরণের পর এই বিমানযাত্রা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘আমি গত ১৭ বছর ধরে বিমান চালাই। প্রিন্স আলেকজান্ডার, এলিজাবেথ থেকে শুরু করে বহু বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে আমি আমার প্লেনে যাত্রী হিসাবে পেয়েছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে আমার যাত্রী হিসাবে পেয়ে আমি গৌরববোধ করেছি।’ তার ভাষায়-‘Sheikh Mujib is a Great Man’.
১০ জানুয়ারি সকাল থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধ মানুষ আর মানুষ। বাংলাদেশ বেতার থেকে ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছে। সবার চোখেমুখে উত্তেজনা। বাঙালির মহান নেতা ফিরে আসছেন আজ ২৯১ দিন পর জন্মভূমির কোলে, প্রাণের মানুষের কাছে। লাখো মানুষের ভিড় রাজপথজুড়ে। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ। বঙ্গবন্ধু লন্ডন ও দিল্লি হয়ে প্রাণের শহর ঢাকায় ফিরে আসেন বেলা ১টা ৫১ মিনিটে। যে দেশ এবং যে স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন তিনি, সেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন বঙ্গবন্ধু। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান জানানো হয়। সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।
এরপর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে তিনি রেসকোর্স ময়দানে এসে পৌঁছান। প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। স্বদেশের মাটিতে পা রেখে বাংলার মানুষের এ ভালোবাসা দেখে মানবতার প্রতিমূর্তি, জনদরদি বঙ্গবন্ধু আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন, আনন্দ-বেদনার অশ্রু ঝরলো তার দুচোখ বেয়ে। বেলা ৪টা ২৫ মিনিট। রেসকোর্স ময়দানে ৩৫ মিনিট জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু, যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত মন্ত্রমুগ্ধ জনতা দুহাত তুলে সেই সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন : পুলিশ সুপার, নৌপুলিশ
abdullah0781@yahoo.com