শিক্ষায় রূপান্তর বহুমুখী দক্ষতার ইঙ্গিত
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার ও ড. মো. বিল্লাল হোসেন
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষাক্রম সব সময়ই একটি চলমান এবং পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। পরিবর্তনশীল বিশ্বের চাহিদা এবং জাতীয় প্রয়োজনীয়তার নিরিখে কাঙ্ক্ষিত ও যোগ্য জনবল তৈরির জন্য সময়ের সঙ্গে শিক্ষাক্রম পরিবর্তিত হয় এবং এভাবেই সময়োপযোগী কর্মক্ষমযোগ্য নাগরিক তৈরি হয়। ভবিষ্যতের প্রয়োজনে নতুন প্রজন্ম তৈরির জন্য বিদ্যমান শিক্ষাক্রমের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে যারা পাঠক্রমের যুগোপযোগী পরিবর্তন করতে পারে, তারাই এগিয়ে যায়। শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সমস্যার বহুমুখী সমাধান করে জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করা। শিক্ষা জীবন-ঘনিষ্ঠ হলে ব্যক্তি ও সমাজ উন্নত হয় এবং রাষ্ট্র এগিয়ে যায়। শিক্ষাক্রমের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর জীবনে কোন ধরনের আচরণিক পরিবর্তন ঘটাতে চাই তা ঠিক করতে হয়। বর্তমানকে সফলভাবে মোকাবিলা করে ভবিষ্যতের অগ্রগতির জন্য শুধু জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন অর্জিত জ্ঞানের প্রায়োগিক দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সঠিক মূল্যবোধ অর্জন, যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি, সহযোগিতার মনোভাব তৈরি, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া, সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করতে পারা, সমস্যার বহুমাত্রিক তথা সহজ, সাশ্রয়ী, টেকসই সমাধান দিতে পারা, সেই সঙ্গে নৈতিকতার উন্নয়ন, এসব কিছুই অর্জন করা সম্ভব রূপান্তরিত শিক্ষাক্রমের বদৌলতে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতছানিতে যখন সব গতানুগতিক পেশা হুমকির সম্মুখীন; পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থার এ সময় দক্ষ প্রজন্ম গড়তে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তনেও সবাই একমত। তবে এ পরিবর্তন যথাযথ কিনা, একবারে কতটুকু পরিবর্তন হতে পারে, পরিবর্তন বাস্তবায়নের সক্ষমতা, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ইত্যাদি বিষয়ে অনেকের মনে যেসব প্রশ্নের উদ্বেগ হয়েছে তা সময়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অনেকে মনে করেন আগে অবকাঠামো উন্নয়ন করে, শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে, শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক সম্মান বৃদ্ধি করার মাধ্যমে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নসহ বিদ্যমান শিক্ষার মান উন্নয়ন করে তবেই পরিবর্তনে হাত দিতে হবে। আর এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন বাজেটে শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এভাবেই পরিবর্তন এনে সুফল পেয়েছে। অন্যদিকে একবারে শিক্ষাক্রমের ব্যাপক পরিবর্তন করে সফল হওয়া দুরূহ। তবে পরিবর্তনের সুফল পেতে হলে সবদিক থেকে সমহারে পরিবর্তন হওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্ক যুক্ত বলে আংশিক পরিবর্তনে প্রকৃত পরিবর্তন হয় না। তাই অল্প করে হলেও এবারের শিক্ষার সব উপাদান বা নির্দেশকগুলো একসঙ্গে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা অতীতে করা হয়নি। তাই এবারের পরিবর্তনকে শিক্ষার রূপান্তর বলা হচ্ছে। শিক্ষাক্রমের আংশিক পরিবর্তনের কারণে আগের পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে পরিপূর্ণ সফলতা আসেনি। এর মূল কারণ ছিল শত বছরের পুরোনো নম্বরভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতির মুখস্থ নির্ভর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। ওই নিয়মে শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করে শিক্ষার্থীরা যে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হতে পারবে না, এ কথা বুঝতে কারও আর বাকি নেই।
আসলে তাত্ত্বিক জ্ঞান যোগ্যতার একটি খণ্ডিত অংশ মাত্র। মুখস্থ করা এ তাত্ত্বিক জ্ঞান পরীক্ষার খাতায় লিখে সংখ্যা প্রতীকে নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থী মূল্যায়নের একটি পদ্ধতি মাত্র, যা শত শত বছরের পুরোনো। কিন্তু মূল্যায়নের আরও নানাবিধ আধুনিক উপায় রয়েছে বর্তমান রূপান্তরিত পদ্ধতিতে। যেমন অনুসন্ধানের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, সমস্যা নিরূপণ ও সমাধান, রিপোর্ট তৈরি ও উপস্থাপন, হাতে-কলমে কাজ, বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন, চিন্তাশীল মনোভাব তৈরির চর্চা ইত্যাদি। কাজেই পরীক্ষা না থাকলে লেখাপড়ার আর কিছুই থাকল না, এ ধারণা সঠিক নয়। বরং নম্বরভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতিই শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রধান অন্তরায়, এ কথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়। আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বে নতুন শিক্ষাক্রম বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের পরিবর্তে সংকুচিত হবে বলে মনে করছেন অনেক অভিভাবক। বিপরীতে শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তথা সমাজে বিদ্যমান চারপাশের সমস্যাগুলো মিশ্র উপাদান সংশ্লিষ্ট এবং এগুলো সমাধানের জন্য দরকার বহুমুখী জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। এ জন্য একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সব ধরনের জ্ঞানের চর্চা করা দরকার। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যারা বিজ্ঞানে পড়ছে তারা একান্তই তত্ত্ব ও ল্যাবরেটরিভিত্তিক বিজ্ঞান শিক্ষা পাচ্ছে। প্রাত্যহিক জীবনের কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা কিংবা মডেল তৈরিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সক্ষম হয় না। প্রকৃতপক্ষে এসব তত্ত্ব ও ল্যাবভিত্তিক জ্ঞানও মুখস্থ বিদ্যারই নামান্তর। ফলে আজকাল বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান।
যে কোনো মানুষই সব সময় তার বিদ্যমান অবস্থায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, পরিবর্তন মেনে নিতে চায় না। পরিবর্তনের মধ্যে সে এক ধরনের শঙ্কা বোধ করে। একইভাবে একজন শিক্ষক পাঠদান ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতিতে অনেক সাবলীল থাকেন, কারণ এটি তিনি দীর্ঘদিনে রপ্ত করেছেন। একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হয় শিক্ষকদের মাধ্যমে। কাজেই যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাছে শিক্ষাক্রমকে সহজ, সাবলীল ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজটিতে এখনো বেশ ঘাটতি আছে বলে অনেকে মনে করেন। অন্যদিকে একটি পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম যাদের (শিক্ষার্থী) ওপর প্রথম প্রয়োগ করা হয়, তাদের অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ একটি নির্দিষ্ট সময় পর শিক্ষাক্রমটি প্রত্যাশা অনুযায়ী সুফল দিতে ব্যর্থ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওই শিক্ষার্থী এবং তার পরিবার। এ জন্য অভিভাবকদের আস্থা অর্জন করাটা যেমন জরুরি তেমনি অভিভাবকদেরও ধৈর্য ধরতে হবে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার জন্য। সব শিক্ষকের হাতে বিষয়ভিত্তিক সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা টিচার্স গাইডটি (টিজি) দিতে না পারা, মূল্যায়নের ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপসটি যথাযথভাবে চালু হতে বিলম্ব হওয়া, মূল্যায়ন পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করা, শিক্ষক গাইডের (টিজি) বিকল্প বাজারে বের হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়ন সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে এবং ফলাফল সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিষ্ঠানে তাদের নিজস্ব উদ্যোগে এ ধরনের ব্যবস্থা থাকলেও সারা দেশে ছিল না। আলুভর্তা তৈরি করা, মশারি খাটানো, নিজের ঘর বা শ্রেণিকক্ষ নিজে পরিষ্কার করা এবং দোকানদার, ট্রাফিক পুলিশ কিংবা কৃষকের কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার প্রথার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী সব পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়েও কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। একইভাবে বিজ্ঞান বিষয়ের ‘সায়েন্স ফিকশন’ নিয়ে কয়েকটি সেশন দলে কাজ করে ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যদি ‘সায়েন্স ফিকশন’ লিখতে উদ্যোগী হতে পারে এবং লিখতে পারে, তাহলে এ শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে এমন পরিবর্তনই তো দরকার। সর্বোপরি পরিবর্তন যতই সঠিক ও যৌক্তিক হোক না কেন, যাদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হবে এবং যাদের ওপর তা বাস্তবায়ন করা হবে তাদের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য, উপভোগ্য, সক্ষমযোগ্য এবং ব্যবহারযোগ্য হওয়াই রূপান্তরের মূল লক্ষ্য। কোচিং ও গাইডমুক্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থা অভিভাবকদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। শিক্ষা কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রত্যেক অভিভাবকই চান তার সন্তান সহযোগিতামূলক অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মাধ্যমে দক্ষতা ও যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা অর্জন করুক, সব পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোক, দেশপ্রেমিক আদর্শ নাগরিক হয়ে বেড়ে উঠুক। এ সবই অর্জিত হওয়ার প্রবল চেষ্টা আছে রূপান্তরিত শিক্ষায়। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের চারপাশের জগৎকে উপলব্ধি করার এবং বোঝার এমন জ্ঞান পাবে যাতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং অনুমানের পুনর্মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সহায়ক হবে।
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ড. মো. বিল্লাল হোসেন : গবেষক