আয়কর রিটার্ন জমাদানে ভোগান্তির অবসান হোক
ড. অপূর্ব অনির্বাণ
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এদেশে আয়কর রিটার্ন জমাদানের ক্ষেত্রে কিছু মানুষ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হন। সততা বজায় রেখে চলতে গেলে বা কাজ করতে গেলে যেন ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়ে যায়! অথচ যারা নিয়মিত আয়কর দেন, তাদের জন্য বিষয়টা হওয়া উচিত ছিল ভোগান্তিহীন ও সহজ। আর কেউ পড়ালেখা বা গবেষণার কারণে বিদেশ গেলে তাদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া প্রায় অসম্ভব! প্রযুক্তির যুগে এটা ভাবতেই অবাক লাগে।
আয়ের সীমা বাড়ায় আয়কর রিটার্ন জমাদানকারী ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে। সাধারণত জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত অর্থবছর গণনা করা হয়। জুনের পর সাধারণত পরবর্তী পাঁচ মাসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয়। যারা দেশে থাকেন তাদের পক্ষে সেটা করতে তেমন সমস্যা নেই। তারা সরাসরি বা অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন। কিন্তু যারা বিদেশ থাকেন এবং যাদের দেশেও আয় ছিল/আছে, তাদের অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হলে ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মোবাইল নম্বর নিবন্ধিত থাকতে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মোবাইল নম্বর নিবন্ধিত থাকলেও ব্যক্তি দেশে না থাকলে সেই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে আয়কর রিটার্ন জমাদানের জন্য অনলাইনে নিবন্ধিত হওয়া বা তা ব্যবহার করা বা আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যায় না। অথচ মোবাইল নম্বরের পরিবর্তে ই-মেইল ব্যবহারের সুযোগ থাকলে এ সমস্যা হতো না।
করোনা মহামারির পর কয়েক বছর ধরে পরিপূর্ণভাবে আয়কর মেলা হচ্ছে না। তবে আয়কর সার্কেলে গিয়ে সরাসরি আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যায়। আর মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে অনলাইনেও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যায়। যারা বিদেশে থাকেন, তাদের অনেকের পক্ষে এ দুটির কোনোটিই সম্ভব হয় না। ফলে অন্য কাউকে দিয়ে আয়কর সার্কেলে সরাসরি আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
সাধারণত সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বেতন থেকে মাসে মাসে উৎসে আয়কর কেটে রাখে। ফলে কোনো কোনো কর্মচারী আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। আবার যাদের বেতন ছাড়াও বিভিন্ন দায়িত্বের কারণে অতিরিক্ত আয় হয় (যেমন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পরীক্ষার ডিউটি, খাতা দেখা ইত্যাদি), তাদের অতিরিক্ত আয় রিটার্নে দেখাতে এবং আয়কর দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সেটা করেন। তাছাড়া করযোগ্য আয়ের নির্দিষ্ট অংশ (যেমন ২০/২৫ শতাংশ) সঞ্চয়পত্র, ডিপিএস, জীবনবিমা ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করলে তার ১৫ শতাংশ আয়কর রেয়াত পাওয়া যায়। এসব কারণে প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া উচিত। আর কিছু ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে কয়েকটি সরকারি সেবা পাওয়া সম্ভব হয় না।
আমি দেশে না থাকায় ছোট ভাইকে দিয়ে ঢাকায় আয়কর সার্কেলে সরাসরি আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। বর্তমান করবর্ষে (২০২৩-২০২৪) গত অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পর এর আগের তিন বছরের আয়কর রিটার্ন জমা দিতে গেলে ঊর্ধ্বতন কর্মচারী বলেন, ‘যেহেতু ওনার প্রতিষ্ঠান থেকে উৎসে আয়কর কেটে রেখেছে, তাই গত তিন বছরের রিটার্ন জমা না দিলেও হবে।’ আমার ছোট ভাই তখন বলেন, ‘যেহেতু উনি আরও আগে থেকেই প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন জমা দেন, তাই গত তিন বছরের রিটার্নও জমা দিতে চান এবং জমাদানের রসিদ চান।’ তখন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী বলেন, ‘মেলা শেষে তিনদিন পর আসেন, আমরা এখন আগেরগুলো দেখছি না।’ তিনদিন পর আয়কর সার্কেলে গেলে ওই ঊর্ধ্বতন কর্মচারী বলেন, ‘যেহেতু গত তিন বছর আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হয়নি, তাই ওনাকে জরিমানা বাবদ বছরে আঠারো হাজার করে তিন বছরে চুয়ান্ন হাজার টাকা জমা দিতে হবে’!
ছুটি না পাওয়ায় পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমি চাকরি থেকে অবসরের আবেদন করি। যেহেতু আমি পিএইচডি গবেষণাকালীন চার বছর সবেতনে ছুটিতে ছিলাম এবং শর্ত মোতাবেক যোগদান করার পর চার বছরের পুরো সময় চাকরি করিনি, তাই আমাকে বাকি সময়ের বেতন বিশ্ববিদ্যালয়কে ফেরত দিতে হবে। যেহেতু প্রাপ্ত বেতন ফেরত দিতে হবে, তার মানে আমি প্রকৃতপক্ষে কোনো বেতন পাইনি, অর্থাৎ আমার করযোগ্য আয় নেই, তাই আয়কর (শূন্য) দেওয়ার প্রশ্নও আসে না। তাছাড়া ছুটিকালীন উৎসে আয়কর কেটে রাখার কারণে আয়কর রিটার্নে সরকারের কাছে আমার এখন পর্যন্ত আটচল্লিশ হাজার টাকার বেশি পাওনা আছে। এসব যুক্তি দেওয়ার পরও ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর সেই একই কথা!
ব্রিটিশরা এদেশে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আইনকানুন প্রবর্তন করে গেলেও তারা নিজেরা নাগরিকের ভালো-মন্দ দেখা তথা যুগোপযোগী আইনকানুন প্রয়োগ করে চলছে। আর তাদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে ‘মাছি মারার কেরানি’ তৈরি করেছে/করছে, যাদের সময়োপযোগী আইনকানুন নিয়ে হয় ধারণা নেই অথবা তা প্রয়োগ/প্রবর্তন করার মতো চিন্তা মাথায় আসে না! এ সত্য আমাদের কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সরকারি কর্মচারী যারা পড়ালেখা/গবেষণার কারণে বিদেশে যান, তাদের কেউ কেউ (বিশেষত কেউ যদি মনে করেন দেশে আর ফিরবেন না) বিনা বেতনে ছুটি নেন। যেহেতু তারা বেতন নেননি, তাই আর যোগদান না করলে বেতন ফেরত দেওয়ার ব্যাপারও থাকে না। একইভাবে থাকে না আয়কর দেওয়ার প্রশ্নও (যেহেতু করযোগ্য আয় নেই)। এটা, আর যিনি বেতন নিয়ে ফেরত দেবেন-এ দুইয়ের মাঝে তো কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও নাকি জরিমানা দিতে হবে!
কেউ বিদেশে গেলে সাধারণত তাকে আয়কর অফিসে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়ে রাখতে হয়, আগামী কয়েক বছর পর দেশে এসে তিনি তার আগের অর্থবছরগুলোর রিটার্ন জমা দেবেন। পিএইচডি গবেষণায় আসার আগে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সময়ের কাজের চাপের কারণে আমি আয়কর অফিসে গিয়ে সেই চিঠি দিতে পারিনি। কিন্তু এ বছর যখন গত তিন বছরের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হলো, তখন রিটার্নের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর ছুটি মঞ্জুরের চিঠিও যুক্ত করি ছুটিতে বিদেশে থাকার প্রমাণ হিসাবে। এসব বোঝার ক্ষমতা কি আমাদের ‘মাছি-মারা কেরানি’দের নেই? প্রশ্ন হলো, কেন নেই?
একটা কারণ হতে পারে, আয়কর নিয়ে তাদের নিজেদের পর্যাপ্ত দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের অভাব। অন্য কারণ হতে পারে, অবৈধ আয়ের ইচ্ছা। আয়কর অফিসে কিছু অসাধু আয়কর কর্মচারীর অবস্থা বোঝার জন্য আমার এক সহপাঠী-যে আয়কর অফিসে যোগদান করেছে এক যুগেরও বেশি আগে-সে তখন বলেছিল, ‘আমি অফিসে যাই লোকাল বাসে চড়ে, আর আমার অধস্তন কর্মচারী যায় ব্যক্তিগত গাড়িতে করে!’ এটা অবশ্য জানা নেই যে, আমার সেই সহপাঠীর এখনো ব্যক্তিগত গাড়ি হয়েছে কি না।
প্রসঙ্গত, পিএইচডি গবেষণা করতে অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগে করযোগ্য আয় ওই অর্থবছরে তিন মাসের (বাকি নয় মাসের বেতন ফেরত দিতে হবে) হলেও আমি পুরো বারো মাসের আয়কর দিয়েছি। আবার চলমান করবর্ষে চাকরিজনিত কারণে তিন মাসের বেতন করযোগ্য হলেও ফেরত দিতে যাওয়া আরও তিন মাসের বেতনসহ ছয় মাসের আয় ই-রিটার্নে করযোগ্য হিসাবে দেখিয়েছি। তার মানে হলো, প্রতিবছর নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হলেও যৌক্তিক কারণে বিদেশ থাকায় রিটার্ন জমা দিতে না পারায় সরকারের কাছে উলটো পাওনা থাকা সত্ত্বেও আপনাকে জরিমানা দিতে হবে! আর যারা কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকি দেয়, তাদের কারও কারও জরিমানা বা শাস্তি পেতে হয় না! কেন হয় না? আয়কর অফিসে যোগদান করা আমার সহপাঠীর উক্তি কি মনে পড়ছে?
এই আমলাতন্ত্র এবং অদক্ষ/অযোগ্য লোকদের হাত থেকে মুক্ত হোক আয়কর অফিস, এ প্রত্যাশা করি। বিদেশে থেকে যারা পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান, তারা সেটা না পাঠালে দেশের অবস্থা কোন পর্যায়ে যাবে, তা শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উদাহরণ থেকে সরকারি কর্মচারীদের বোঝা ও শেখা জরুরি। তাতে অন্তত তাদের দায়িত্ব যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার সঙ্গে পালন করা সম্ভব হতে পারে। আমদানি-রপ্তানির বিশাল ব্যবধান যে বিদেশে বসবাসরত পরিশ্রমী লোকদের রেমিট্যান্স অনেকখানি পূরণ করে, এই সাধারণজ্ঞান আমাদের আয়কর অফিস, পাসপোর্ট অফিস, জাতীয় পরিচয়পত্র অফিস, জন্মনিবন্ধন অফিসে নিয়োগপ্রাপ্ত লোকেরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, দেশ ও জনগণের ততই মঙ্গল। বিকল্প হিসাবে এসব জায়গায় নিয়োগ প্রদানের আগে চাকরির পরীক্ষায় গণিত আর অর্থনীতির প্রায়োগিক জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাব রাখা যায়।
ড. অপূর্ব অনির্বাণ : সাবেক শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া নিবাসী