Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে!

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক বোমাটি ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশকে স্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই বিএনপি নেতাদের জেলে রাখা হয়েছে। তাদের নির্বাচনে আসার জন্য বারবার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এক রাতে সব নেতাকে মুক্তির প্রস্তাবেও বিএনপি রাজি হয়নি।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টুয়েন্টিফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. আব্দুর রাজ্জাক এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি গত রোববার সম্প্রচারিত হয়। পরদিন সোমবার বেশ কটি জাতীয় দৈনিকে খবরটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়।

বিএনপিকে ভোটে আনতে সরকার চেষ্টা করেছে জানিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপি নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে বিএনপি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। বারবার নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, তারা যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। শুধু পিছিয়ে দেওয়া নয়; বলা হয়েছিল, তাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ বিএনপির নেতাকর্মী গ্রেফতার প্রসঙ্গে অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সহিংসতা আটকাতে পরিকল্পিতভাবেই এটা করা হয়েছে। বিশ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার না করলে কি আর হরতালের দিন গাড়ি চলত? গণগ্রেফতার ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। যেটা করা হয়েছে, চিন্তাভাবনা করেই করেছি।’

সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধান সমুন্নত রেখে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতেই নির্বাচনে বদ্ধপরিকর আওয়ামী লীগ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে আওয়ামী লীগের চেষ্টার কমতি নেই’ (সূত্র : সমকাল, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩)।

ড. আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে আটকের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, এদের গ্রেফতার করা না হলে হরতালের দিন গাড়ি চলত না। কথাটি অত্যন্ত স্পষ্ট। ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ভণ্ডুল করে দিয়ে সম্ভাব্য শক্তিশালী আন্দোলন ঠেকিয়ে দিয়েছে সরকার। ২৮ অক্টোবর যে জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তা ছিল সমকালীন ইতিহাসে একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী। দিনের পর দিন অবিচার, অত্যাচর ও নির্যাতনের ফলে বিএনপির নেতাকর্মীরা দিশাহীন হয়ে পড়েছিল। তারা বারবার চেষ্টা করেছে ঘুরে দাঁড়াতে। কিন্তু সরকারের জেল-জুলুম, লাঠি-গুলি, গুম-খুনের অভিঘাত মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছিল। ঘরছাড়া পালিয়ে বেড়ানো বিএনপি কর্মীদের অনেকে জীবন-জীবিকার জন্য ঢাকা শহরে রিকশাচালকের কাজ নিয়েছিল। এতে দুদিক রক্ষা পেয়েছিল। একদিকে ক্ষুধার অন্ন জোগানো, অন্যদিকে পুলিশ ও গোয়েন্দার চোখে ধুলো দেওয়া। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকার রাজপথে এ রকম বেশকিছু কর্মীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন। সভা-সেমিনারে এ কর্মীদের দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। সংবাদপত্রে এ সংবাদ ছাপা হয়েছে। অতি সংবেদনশীল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষে অশ্রুসজল হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আমরা যখন বামপন্থি রাজনীতি করতাম, তখন কমরেড আবদুল হক একটি কবিতার দুটি ছত্র আবৃত্তি করে শোনাতেন। ছত্র দুটি ছিল-কমরেড মানে বিরাট হৃদয় লোক/কমরেড মানে অগ্নিগর্ভ চোখ। কমরেড হতে হলে হতে হয় বিশাল হৃদয়ের মানুষ। যে হৃদয়ে ঠাঁই নিয়ে আছে মানুষের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা। তেমন মানুষের চোখ দিয়ে নির্গত হয় ক্ষোভ ও প্রতিবাদের অগ্নিচ্ছটা। মির্জা ফখরুল তার কমরেডদের জন্য তেমন আবেগই প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো পত্রিকার কলাম লেখক এতে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, একজন রাজনীতিবিদ কি করে ছিচকাঁদুনে হতে পারেন। আমি তাদের প্রশ্ন করব রাজনীতিবিদ হলে কি নির্দয় নিষ্ঠুর হতে হয়? এমন নির্দয় নিষ্ঠুর রাজনীতিবিদরা পরিণত হন ডিক্টেটর কিংবা স্বৈরশাসকে।

ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশকে স্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই বিএনপি নেতাদের জেলে রাখা হয়েছে। মেনে নিচ্ছি সাময়িকভাবে সরকারের এ কৌশল সফল হয়েছে। বিএনপির হরতাল-অবরোধে আওয়ামী লীগের হরতাল-অবরোধের মতো ভীতি জাগানিয়া নয়। অনেকটা অলক্ষেই চলে যাচ্ছে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি। সাময়িক এ সাফল্যে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। পানি গরম করতে গিয়ে অতিরিক্ত তাপের সঞ্চার হলে বাষ্পের সৃষ্টি হয়। ঢাকনা দিয়ে পাত্রের মুখটি বন্ধ রাখলে একপর্যায়ে বাষ্পের উদ্গিরণে ঢাকনাটি ছিটকে পড়বে, তা আমরা নিশ্চিত জানি। তেমনিভাবে বর্তমান গণ-আন্দোলনকে বলপ্রয়োগ করে দমিয়ে রাখার চেষ্টা বাষ্প থেকে উদ্গিরণ হওয়ার ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দেবে, এটাই বিজ্ঞানের কথা। এটাই বাস্তবতা। বাস্তবতাকে যারা অস্বীকার করে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের বুঝতে হয়, পাত্রে পানি রেখে গরম করতে গেলে কতক্ষণ পর্যন্ত তাপ সহনীয় মাত্রায় থাকে এবং কতক্ষণে পানি গুণগত পরিবর্তন হয়ে বাষ্পের সৃষ্টি হবে এবং সে বাষ্প থেকে বিস্ফোরণও ঘটতে পারে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই রেলগাড়ির স্টিম ইঞ্জিন দেখেনি। অথবা বড় জাহাজের স্টিম ইঞ্জিনও দেখেনি। স্টিম ইঞ্জিন বা বাষ্প দ্বারা পরিচালিত জাহাজকে বলা হয় বাষ্পীয় পোত। বিশাল রেলগাড়িটি বাষ্পের শক্তিতেই সুদূরের পথ অতিক্রম করে। কাজেই বাষ্পের শক্তিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। জনতার ঘাম যখন বাষ্পে পরিণত হয় তখন কালবোশেখি ঘটে যেতে পারে। অবোধ শাসকগোষ্ঠী অনেক সময় এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারে না।

ছোটবেলায় মোতাহার হোসেন চৌধুরীর লেখা একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। এ প্রবন্ধে একটি মূল্যবান কথা ছিল। কথাটি হলো, ভাবের যখন জোয়ার আসে খঞ্জগিরি লঙ্ঘন করে, মূকও বাচাল হয়। এদেশের জনগণ অর্থাৎ ‘এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা/এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা/ডাকিয়া বলিতে হবে মূহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে।’ সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এই সাময়িক নিস্তরঙ্গতা কেটে যাবে। জনতা সাগরে জাগবে উর্মি। সাময়িকভাবে মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত ও নতজানু দেখে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। জনজাগরণে ভেসে যাবে সব অন্যায়। প্রতিকারহীন অবস্থারও প্রতিকার হবে। সুতরাং সময় থাকতে সুমতির উদ্রেক হওয়াই শ্রেয়।

ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপি নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে বিএনপি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। কেন গ্রহণ করবে? যে নির্বাচন ভাগবাঁটোয়ারার, যে নির্বাচন আসন ভাগাভাগি করার, যে নির্বাচন ডামি প্রার্থী দাঁড় করানোর এবং যে নির্বাচনে একই দলের কিছু প্রার্থীকে বিদ্রোহী প্রার্থী হতে উৎসাহিত করা হয়, তেমন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কী অর্থ আছে। বিএনপি তো বলেছে, তারা একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চায়, যে নির্বাচন দলীয় সরকারের পেশিশক্তিতে প্রভাবিত হবে না, যে নির্বাচনের ফল পালটে দেওয়া হবে না। বিএনপি নেতারা যদি নিছক জেল থেকে বের হয়ে আসার জন্য তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ও নীতি থেকে পদস্খলিত হন, তাহলে জনতার চোখে তাদের কী মূল্য থাকবে? বিএনপি নেতারা নৈতিক অবস্থান থেকেই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার ফাঁদে পা দেননি। এজন্য তারা ধন্যবাদার্হ।

রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে অনেক সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তাহলে বলতে হবে বিএনপি নেতারা এ যাত্রায় কোনো ভুল করেননি। বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদ যেমনটি বলেছেন, বিএনপি নেতাদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব প্রমাণ করে সরকারের পদক্ষেপ ছিল সাজানো ও পূর্বপরিকল্পিত। এতে আরও প্রমাণিত হয়, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সারবত্তা নেই বললেই চলে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ রকম উদ্ভট প্রস্তাব সরকার দেয়নি। নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্তে বিএনপি নেতাকর্মীদের রাতারাতি মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া নিয়ে নিজের বক্তব্যে অনড় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক (সূত্র : সমকাল, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩)। তিনি বলেছেন, ‘আমি যা বলেছি কোনো ভুল বলিনি। বক্তব্য একদম ঠিক আছে।’

জনগণ কার কথা বিশ্বাস করবে? তবে রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য সঠিক মনে করার যথেষ্ট যুক্তি আছে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম