Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

চিন্তার ভিন্নতায় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চিন্তার ভিন্নতায় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস

আজ ১৪ ডিসেম্বর। এই দিনটি বাংলাদেশে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসাবে পালিত হয়। এ দিনটি গভীর বেদনার, শোকের অশ্রু ঝরানো এবং স্বজন হারানোর কষ্টে কাতর। আজকের এই দিনে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠ থেকে যখন শুনি-সব ক’টা জানালা খুলে দাও না/ওরা আসবে চুপি চুপি/যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ-হৃদয়টা শিক্ত হয়ে ওঠে, অশ্রুধারা রোধ করা যায় না, হারানো স্বজনদের কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। এমন দিনেই তো বলা যায়-বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা, এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা। না, তাদের রক্তস্রোত শুকিয়ে যায়নি, মায়ের অশ্রুধারা ধরার ধুলায় হারিয়ে যায়নি। আজও সে রক্ত, সে অশ্রুধারা ফিনকি দিয়ে উৎক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে। এর কোনো বিরতি নেই, বিরাম নেই।

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যার সূচনা করে, তার ওপর বিরামচিহ্ন অঙ্কিত হয় সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন পাকিস্তানি সেনারা সব মানসম্মান হারিয়ে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কী কারণে জানি না মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানি উপস্থিত হতে পারেননি। এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জৌলুস কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে গিয়েছিল।

’৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর অবধি এমন কোনো দিন নেই, রাত নেই, পল নেই, দণ্ড নেই-যে মুহূর্তে আমরা একজন স্বজনকে হারাইনি। এই স্বজন রক্তের সম্পর্কে স্বজন না হলেও জাতীয়তার পরিচয়ে পিতামাতা বা ভ্রাতা-ভগিনী হিসাবে অতি আপনজন। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম-দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত, প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত। রক্ত তো আমরা দিয়ে যাচ্ছি। রক্ত দিয়েছি অশোকের আমলে, রক্ত দিয়েছি সেনদের আমলে, রক্ত দিয়েছি মোগলদের আমলে, রক্ত দিয়েছি সিপাহি যুদ্ধে, জালিয়ানওয়ালা বাগে, সৈয়দ আহমদ বেরলভির জেহাদে, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায়, প্রীতিলতার আত্মাহুতির রক্তদানে, ব্রিটিশ শাসনের ঔপনিবেশিকতায়। এদেশের মানুষ হাসিমুখে ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়ে গেছে। রক্ত আমরা আরও দিয়েছি ভাষার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, শিক্ষার জন্য, এক সূর্যের নিচে মানুষ মানুষের ভাই এমন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা অকাতরে এভাবে রক্ত দিয়েছি পাকিস্তানের ভিন্ন এক ধরনের ঔপনিবেশিকতায়। তাতেও পাকিস্তানিদের খায়েশ মেটেনি। বর্গির হামলাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওরা হামলা চালায় ’৭১-এ। ’৭১-এর সেই দিনগুলোয় পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতায় আমরা যাদের হারিয়েছি, তাদের হারানোকে বলি গণহত্যা। গণহত্যায় যারা শহিদ হয়েছিলেন, তারা ছিলেন আমজনতা।

দেশের জন্য জীবন দেওয়া আমজনতা ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ভেদরেখা আনা যুক্তিযুক্ত নয়। দেশের জন্য যারা প্রাণ দেন, তারা সবাই মহান শহিদ, মহান দেশপ্রেমিক। তাই তো কবি গেয়েছেন, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে।’ যাদের নাম লেখা আছে অশ্রুতে, তাদের মধ্যে আমরা কীভাবে বিভাজন করি? আমজনতাই হোক আর বুদ্ধিজীবীই হোক, সবারই নাম লেখা আছে অশ্রুতে। আমরা কাউকে কোনোমতে ভুলতে পারি না। তারা সবাই আমাদের চলার পথে প্রেরণাদায়ী মহামানব। তবুও নিয়ম করা হয়েছে পৃথকভাবে ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের। এ দিবস বিশেষভাবে পালনের কারণও আছে। সেই পাকিস্তানি সময় থেকে বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছিল। বলা হতো তারা পাকিস্তানের দুশমন। শিশুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অসময়ে পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা তাদের লেখনী দিয়ে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ায়। তারা বাঙালিদের বলে, পাঞ্জাবিরা তাদের শত্রু। তারা বলে, বাঙালিরা পাঞ্জাবিদের ঘৃণার চোখে দেখে। এসব শিক্ষিত উচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি দেশের জন্য ঘোর বিপদ ডেকে আনবে। তাই তাদের চোখে চোখে রাখা হতো। তাদের সব ধরনের কাজে নজর রাখা হতো।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ক্রমান্বয়ে গোয়েন্দাদের দখলে চলে যাচ্ছিল। অথচ এ পরিস্থিতি কারোরই কাম্য ছিল না। পাকিস্তানি শাসনক্ষমতায় বাঙালি নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে প্রান্তিকতায় পর্যবসিত হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনে তাদের বিজয় সহ্য করা হলো না। বন্দুকের বুলেটে তাদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার সর্বাত্মক আয়োজন করা হলো। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য বাঙালি নেতাদের অবদান ছিল ঈর্ষণীয়। ১৯৪০ সালের লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন বাঙালিদের প্রিয় নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ১৯৪৬-এ বাঙালি মুসলমানরা ব্যাপকভাবে ভোট দেয় পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে। পাকিস্তানের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোয় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মর্যাদার আসন থেকে বঞ্চিত করা হয়। এ কারণে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল। বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখনীতে, বচনে, ভাষণে এই ক্ষোভকে অগ্নিস্পর্শী করে তুলেছিলেন। এ কারণে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বিশেষভাবে শত্রুর তালিকাভুক্ত করা হয়। বেছে বেছে তাদের হত্যা করা হয়। অনেকের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পুলিশ অফিসার, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি মাথা তোলা মানুষদের নিজ বাসভবন থেকে তুলে নিয়ে কাদামাখা বাসে করে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রকৃত খুনিদের আজও শনাক্ত করা হয়নি। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানরা আজও অনেকেই জীবিত আছেন। তারা শুধু এটুকু বলতে পারেন, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। কবে তারা স্বজন হারানোর জন্য বিচার পাবেন? বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি ক্লু ১৯৭২-এর সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। তৎকালীন দৈনিক বাংলায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন প্রয়াত ড. ভুঁইয়া ইকবাল। ড. ভুঁইয়া ইকবাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাশ করার পর কিছুদিন দৈনিক বাংলায় প্রতিবেদক হিসাবে কাজ করেন। ড. ভুঁইয়া ইকবাল আমার নেতৃত্বাধীন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তার সঙ্গে আমারও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার বাবা তৎকালীন গভর্নর হাউজে চাকরি করতেন। ভারতীয় বিমানবাহিনী গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) স্ট্রেফিং করলে গভর্নর হাউজটি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। দাপ্তরিক কাগজপত্র ও আসবাবপত্র ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই গভর্নর হাউজেরই একটি কক্ষে অফিস করতেন গভর্নর এমএ মালিকের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্ট্রেফিংয়ের ফলে রাও ফরমান আলীর সেক্রেটারিয়েট টেবিলটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ শেষে ড. ভুঁইয়া ইকবাল (তখনও তিনি ড. হননি) রাও ফরমান আলীর অফিসকক্ষে তার ব্যবহার করা ডায়েরিটি খুঁজে পান। এ ডায়েরিতে কয়েকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য লেখা ছিল। তাদের মধ্যে প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নামও ছিল। ভুঁইয়া ইকবাল রাও ফরমান আলীর ডায়েরির বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করেন। আমি তাকে এ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দৈনিক বাংলায় প্রকাশের পরামর্শ দিই। আমি আরও বলি, প্রতিবেদনের সঙ্গে রাও ফরমান আলীর হাতে লেখার ফ্যাক্সিমিলিও ছাপিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। যথাযথভাবে প্রতিবেদনটি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরাসরি যোগাযোগ থাকার বিষয়টি এখন আর লুকানো সম্ভব নয়।

বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ পাকিস্তানপন্থি ছিলেন। তবে তারা ছাড়াও অন্যকিছু বুদ্ধিজীবী পাকিস্তান কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন এবং পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। সব দেশে সব সমাজে বুদ্ধিজীবীরা দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত থাকেন। তাদের একটি অংশকে বলা হয় প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট এবং অন্য অংশটিকে বলা হয় অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট। মজার ব্যাপার হলো, কিছু প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট বুদ্ধিজীবী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান। তারা বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের উদারতার ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। এছাড়া আরও কিছু বুদ্ধিজীবী ছিলেন, যাদের কাছে পাকিস্তান ও ভারত কোনো রাষ্ট্রই নির্ভরযোগ্য ছিল না। একটি দেশে যখন রাষ্ট্রবিপ্লব হয় তখন এ ধরনের সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনাস্থা চরমে পৌঁছে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম