Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সমন্বিত হামলায় দিশেহারা মিয়ানমার জান্তা

Icon

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমন্বিত হামলায় দিশেহারা মিয়ানমার জান্তা

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের চলমান সমন্বিত আক্রমণে দেশটির জান্তা বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে। চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে চলছে এ আক্রমণ।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারে সামরিক শাসনের জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে বড় হুমকি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতালাভের পর মিয়নমারে এক ডজনেরও বেশি জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্রগোষ্ঠী দেশের সীমান্ত অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে লড়াই করেছে।

তবে তাদের মধ্যে ঐক্য ও বিশ্বাসের অভাব ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে তিনটি গোষ্ঠী একত্রে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে উত্তর শান রাজ্যজুড়ে যৌথ আক্রমণ পরিচালনার মাধমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা চীন সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো দখল করে নেয়।

পরবর্তী সময়ে তারা সারা দেশে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ চালায়। পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) পূর্ব কায়াহ রাজ্যের রাজধানীর কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং শহর থেকে জান্তা সৈন্যদের উৎখাত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মন রাজ্যের কিয়াইকমারা টাউনশিপে লড়াই অব্যাহত থাকায় ২০টিরও বেশি গ্রামের ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এবং পিডিএফ বাগো অঞ্চলের কিয়াউকগি টাউনশিপের মোনে টাউনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেএনইউ যোদ্ধারা পূর্ব কারেন রাজ্যের কাওকারিক শহরে সেনাবাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এ শহরটি ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে থাই সীমান্তের বাণিজ্যকেন্দ্র মায়াওয়াদিকে সংযুক্ত করে।

সামরিক বাহিনী ও কেএনইউর মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা লড়াইয়ে ইয়াঙগুন ও মায়াওয়াদির মধ্যবর্তী এ এলাকা প্রতিনিয়ত অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকে। থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের ছয়টি সরকারি সীমান্ত ক্রসিংগুলোর মধ্যে মায়াওয়াদি দ্বিতীয় ব্যস্ততম সীমান্ত বাণিজ্যকেন্দ্র।

কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ) ও পিডিএফ বাগো অঞ্চলের কিয়াউক্কি টাউনশিপের মোনেতে একটি সামরিক চেকপয়েন্টে আক্রমণ করায় উভয়পক্ষই ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক জান্তা সৈন্য প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। মোন শহরটি জান্তার স্নায়ুকেন্দ্র, নেপিদো এবং কেএনইউ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার-থাই সীমান্তের উভয় অঞ্চলে অবস্থিত।

এর অবস্থানগুলো নেপিদোর কাছাকাছি এবং কৌশলগতভাবে মিয়ানমার-থাই সীমান্তের রাস্তায় অবস্থিত। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কোকাং স্বশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র লাউক্কাইং শহর দখলের প্রস্তুতি হিসাবে জাতিগত কোকাং সশস্ত্র গোষ্ঠী জান্তার ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিএএ) সৈন্যরা ঘাঁটি দখলের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এমএনডিএএ পাঁচদিন সংঘর্ষের পর কোকাং স্ব-শাসিত অঞ্চলের উত্তরে কনকিয়ান টাউনশিপ দখল করে নেয়। শহরটি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জান্তার নিয়ন্ত্রণে ছিল।

এমএনডিএএ এবং মিত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো শান রাজ্যের বিশেষ অঞ্চল ১-এর লাউক্কাইং টাউনের আশেপাশের ২০০টিরও বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং বেশ কয়েকটি কৌশলগত শহর দখল করে নিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘর্ষের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। এর পাশাপাশি সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাখাইনে জান্তার চলমান অবরোধের কারণে সব পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে এবং রাজ্যের ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের অধিকাংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকটে ভুগছে।

সিটওয়ে-ইয়াঙগুন মহাসড়ক অবরুদ্ধ থাকায় পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে; ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে। জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বলেছেন, আরাকান আর্মির সৃষ্ট সংকটের কারণে রাজ্যের বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ম্রাউক-ইউ, কিয়াউকতাও ও পালেতওয়া শহরে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের পাউকতাও, মিনবায়া, রাথেডং ও মংডু শহরে আরাকান আর্মি (এএ) সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

গত মাসে তারা রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ক্রমবর্ধমান আক্রমণের কারণে সরকার প্রায় ২০টি শহর এবং ৩০৩টিরও বেশি ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। পুরো ব্যাটালিয়নসহ শত শত জান্তা সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। রাখাইন রাজ্যের এ সংকটের কারণে সীমান্তের এ পাশে যেন কোনো প্রভাব না পড়ে সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।

জান্তা সরকার কর্তৃক বিপ্লবী বাহিনী এবং বেসামরিক জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা সত্ত্বেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ইয়াঙগুন ও মান্দালয়ের অনেক বাসিন্দা বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করছে। পিডিএফ ও ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ৪ নভেম্বর সাগাইং অঞ্চলের কাওলিন শহরটি দখল করে নেয়। শহরটি ৩ ডিসেম্বর থেকে বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে কাজ শুরু করেছে, বাজারগুলোও আবার খুলছে এবং শহরে শান্তি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী দশকের পর দশক ধরে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (ইএও) সঙ্গে সংগ্রাম করে আসছিল। তবে এবারের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা কখনো হয়নি। চলমান সেনাশাসনের শুরু থেকে মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা চাপ অব্যাহত রয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারত মিয়ানমারকে নানাভাবে সমর্থন দিলেও এ পরিস্থিতি তাদের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে।

মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন জনজীবনের ওপর প্রভাব ফেলায় সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন কমে গেছে। অনেক বিশ্লেষক অপারেশন ১০২৭-এর সাফল্যের জন্য চীনের সমর্থন আছে বলে মনে করেন, অনেকের মতে, বার্মা এক্টের কিছুটা প্রভাব এই সমন্বিত আক্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে যাই হোক না কেন, এবারের সংগ্রামে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামার জনগোষ্ঠীর সমর্থন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সামর্থ্য বাড়িয়েছে।

সেনাবাহিনীর প্রতি দেশের মূল জনগোষ্ঠী ভামারদের সমর্থন কমে যাওয়া এবং ভামার সংখ্যাগরিষ্ঠ সামরিক বাহিনীতে ভামার তরুণদের যোগদানে অনিচ্ছা এ পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তরুণ ভামার যুবকদের কাছে বহু বছর ধরে চলা সেনাশাসনের অবসান এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেটা নিভে গেলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং অনেকে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়।

মিয়ানমারজুড়ে একাধিক ফ্রন্টে ক্রমাগত সামরিক পরাজয়ের মধ্যে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বেসামরিক জনগণের দুর্দশার জন্য দেশটির ইএও’কে দায়ী করেছে। মিয়ানমারের জনগণ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিপ্লবী বাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মিন অং হ্লাইং মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জানান, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখলে স্থানীয় জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জান্তাপ্রধান রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য আরাকান আর্মিকে অভিযুক্ত করেন এবং কারেন্নি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টিকে (কেএনপিপি) সেখানে চলমান লড়াইয়ের সময় কায়াহ রাজ্যের রাজধানী লোইকাওতে অনেক বাড়িঘর ও ভবন ধ্বংসের জন্য দায়ী করেন। তিনি ইএওদের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার আহ্বান জানান।

সরকার মিয়ানমারের পলাতক সৈন্যদের তাদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে একটি ঘোষণা দেয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পলাতকদের কাজে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে, দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। তারা এমন কোনো পদক্ষেপ সমর্থন করবে না, যাতে জাতীয় সংহতির বিভাজন হবে এবং ইউনিয়ন ভেঙে যাবে।

বিশ্লেষকদের মতে, এ লড়াই অব্যাহত থাকবে। কারণ বিপ্লবী বাহিনী এখন মিয়ানমারে সামরিক একনায়কতন্ত্রকে নির্মূল করতে পুরোপুরি বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, অক্টোবরে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর বেসামরিক জনগণের হতাহতের পাশাপাশি দেশজুড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানা যায়। মিয়ানমারের জান্তা আয়ারওয়াদি ছাড়া প্রতিটি রাজ্য ও অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই পিডিএফ এবং জাতিগত সেনাবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

চলমান এ সংঘর্ষের কারণে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে এবং অর্থ সংকটে থাকা জান্তা রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলমান এ সংঘাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থলযুদ্ধে পিছু হটছে। আক্রমণের মুখে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শহরগুলোর পতন হচ্ছে। সীমান্ত বাণিজ্য সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে এবং দেশজুড়ে জনগণ আতঙ্ক, খাদ্যাভাব ও মূল্যস্ফীতির শিকার হচ্ছে। এনইউজি তাদের দখলে নেওয়া শহর ও শহরতলীতে বেসামরিক প্রশাসন কার্যকর করার চেষ্টা করছে। দেশজুড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে হতাহত আর দুর্ভোগ।

দমন-পীড়নের মাধ্যমে সংঘাত নিরসন করতে না পেরে মিয়ানমার সরকার এতদিনে সংঘর্ষের পথ পরিহার করে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চিন্তা করছে। এ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং দেশজুড়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার আহ্বানে এখনো কেউ সাড়া দিয়েছে বলে জানা যায়নি। মিয়ানমারজুড়ে সংগ্রাম চলমান রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক, এটাই প্রত্যাশা।

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম