ফোকাল পয়েন্ট
বিজয়ের মাসে কিসিঞ্জার-কথন
আসিফ রশীদ
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মহান বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই হেনরি কিসিঞ্জারকে স্মরণ করতে হচ্ছে তার আকস্মিক মৃত্যুর কারণে। সাবেক এই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারা বিশ্বে নানা কারণে আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় তিনি নিশ্চয়ই একজন দক্ষ ও চৌকশ কূটনীতিক; বিশ্বের বহু ঘটনার অনুঘটক। তিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তবে আমাদের দেশে ‘কিসিঞ্জার’ নামটি নেতিবাচকভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। এমনকি এক সময় কারও সঙ্গে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে বলা হতো ‘কিসিঞ্জারি’ করা। কারণ কিসিঞ্জার ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে; বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তার পেছনের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন কিসিঞ্জার। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হতো মূলত কিসিঞ্জারের নেতৃত্বেই। তিনি তখন ছিলেন নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।
১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল, তা উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে অবমুক্ত করা গোপন মার্কিন নথিপত্রেই। এসব নথি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কূটনীতিক হিসাবে কতটা ধূর্ত ছিলেন কিসিঞ্জার। তিনি এ যুদ্ধের (আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, তাদের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ) ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তাকে নানা কুমন্ত্রণা দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতাদের সম্পর্কে এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে অত্যন্ত কদর্য ভাষায় মন্তব্য করেছেন। যুদ্ধ থামানোর চেষ্টায় তথা পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য এমন কিছু নেই যা তিনি করেননি। এ বিষয়ে আলোচনার আগে সে সময়কার বিশ্বরাজনীতি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মেরুকরণের চিত্রটি এক পলক দেখে নেওয়া প্রয়োজন।
আমরা জানি, তখন বিশ্বরাজনীতি ছিল মোটের ওপর দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। সত্তরের দশকের শুরুর ওই সময়টিতে এ দুই পরাশক্তির মধ্যে চলছিল তীব্র স্নায়ুযুদ্ধ; অর্থাৎ যুদ্ধ না করেও যুদ্ধের মতো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। পুঁজিবাদী বিশ্বের সামরিক জোট ছিল (এখনো বহাল আছে) ‘ন্যাটো’, আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ‘ওয়ারশো প্যাক্ট’। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণ নির্ধারিত হয়ে আসছিল। অনেক ক্ষেত্রে এ মেরুকরণ ঘটছিল মতাদর্শকে ছাপিয়ে বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের আলোকে। দক্ষিণ এশিয়াও এর বাইরে থাকেনি। যেমন, ভারত আদর্শগতভাবে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশীদার হলেও পরিণত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্রে। আবার ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে মিত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর একটি কারণ ছিল পাকিস্তানের তখনকার সামরিক জান্তার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নতুন সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। তবে বড় কারণটি ছিল, বলাই বাহুল্য, এ অঞ্চলে কমিউনিজমের প্রবেশ ঠেকানো। আর এজন্য যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। কিসিঞ্জার প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছেন পাকিস্তানি গণহত্যাকারীদেরও। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ঠেকাতে পারেনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এটি ছিল কিসিঞ্জার তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় পরাজয়।
এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন কিসিঞ্জার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়ে। ১৯৭৪ সালে পিএল ৪৮০-এর গম সরবরাহ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষে সৃষ্টিতেও ভূমিকা রেখেছিলেন কিসিঞ্জার, যে কারণে এ দেশের বহু মানুষ প্রাণ হারান।
১৯৬৯ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে হেনরি কিসিঞ্জারের প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। এ সময় প্রথমে তিনি ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার ‘রিয়াল পলিটিকে’র মূর্ত প্রতীক মনে করা হয় তাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলাকে সমর্থন করা ছাড়াও তিনি কম্বোডিয়ায় ব্যাপক বোমাবর্ষণে সম্মতি দিয়েছিলেন। আর্জেন্টিনায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সামরিক একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে সংঘটিত গণহত্যায় তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত এবং স্বৈরশাসক পিনোশের ক্ষমতা দখলের ঘটনায়ও ছিল তার সমর্থন। বস্তুত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিসিঞ্জারের নাম। ভিয়েতনামে শান্তি স্থাপনে ভূমিকার জন্য ১৯৭৩ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া নিয়েও সৃষ্টি হয়েছিল বিতর্ক। সে সময় একইসঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া ভিয়েতনামি রাজনীতিক লি দাক থো সেই পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
জার্মানির একটি ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী কিসিঞ্জারের প্রকৃত নাম ছিল হেইন্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার। নাৎসিদের কবল থেকে বাঁচার জন্য তার পরিবার ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যায়। তখন তার নামের ‘হেইন্জ’ অংশটি বদলে রাখা হয় ‘হেনরি’। দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন কিসিঞ্জার, হয়েছেন শতায়ু। মে-তে তার ১০০ বছর পূর্ণ হয়। জুলাইয়ে চীন সফরও করেছিলেন তিনি। সেই চীন-যে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নতুন সম্পর্ক’ স্থাপনের জন্য তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।
কিসিঞ্জারের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্মরণ করবে একভাবে; বাংলাদেশ এবং আরও কিছু দেশ অন্যভাবে। বিশেষ করে আমাদের এই বিজয়ের মাসে কিসিঞ্জারের নামটি নতুন করে আলোচনায় আসায় অনেকেই সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে উপলব্ধি করবেন-ওই দুঃসময়ে কে ছিল আমাদের শত্রু, আর কে মিত্র।
আসিফ রশীদ : উপসম্পাদক, যুগান্তর; লেখক