Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

গাজা সংকট : পর্দার আড়ালে ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছক

Icon

মোহাম্মদ আলরুমাইহি

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গাজা সংকট : পর্দার আড়ালে ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছক

গাজায় সংঘটিত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ঘটনাগুলো নিঃসন্দেহে যন্ত্রণাদায়ক। আরব বিশ্বে বিরাজমান অসন্তোষের মধ্যে গাজায় চলমান সংঘাতের বিষয়ে নানা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, যা একটি বিভক্ত জনমতের উদ্রেক করেছে। গাজায় একটি তীব্র সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি কেবল হামাসের কারণে নেওয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু প্রতিরোধকারী উপদল অথবা কোনো সহযোগী শক্তির ভূমিকা ছিল কিনা।

এমন এক অস্থির সময়ে, যখন গোটা অঞ্চলটি একটি সম্ভাব্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়েছিল, তখন এ সিদ্ধান্ত যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। এক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনুসন্ধানের দাবি রাখে তা হচ্ছে, এ যুদ্ধের পরিণতি কী এবং এ অস্থির পন্থায় কারা লাভবান হবে।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঘোষিত ‘unity of squares’ বা স্কোয়ারের ঐক্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ পাচ্ছে, যেমনটি ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ (হামাস, হিজবুল্লাহ, সিরিয়া সরকার, ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাক ও সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে ইরান সমর্থিত নেটওয়ার্ক) দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে দৃশ্যত বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত যৌথ অপারেশন পরিচালনার মতো একটি সমন্বিত যুদ্ধক্ষেত্রের কার্যকারিতা নিয়েও সংশয় দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।

একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে, গাজার বাইরে নতুন ফ্রন্টগুলোর একটি সুস্পষ্ট নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। এর পরিবর্তে দক্ষিণ লেবাননে আপাতদৃষ্টিতে সীমিত কিছু সামরিক অভিযানের তথ্য উন্মোচিত হয়েছে, যা লেবাননি প্রতিরোধ থেকে দোষারোপ করার জন্য সাজানো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এই গোপন দৃশ্যটি বন্ধ দরজার পেছনে অপ্রকাশিত চুক্তি সম্পর্কে প্রশ্নের উদ্রেক করে। এই অনুমানটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে আলোকপাত করে। ট্রাম্প ইরান সম্পর্কিত আগের এক ঘটনা প্রকাশ করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান গোপনে যোগাযোগ করেছিল, তখন ইরানের প্রতিক্রিয়া কৌশলগতভাবে মুখ বাঁচাতে সীমাবদ্ধ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সরকারের মধ্যে যে বিষয়টি ঘটেছিল, একই সম্ভাবনা এখানেও রয়েছে, যা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি ট্রাম্পের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় এবং ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়, যেখানে সরাসরি সংঘর্ষ ছাড়াই নির্যাতিতদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

সর্বদা ক্ষমতার ভারসাম্যের বিকাশ

গত সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনের সময় ইন্দো-ইউরোপীয় করিডরের ঘোষণা ‘প্রতিরোধের অক্ষে’র মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। মার্কিন সমর্থন লাভ করা এ করিডর চীনা করিডরকে খানিকটা ম্লান করে শেষ পর্যন্ত আরব উপদ্বীপ, জর্ডান, ইসরাইল এবং ইউরোপকে ছাড়িয়ে ইরান ও সিরিয়াকে যুক্ত করবে। ইরান এবং বাশার আল আসাদের জন্য কৌশলগত করিডরটি উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বাশার আল আসাদের বেইজিং সফর চীনা করিডরের প্রতি তার সমর্থন পুনঃনিশ্চিত করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রস্তাবিত ভারত-মধ্যপ্রাচ্য করিডর ‘প্রতিরোধের অক্ষে’র মধ্যে অসন্তোষকে ইন্ধন দিয়েছে, যাতে প্রকল্পটিকে ব্যাহত করার লক্ষ্যে ইসরাইলের পথকে বাধাগ্রস্ত করা এবং সংকটের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়।

এ ঘটনাগুলোই ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ওপর আক্রমণ চালাতে হামাসকে বাধ্য করেছে, যদিও তা গাজায় অসংখ্য প্রাণের মূল্য দিয়ে। যেহেতু ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ তার লক্ষ্য অর্জন করেছে, তাই ‘ইউনিটি অফ স্কোয়ার্সে’র ব্যানারে হামাসের অভিযান তাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখে প্রতিরোধের অক্ষের অঙ্গীকার অপূর্ণ রেখেছে, আর দুর্দশা বাড়িয়েছে।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঘোষিত ইউনিটি অফ স্কোয়ার্স সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ পায়, যেমনটি প্রতিরোধের অক্ষ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। দৃশ্যত ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত যৌথ অপারেশন পরিচালনার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।

একটি অস্থির অবস্থা

পশ্চিমা দেশগুলোর এমন আচরণ তেহরানকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামে তার প্রভাব জোরদারের সুযোগ করে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, লাভক্ষতির এ হিসাবে ফিলিস্তিনিদেরই একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক দাবার বোর্ড উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোট, গোপন চুক্তি এবং ক্ষমতার লড়াইয়ের জটিলতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইন্দো-ইউরোপীয় করিডরের প্রভাব এবং আঞ্চলিক গতিশীলতার ওপর এর প্রবল প্রভাব ইতোমধ্যেই একটি অস্থির পরিস্থিতিতে ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা যুক্ত করেছে। প্রতিরোধের অক্ষের মধ্যে বিরোধ থেকে ভূ-রাজনৈতিক জোটের ভঙ্গুরতা এবং ভিন্ন স্বার্থের অন্বেষণের বিষয়টি প্রকাশ পায়।

ঘটনার এ জটিল জালে, গাজার সংঘাত শুধু যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবেই নয়, বরং বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কূটকৌশলের খেলায় একটি প্রতীকী ক্ষেত্র হিসাবেও কাজ করছে। বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাতের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়াগুলো মিলে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াগুলোর সামঞ্জস্য এবং এর অন্তর্নিহিত মোটিভেশনগুলো, যা তাদের চালিত করে, সে সম্পর্কে অস্বস্তিকর প্রশ্নের জন্ম দেয়।

গাজার ওপর ধূম্রজাল স্থির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক গতিশীলতা এবং ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটের ওপর এর স্থায়ী প্রভাব কী হবে, তা অনিশ্চিত। এ সংঘাতের ছায়া গাজার তাৎক্ষণিক হতাহত ও ধ্বংস ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল কাঠামোয় কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, জনসাধারণের উপলব্ধিতে এবং পরিবর্তনশীল শক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে।

গাল্ফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস

মোহাম্মদ আলরুমাইহি : চিন্তাবিদ, লেখক এবং কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম