Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিপুল সম্ভাবনার গভীর সমুদ্রবন্দর

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিপুল সম্ভাবনার গভীর সমুদ্রবন্দর

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের মূল নিয়ামক হচ্ছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। এ অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি সেতুবন্ধ নির্মিত হয়েছে। ভূ-রাজনীতি বিবেচনায় বাংলাদেশ বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে বেশ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে সমাসীন। বিশ্বরাজনীতির অন্যতম শক্তিমান দেশ চীন এবং আঞ্চলিক শক্তি প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলে উল্লেখিত দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি সমুদ্র তীরবর্তী ও বাণিজ্যবান্ধব দেশ হিসাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে চীন, ভারত, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের গন্তব্য হিসাবে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত। এসব দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে তাদের বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্র হিসাবে গুরুত্ব দিচ্ছে।

এ ধারাবাহিকতায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জায়গা নির্ধারণ এবং এক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রত্যাশাকালে কয়েকটি অর্থনৈতিক শক্তির স্বার্থ নিশ্চিতে, সর্বোপরি বঙ্গোপসাগরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে ব্যাপক কূট-রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল দৃশ্যমান। মূলত চীন, জাপান ও ভারত এর প্রকাশ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। প্রতিবেশী ও উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর অংশীদারত্ব জটিলতায় এক যুগ ধরেই থমকে ছিল গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারত ও চীন আগ্রহী হওয়ায় সরকার ‘ধীরে চলো নীতি’ কৌশল অবলম্বন করে। সব দীর্ঘসূত্রতার অবসান ঘটিয়ে সরকার উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করলে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক মূল্যায়নে ভারত, চীন ও নেদারল্যান্ডসকে পেছনে ফেলে এ মেগা প্রকল্পের দায়িত্ব পায় জাপান। ভারত ও চীনের মতো ক্ষমতাধর দুটি রাষ্ট্রকে আস্থায় নিয়ে জাপানকে দিয়ে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনাকে ব্যবসায়ী নেতারা একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসাবে দেখছেন। তাদের মতে, জাপানের দায়িত্ব পাওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বন্দরের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জেটি নির্মাণ করতে গিয়ে ওই স্থানে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের সম্ভাবতা প্রকাশ করে। তাদের অভিমত ছিল, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জেটি নির্মাণের সঙ্গে তৎসংলগ্ন এলাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা গেলে নির্মাণব্যয়ও হ্রাস পাবে। বস্তুতপক্ষে এ প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে জাইকা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালে জাপান কক্সবাজারের নিকটবর্তী দ্বীপ সোনাদিয়ায় জরিপকাজ সম্পাদন করে তা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের যথোপযুক্ত জায়গা হিসাবে সরকারকে অবহিত করে। তখন থেকেই চীন তাতে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেয়। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরকালে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা থাকলেও কতিপয় রাষ্ট্রের প্রভাবে তা বাধাগ্রস্ত হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, চীন ইতোমধ্যে শ্রীলংকা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারে বন্দর নির্মাণের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ছিল শেষ সূত্র, যা ভারতকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে নিপতিত করবে। দীর্ঘ নীরবতার পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনা বাতিলের ঘোষণা দেয়। উল্লেখ্য, ঘটনা বিশ্লেষণে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সাংবাদিক ইন্দ্রানী বাগচি লিখেছিলেন, সোনাদিয়া পরিকল্পনা বাতিল করা বাংলাদেশের স্পষ্ট কৌশলগত সিদ্ধান্ত। নিঃসন্দেহে তাতে সাহায্য করেছে ভারত, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

কক্সবাজারের মাতারবাড়ী ধলঘাট এলাকায় বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে ১ হাজার ৩১ একর জায়গা নিয়ে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম এ গভীর সমুদ্রবন্দর। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের মেয়াদ হচ্ছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন এবং প্রথম টার্মিনাল কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনীতিতে এ বন্দর নতুন আয়ের উৎস যোগ করার পাশাপাশি বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। হংকং ও সিঙ্গাপুর যেমন তাদের সমুদ্রবন্দর দিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে, বাংলাদেশও সেভাবে একই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের পালে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হবে। এছাড়াও বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে যৌথ অংশীদার হতে না পরলেও বিজনেস হাব বিবেচনায় এ বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও চীন ছাড়াও জাপান, ভুটান ও নেপাল।

নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মাতারবাড়ী বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করবে। এ বন্দরে জোয়ার-ভাটায় যে কোনো সময়ে ৮ হাজার টিইইউএসের জাহাজ ভিড়তে পারবে। শিপিং লাইনগুলো বাংলাদেশে জাহাজ নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুবিধা ভোগ করবে। ফলে পণ্য পরিবহণ খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। বন্দরকে ঘিরে মাতারবাড়ী-মহেশখালী এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়নসহ গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিপুল কর্মসংস্থান এবং দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকসহ পেশাজীবীদের জীবিকার অবারিত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এ বন্দর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে যে লজিস্টিক্স ও সাপ্লাইচেইন ম্যানেজমেন্টের অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি হবে, তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে সহায়ক হবে এবং মাতারবাড়ী-মহেশখালী এলাকায় গড়ে ওঠায় নগরায়ণ এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে পরিণত করবে। এলাকার জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নও হবে দেখার মতো। মাতারবাড়ী নিয়ে আবর্তিত নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ দেশের জিডিপিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে, বর্তমানে এ বন্দরের জেটিগুলোতে ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটবিশিষ্ট জাহাজ বার্থ করতে পারে। এসব জাহাজ সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টিইইউএস কনটেইনার বহন করতে পারে। কিন্তু মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে ৮ হাজার টিইইউএসের বেশি ক্ষমতার কনটেইনারবাহী বড় জাহাজ নোঙর করতে পারবে। এছাড়াও প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সামলাতে জাহাজভাড়া বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। মাদার ভেসেল চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে না পারার কারণে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরে ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্যের চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চালু হলে অনেক কম সময়ে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হবে। সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর থেকে পণ্য পরিবহণ খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমে আসবে। দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হবে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার। বড় ধরনের ফিডার ভেসেল এলে সময় ও খরচ বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে গতি আসবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠবে মাতারবাড়ী। এভাবেই নানামুখী কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়ন ও বিচক্ষণ পরিক্রমায় বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে-এটিই প্রত্যাশা।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম