Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সংকট সন্ধিক্ষণে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা

Icon

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংকট সন্ধিক্ষণে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা

মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে, অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনা শনাক্তকরণ যেমন জরুরি, তেমনই এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, অসংগতি ও অপারগতার দিকটিও আরও বেশি সচেতন, সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনাযোগ্য। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়নসাধন শুধু ভাব-ভাবনার তথা প্রচার-প্রচারণার বিষয় হয়ে থাকলে এবং এ ব্যাপারে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আবশ্যকতার উপলব্ধি যদি অমনোযোগিতার হাতে বন্দি থাকে কিংবা প্রগলভতায় ভিন্ন খাতে প্রবাহের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়, তাহলে স্বপ্ন দেখাই শুধু সার হবে। সংকট সন্ধিক্ষণে সামস্টিক অর্থনীতির সুব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন ভাবনার প্রসঙ্গটি সংগত কারণে যথা মনোযোগ ও সতর্কতার দাবি রাখে।

বছর বিশেক আগে টিআইবির রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছিল, সেসময় অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রাথীরা অতিমাত্রায়, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। মাঠ পর্যায়ে (অর্থাৎ সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে) যারা ভোটপ্রার্থী, তারা ভোটারদের কাছে নিজেদের তুলে ধরবেন এবং ভোটাররা ভোট প্রার্থীদের অতীত ও বর্তমান অবস্থান এবং তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি বাছ-বিচার করে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করবেন, এটিই ধ্রুপদ প্রত্যাশা। কিন্তু ভোটারদের কাছে প্রার্থীর পৌঁছানোর পদ্ধতি প্রক্রিয়াটা যদি হয় অনৈতিক, বিরক্তি ও বিব্রতকর এবং বিশেষ করে এ ব্যাপারে অতিরিক্ত আর্থিক ব্যয় সংশ্লেষের কিংবা রাজনৈতিক উৎকোচ আদান-প্রদানের ব্যাপার ঘটে যায়, তা অবশ্য উদ্বেগজনক। কেননা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রার্থীরা যদি বড় ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ ও পেশি প্রদর্শন করেন, তাহলে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াটি মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আর এ জাতীয় বিচ্যুতির সুদূরপ্রসারী ক্রিয়া-প্রক্রিয়াও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এটি যেন এদেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যে কোনো নির্বাচনে (এমনকি পেশাজীবী সংগঠন সমিতি কিংবা ক্লাবের নির্বাচনে) প্রার্থী ‘সৎ, মেধাবী, যোগ্য, সমাজসেবক’ এসব বিশ্লেষণে বিভূষিত করে নির্বাচনে নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করতে পারলেই ভোটে যেন জিতে যাবেন। সর্বত্র মনে হচ্ছে শুধু ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কে কত খরচ করতে পারবে তার প্রতিযোগিতা চলে। সেসময় ভোটের দুই সপ্তাহ আগেই দেখা গিয়েছিল গোটা মেট্রোপলিটন পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে। এ বাবদ কয়েক হাজার টন কাগজ, কালি, দড়ি-রশি সবই সাবাড় হয়েছিল। কিন্তু কেন? এ বিপুল ব্যয়ের টাকা কোথা থেকে এসেছে এবং পরবর্তীকালে প্রার্থীরা এ খরচ কীভাবে উসুল করতে চাইবেন। মূল প্রশ্নটি সেখানে। একজন প্রার্থীর নিজের ছবিসহ তার মার্কা কী, তা জানানোর জন্য হাজার হাজার পোস্টার বানানো এবং টানানোর প্রয়োজন আছে কি? এর পেছনে যে খরচ, এর আয়ের উৎস এবং তা উসুলে যে পথ পন্থা ধরা হবে তা যে ‘জনসেবামূলক’ হবে না এটা সবাই জানে। অথচ এ পরিমাণ অর্থ গঠনমূলক কোনো কাজে ব্যয় করলে সেটিই হতে পারত আসল সমাজ সেবা।

ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে মূল্যবান ও কারুকার্য সংবলিত আধুনিক সিগন্যাল বাতি বসানো আছে। ডিজিটাল পদ্ধতির এসব সিগন্যাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই বেশি। বাস্তবে দেখা যায়, এগুলোর প্রকৃত ব্যবহার একেবারে নেই। বিপুলসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ তাদের মান্ধাতার আমলের আমলাতান্ত্রিক উপস্থিতি দিয়ে, সম্পূর্ণ অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে, ‘নিজের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি ও বিচার’ মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে চলছে। একদিকে ডিজিটাল সিগন্যাল লাইটও জ্বলছে আবার এর বিপরীত বলয়ে ট্রাফিকের ম্যানুয়াল (ব্যক্তিগত) কসরতও চলছে। এ অব্যবস্থাপনায় শুধু ট্রাফিক পুলিশের নয়, সড়ক ব্যবহারকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের সহস্র শ্রম, ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। মহার্ঘ মূল্যে ক্রয় করা এবং সংস্থাপিত সিগন্যালিং সিস্টেমের ব্যাবহারিক কার্যকারিতা না থাকলেও সেগুলো নিয়মিত জ্বলছে, ইনডিকেশন দিয়ে চলছে এবং সেগুলোর সংস্থাপন ও ব্যবস্থাপনার ব্যয় নিশ্চয়ই এখনো বহন করতে হচ্ছে। এ মশহুর অপচয় ও অপব্যয়, একটি মধ্যম আয়ের খায়েশধারী দেশের জন্য ব্যয়বহুল বালকসুলভ ব্যবস্থা নয় কি?

মধ্যম আয়ের দেশ অভিলাষী একটি দেশে, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আর্থিক ‘অন্তর্ভুক্তির’ দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ পুষ্টিকর ও উপাদেয় এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তা শুধু কথার কথায় বা বিদেশে বিশেষ সেমিনারে স্বীকৃতি ও প্রশংসা প্রাপ্তির মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বিকশিত হতে পারে না। অন্তর্ভুক্তির দর্শনকে সার্বিকভাবে টেকসই ও বাস্তবায়নযোগ্য করা উচিত। প্রশাসনে, আর্থসামাজিক পরিবেশে, সংস্থায়, প্রতিষ্ঠান, দেশজ সংস্কৃতির সর্বত্র পক্ষভুক্তকরণের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচ্যুৎকরণ ব্যবস্থাপনার উপস্থিতিতেই অন্তর্ভুক্তি উন্নয়ন দর্শন যাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে (ক্ষেত্রবিশেষে) বিশেষ প্রাধান্য প্রাপ্তি এবং ব্যাংকিং খাতে অসম্ভব অন্যায়-অনিয়মের প্রতিকার প্রতিবিধানে পক্ষপাতিত্ব কিংবা অপারগতার মধ্যে অন্তর্ভুক্তির মতো কার্যকর দর্শন হারিয়ে যেতে পারে না। শত শত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন কর্মহীন অবস্থায় বসে বসে বেতনভাতাদি আহরণ করতে হচ্ছে, ঊর্ধ্বতন পদে উন্নীত হয়েও স্বপদে কাজ করতে হচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটার কারণে যে ২/৩ গুণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাংকিং খাতে বড় দাগে আত্মসাৎ ও লোপাট হচ্ছে, তা তো যে কোনো বিবেচনায় ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিস প্রডিউস না হয়েও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়’। নানা অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যাহত হলে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে, নানা দুর্ঘটনায়, দুর্নীতিতে, অগ্নিকাণ্ডে, বন্যায় যে বিপুল ক্ষতি হয়, সেটিই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিচ্ছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে, অর্থনীতিকে রাজনীতির বলয় থেকে বের করে আনার অনিবার্যতা অনুভূত হচ্ছে। অর্থনীতির বর্তমান সংকটকে যতই করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং দেশের অভ্যন্তরে নির্বাচন নিয়ে গোলযোগ-বিশৃঙ্খলার পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত বলে প্রচার পাক না কেন, বাংলাদেশের মতো অতি সম্ভাবনাময় উন্নয়নশীল অর্থনীতি, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়া শুরু হয়েছে নানা কারণে করোনার আগে থেকেই। এ মুহূর্তে যা দৃশ্যমান হচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হয়, ভবিষ্যতের রাজনীতি অর্থনীতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। এখনই অর্থনীতির অধোগতিকে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। একটি অর্থনীতি সুস্থ, সবল ও গতিশীল থাকার জন্য বিভিন্ন সূচকের ব্যারোমিটার যেভাবে ওঠানামা করছে তা ক্রমশ হিমাঙ্কের দিকেই চলে যাচ্ছে। এনবিআর (রাজস্ব আহরণ), বাংলাদেশ ব্যাংক (অর্থবাজার তথা ব্যাংকিং সেক্টর), সিকিউরিটিস এক্সচেঞ্জ, কমিশন (পুঁজিবাজার), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের (দ্রব্যমূল্য তদারকি) মতো নিয়ন্ত্রক ও পোষক প্রতিষ্ঠানগুলো ইদানীং তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েও কেন জানি বল ও ব্যাটের সমন্বয় হচ্ছে না। উন্নয়ন ভাবনায় স্বার্থবাদী লুটেরা উপাদানের বাহুল্যে, বল্গাহীন দুর্নীতির অনুপ্রবেশে, জাতীয় চেতনাকে দলীয় চিন্তা ও স্বার্থবাদিতার নিগড়ে নিক্ষেপের কারণে আস্থাহীন পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগ উঠছে। অর্থনীতিতে যে সক্ষমতা গড়ে ওঠার কথা তার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। আয়, বৈষম্য বৃদ্ধি এখন সবখানে বুমেরাং হিসাবে ফিরছে। সর্বত্র সুশাসনের অভাব, জবাবদিহির দৈন্য এবং দুর্নীতির গজেন্দ্রগামিতায় পরিবেশ-পরিস্থিতি উন্নয়নকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। দুর্নীতিই এখন দুর্নীতির উৎস হিসাবে সাব্যস্ত হচ্ছে। দুর্নীতি এখন শুধু আর্থিক লেনদেনে সীমাবদ্ধ নেই, দুর্নীতি এখন ইতিহাস বিকৃতিতে, মুক্তবুদ্ধি, মতপ্রকাশে বাধাদানে, চিন্তাচেতনায় বিভক্তিকরণে, মৌলিক অধিকার হরণে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয় তথা রাজনীতিকীকরণে, রাজনৈতিক উৎকোচের মাধ্যমে কোটারি পোষণ-তোষণেও পরিব্যাপ্ত। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটা বুঝতে হবে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতিই প্রকারান্তরেও সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির দ্যোতক হিসাবে কাজ করে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক, সাবেক সচিব

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম