Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

আমরা কি চার্বাক দর্শন অনুসরণ করছি?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা কি চার্বাক দর্শন অনুসরণ করছি?

সঞ্চয়পত্রের নাম কেউ শুনতে পারে না। অর্থ মন্ত্রণালয় পারে না। উগ্র বাজারপন্থি অর্থনীতিবিদরা পারে না। ব্যাংকাররাও শুনতে পারে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তো বটেই। এরা সবাই সঞ্চয়পত্রের বিরুদ্ধে বহুকাল ধরে। এক্ষেত্রে তাদের ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে তাদের অপছন্দের ফল আমরা এখন পাচ্ছি। ‘সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ধারাবাহিক কমছে’-এ খবর এখন কাগজে আসছে। একটি খবরে দেখলাম, গত সেপ্টেম্বর মাসে ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। বিপরীতে পুরোনো সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হয়েছে ৬ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার। অর্থাৎ যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভাঙানো হয়েছে। এ পরিসংখ্যানের মানে কী? মানে হচ্ছে, মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছে না আগের মতো।

সঞ্চয়পত্র একসময় ছিল সঞ্চয়ের একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সঞ্চয়কারীরা আগে এতে টাকা বিনিয়োগ করত কয়েকটি কারণে। এটা সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ। সরকারকে টাকা ধার দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হওয়ায় এতে মুনাফা একটু বেশি তুলনামূলকভাবে। কিন্তু আজ আর এ অবস্থা নেই। এর বিক্রিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। নানারকম শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। সুদের হার কমানো হয়েছে। উৎসে কর বসানো হয়েছে। বিক্রির সর্বোচ্চ সীমা হ্রাস করা হয়েছে। ‘সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প’ হিসাবে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও এর ওপর ‘ইনকাম ট্যাক্স’ আরোপ করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে এখন আবার ‘ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার’ (টিআইএন) লাগছে। শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ বেচারা সঞ্চয়পত্র। ফলে মানুষ এখন আর সঞ্চয়পত্রের দিকে যেতে চায় না। বিনিয়োগ করতে গিয়ে এত ‘ঝামেলা’-দরকার কী? এতে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় এ সঞ্চয়মাধ্যম ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। কারণ সরকার এটাই চায় বলে প্রতীয়মান।

ঠিক আছে, সঞ্চয়পত্র নেই তো কী হয়েছে? টাকা বিনিয়োগ করার মতো আরও মাধ্যম রয়েছে। জনপ্রিয় একটি মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক আমানত। সুদ পাওয়া যাক আর না যাক, নিরাপদ হোক আর না হোক, আমানতের টাকা ‘লুটেরারা’ লুট করে নিক আর না নিক-টাকা রাখা যেতে পারে ব্যাংকে। রাখা যেতে পারে জমিতে। স্বর্ণ কেনা যায়, ডলার কেনা যায়। বেশ অনেক মাধ্যম আছে। সঞ্চয়ের টাকা থাকলে তা রাখার জায়গা একটা না একটা হবেই। সবচেয়ে বড় কথা, এখন ‘সঞ্চয়’ নিজেই প্রশ্নের সম্মুখীন। কী দরকার সঞ্চয়ের? সঞ্চয় না করে বরং ভোগ করো। খরচ করো। বাজারে (মার্কেট) যাও। উদারভাবে কেনাকাটা করো। ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যাও। দামি দামি হোটেল-মোটেলে দু-একটা রাত কাটাতে ঢাকার বাইরে যাও, পারলে বিদেশ যাও-অন্তত ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে। ঘুরে বেড়াও। দেখো, ভোগ করো। সঞ্চয় দিয়ে কী হবে? দুদিনের সংসার। কিছুই রবে না-এ দুনিয়া হবে ছারখার। অতএব, ভোগ করো, নতুন নতুন জিনিস ক্রয় করো। বর্তমান উগ্র বাজার অর্থনীতির কথা এটাই। এর উদ্দেশ্য মানুষকে ভোক্তা বানানো, ভোগী বানানো। ত্যাগী নয়, জ্ঞানী নয়। এখন ত্যাগী, জ্ঞানীর কোনো মূল্য নেই। সর্বত্রই প্রাধান্য ব্যবসার, বিনিয়োগের, জিডিপির, মাথাপিছু আয়ের। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সফরসঙ্গী হন ব্যবসায়ীরা, বিনিয়োগকারীরা। কবি-সাহিত্যিকের সেখানে জায়গা নেই। এটাই ভোগবাদী সমাজের কথা। কোম্পানি ভালো বেতন দিচ্ছে, গাড়ির ব্যবস্থা আছে, একটি ফ্লাটের ব্যবস্থাও আছে; অতএব, বেতন পাওয়ার পর চলে যাও হোটেল-মোটেলে।

বাজার অর্থনীতির উদ্দেশ্য-কেউ যাতে বেতনের টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে না পারে। সবাই যাতে খরচ করতে উদ্বুদ্ধ হয়-নতুন নতুন পণ্য। আকর্ষণীয় সব পণ্য। পণ্য যতটুকু না আকর্ষণীয়, তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় এর ‘প্যাকেজিং’। দারুণ প্যাকেজিং ব্যবস্থা। খাও-দাও ফুর্তি করো। প্রশ্ন, টাকা, অফুরন্ত টাকা আসবে কোত্থেকে? চিন্তা নেই, টাকার ব্যবস্থা আমাদের এ অঞ্চলের বিখ্যাত দার্শনিক ‘চার্বাক’ করে গেছেন ২৫০০ বছর আগে। তিনি বলেছেন, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’। অর্থাৎ ঋণ করে হলেও ঘি খাও। যতদিন এ পৃথিবীতে বেঁচে আছো, ততদিন সুখের মধ্যে বাঁচো। আড়াই হাজার বছর আগের কথা, ভাবা যায়! এখন পরিষ্কার, বাজার অর্থনীতির নামে পশ্চিমারা চার্বাকের যে মডেল অনুসরণ করে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে, আমরা এখন সেই অবস্থায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। সব আয়োজন থালায় ভোগের জন্য। সর্বত্র ভোগের আয়োজন। নতুন নতুন অনুষ্ঠান। যেমন ‘ফাদার্স ডে’, ‘মাদার্স ডে’। প্রশ্ন, বাঙালির আবার ‘ফাদার্স ডে’, ‘মাদার্স ডে’ কী? আমরা তো বাবা-মাকে নিয়ে একসঙ্গে একই পরিবারে থাকি। সুখে-দুঃখে আমরা এক। বাবা-মা আমাদের পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, স্বস্তি, চিকিৎসা ইত্যাদি সবই ছেলেমেয়েদের হাতে। বাবা-মায়ের পা ছুঁয়ে অফিসে যাওয়া, আবার ফেরত এসে বাবা-মায়ের কুশল সংবাদ নেওয়া। এ পারিবারিক ব্যবস্থায় ‘ফাদার্স ডে’, ‘মাদার্স ডে’ কী? প্রতিদিনই আমাদের জন্য ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে। পশ্চিমাদের জন্য, মার্কিনিদের জন্য তা দরকার। তারা পরিবার ভেঙে দিয়েছে। যেন পরিবার হচ্ছে জামা-কাপড়ের মতো। ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী মিলে যে পারিবারিক বন্ধনে আমরা বেড়ে উঠি, তা তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। ‘বিবাহ’ ব্যবস্থা তারা নষ্ট করে দিয়েছে। এর ফল তারা পাচ্ছে। এখন শোনা যায় তারা ‘পরিবার’ খুঁজে বের করছে।

এই যে অনুষ্ঠানের পর নতুন অনুষ্ঠানের জন্ম দেওয়া, ‘অকেশন’ সৃষ্টি করে আনন্দ-ফুর্তি করা, খাওয়া-দাওয়া করা-এসব ভোগবাদী সমাজের আবিষ্কার। এর জন্য অর্থ/ক্যাশ লাগে। ক্যাশ না থাকলেও কোনো দুশ্চিন্তা নেই; ‘ক্রেডিটে’র ব্যবস্থা আছে, ঋণের ব্যবস্থা আছে। টাকা ব্যাংকে থাকলে তার জন্য ‘ডেবিট’ কার্ড, না থাকলে করো ক্রেডিট কার্ড। ‘স্পেন্ড’। এটা খরচ হবে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। সমস্যা নেই। পরে পরিশোধ করা যাবে। বস্তুত ক্যাশ উঠেই যাচ্ছে ওইসব দেশে। তারা বলছে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’। ‘ক্যাশ’ যেহেতু নেই, তাই এর কাজ ‘কার্ড’ অধিগ্রহণ করছে। চলছে পরিশোধ ‘ক্রেডিট কার্ডের’ মাধ্যমে। মানে লোন, লোন, আর লোন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লোনের ব্যবস্থা। লেখাপড়া করতে হবে, লোন নাও। একটা গাড়ি কিনতে হবে, লোন নাও। বাড়ি ক্রয়ের জন্যও লোন নাও। আর্থিক সামর্থ্য নেই তো কী হয়েছে? নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে তারা লোন দেবে, ক্রেডিট দেবে। চলবে কেনাবেচার কাজ। জন্ম থেকে মৃত্যু। শোনা যায়, সবচেয়ে ধনী দেশ আমেরিকার নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি ‘ঋণী’। একদম আমাদের দার্শনিক ‘চার্বাকের’ শিষ্য।

প্রশ্ন, ঋণ ভালো, না ক্যাশ ব্যবস্থা ভালো? যে আয় আছে তার মধ্য থেকে খরচ করা ভালো, না ঋণ করে খরচ করা ভালো? এ প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন, সমাজ ও দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের বাঙালির সমাজ ঋণকে প্রাধান্য দেয় না। ঋণভিত্তিক নয়। গ্রামের লোকেরা এখনো বাধ্য না হলে ঋণ নেয় না। ঋণকে তারা বোঝা মনে করে। ঋণ করে মারা যাওয়ার বিষয়টাকে তারা সহজভাবে নেয় না। আমাদের সমাজ, রীতি-নীতি ভোগবাদী নয়, যদিও ইদানীং প্রবণতা ভোগের দিকে। আমরা আউল-বাউল, লালন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, হাছন রাজা, মাইজভাণ্ডারির উত্তরসূরি। আমরা সঞ্চয়ী লোক। বিপদের দিনের জন্য সঞ্চয় করা দরকার। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, মা-পিসি-মাসিরা সঞ্চয় করছেন। মাটির ব্যাংক ছিল ঘরে ঘরে। সঞ্চয় করো। এ থেকেই ব্যাংকের হিসাবের নাম ‘সঞ্চয়ী হিসাব’, সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। আস্তে আস্তে এতে টাকা জমাত। প্রয়োজনে খরচ করত। বিপদের বন্ধু এ সঞ্চয়। অসুখ-বিসুখে, সুখে-আনন্দে এ টাকা কাজে লাগে। এর থেকেই হলো ‘সঞ্চয়পত্র’। বিভিন্ন মেয়াদের সঞ্চয়পত্র। এর মাধ্যমে সঞ্চয় করার ব্যবস্থা। এখন আমাদের এসব সঞ্চয়ের কথা ভুলে যেতে হবে। উগ্র বাজার অর্থনীতি আমাদের চারদিক থেকে ভোগী হওয়ার কথা বলছে। ভোগ করতে, বেশি বেশি খরচ করতে বলছে। টাকা জমানোর কোনো প্রয়োজন নেই। দিনরাত পরিশ্রম করো, টেনশনে ভোগো, টাকা রোজগার করো, আর খরচ করো। পকেটে ক্যাশ নেই, ক্রেডিট কার্ড আছে। ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য এ কার্ড। আবার মূলধনী জিনিসপত্র কেনার জন্যও ক্রেডিটের ব্যবস্থা আছে। ভালো-মন্দের বিষয় নয়।

আমরা ভোগবাদের দিকে ঝুঁকছি। পশ্চিমাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। এখানে সঞ্চয়ের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? সঞ্চয়পত্রের দরকার কী? ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে, ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা রাখলে ব্যাংককে উলটো ‘চার্জ’ দিতে হবে। সবই সম্ভব! কিন্তু এ সবের বিপরীতে দেখা যাচ্ছে আরেক চিত্র-বৈষম্য বৃদ্ধি, দূষিত পরিবেশ, খাদ্যে ভেজাল, বায়ুদূষণ, সামাজিক অস্থিরতা!

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম