Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাংলাদেশ এক ঝড় পাড়ি দিচ্ছে

Icon

ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ এক ঝড় পাড়ি দিচ্ছে

বাংলাদেশকে এখনো একটি শিশুরাষ্ট্র বলা চলে, যদিও ২০২১ সালে তার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়েছে। দেশটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সেটি সহজ নয়। গণহত্যা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ এবং উগ্র ইসলামপন্থিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি দেশটির অগ্রগতিকে বারবার ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনৈতিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ সবকিছুই মোকাবিলা করে চলেছে এবং ক্রমেই এসব ক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপকতা অর্জন করেছে। এজন্য প্রয়োজন হয়েছে সাহস ও শক্তিশালী নেতৃত্ব। বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভিশন ছিল এবং তা অটল রয়েছে। এটা তারা একা করেনি। বিশ্ব-পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অনেক বন্ধু ও সহযোগী রয়েছে। সম্প্রতি অপতথ্য-অপপ্রচার এবং উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তি ছড়ানোর কর্মকাণ্ড জাতিটির গায়ে কালিমালেপনের হুমকি দিয়েছে, যদিও এই জাতি মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সবকটি সূচক পূরণ করেছে।

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকার মধ্য দিয়ে। অনেক মূল্যে এসেছে স্বাধীনতা। পাকিস্তান এবং তার উগ্রবাদী ইসলামিস্ট সহযোগীরা দেশটিকে ধ্বংসলীলার মাধ্যমে প্রায় নিঃশেষ করার অপচেষ্টা করেছিল। এটা এড়ানো যেত যদি জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো দুর্জন ব্যক্তিরা শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে দিত। কিন্তু পাকিস্তান দেশে গণতন্ত্রকে নিজ গতিতে চলায় বাধা দিয়েছে। কারণ বাংলার জনগণ এবং তাদের সংস্কৃতির প্রতি তারা ঘৃণা পোষণ করত। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের হিন্দুপ্রবণ মনে করত। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের অব্যবহিত পর পাকিস্তান বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি। জিহাদ ছিল তাদের অস্ত্র। সে সংকটের সমাপ্তি ঘটে ১০ কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া, ৩০ লাখ প্রাণহানি এবং লাখ লাখ মহিলার সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর উগ্রপন্থি ও পেশি শক্তিধারীরা সংখ্যালঘুদের জীবন নরকে পরিণত করছে। বাংলাদেশ এর ইতি টানার চেষ্টা করছে। তবে পুলিশের শক্ত নজরদারি ছাড়া বিষয়টি অসম্ভব হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ভীতি আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধের পর যারা দেশটি ঘুরে দেখেছে, তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, দেশটা পরিণত হয়েছিল এক দৃশ্যমান নরককুণ্ডে। মূল্যবান সবকিছুই ধ্বংস করা হয়েছিল। সবকিছুই আর্টিলারি আর মেশিনগানের আঘাতে জর্জরিত হয় কিংবা ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়। নতুন জাতি হিসাবে বাংলাদেশকে পুনঃনির্মাণ ও সমাজ পুনর্বাসনের বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। রক্তবন্যা ও বিপদসংকুল পরিস্থিতির শেষে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় দারিদ্র্য দেশ হিসাবে তার যাত্রা শুরু করে।

কয়েক দশক পর বাংলাদেশ পরিচিত হয়েছে উন্নয়নের ‘ছোট ইঞ্জিন হিসাবে’ তার সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করার দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে। সেই নাম বহাল থেকেছে। তারপর আজ তাকে এশিয়ার বাঘ বা ভবিষ্যৎ/উদীয়মান অর্থনৈতিক সক্ষমতার কেন্দ্র মনে করা হয়। বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্র ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-দেশের পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা হিসাবে অনুসৃত হয়ে চলেছে। অর্থনীতিতেও সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশের অব্যাহত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্ব নেতাদের আশ্চর্যান্বিত ও উদ্দীপিত করেছে। এ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ওপর গুরুত্ব বাংলাদেশের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এ প্রশংসা সত্যি বাংলাদেশের প্রাপ্য।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয় বিশ্বে এক আলোকবর্তিকা হিসাবে। তার মূল্যবোধ ও সংবিধান এমন একটি জাতির চিত্র তুলে ধরে, যা জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ প্রত্যাশী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে বিশ্বের ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম উদ্বাস্তুর ভার বহন করে চলেছে দেশটি। ২০১৭ সালে, পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করে রোহিঙ্গারা। তাদের আশ্রয়দানের জন্য বাংলাদেশ উদার চিত্তে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সমর্থনে যথেষ্ট সহযোগিতা করছে না।

বিকৃতি-বিভ্রান্তি মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন তার অসামান্য অর্জনগাথা তুলে ধরা। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে সমালোচনাকারী দেশগুলোর উদ্বেগ বাংলাদেশকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন। তবে তা নিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জও করা প্রয়োজন সাহসিকতার সঙ্গে। এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, নিজস্ব বক্তব্য তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশকে প্রায়ই বেগ পেতে হয়েছে। পাঠক হেড লাইনের বেশি পড়তে চায় না। আমরা জানি, ইকনোমিস্ট ও আল জাজিরা কুয়োতে বিষ ঢালার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল চালু হওয়ার পর থেকে। ইকনোমিস্ট প্রমাণ ছাড়া দাবি তুলে বলেছে ‘২০০৮ সাল থেকে ভারতীয় বস্তাভর্তি টাকা ও পরামর্শ সহায়তায় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পর’ হয়তো দেশে একটা অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির নকশা ছিল। এটা বাংলাদেশে উগ্রবাদীদের নিয়ে খেলা করার শামিল, যারা ভারতকে আঞ্চলিক অংশীদার হিসাবে নয় বরং এক হুমকি হিসাবে দেখে। লেখাটি বেনামি ছিল এবং লেখক ও উৎসের নামের অভাব লক্ষণীয় ছিল, অথচ লেখাটিতে যে ঢালাও কালিমালেপন করা হয়েছে, সেজন্য কোনোরূপ ক্ষমা চাওয়া হয়নি এবং সত্যিকার প্রমাণও তুলে ধরা হয়নি। বাকস্বাধীনতা মিথ্যানির্ভর হতে পারে না। ইকোনমিস্টের আচরণ ভালো কোনো উদাহরণ স্থাপন করতে পারে না। এমন পরিবেশেই বাংলাদেশ চলছে।

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের প্রতি অত্যুৎসুক নাকগলানোমূলক আচরণের উদাহরণের একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত বৈশ্বিক সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সময়ে। ২০১৫ সালে ঢাকায় পাকিস্তানি কূটনীতিক আল-কায়দা সহযোগীদের লজিস্টিকস ও অর্থ প্রদানকালে ধরা পড়ে। এ উগ্রবাদীগোষ্ঠী বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিবাদী সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর হামলা করেছিল। পাকিস্তানের কার্যকলাপের নিন্দা করার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র হামলার শিকারদের যথেষ্ট সুরক্ষা প্রদান না করার দোষে বাংলাদেশকে দায়ী করে। এতে বাংলাদেশের অনেকেই অন্যত্র সহযোগী খোঁজে। সেই আস্থাও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সে জন্য সময় লাগবে এবং বাংলাদেশে আস্থারমাত্রা বাড়াতে হবে।

এসব বিষয় বাংলাদেশ যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়নি। কারণ, যখনই বাংলাদেশ ব্যাখ্যা প্রদান করতে গেছে, জনগণ তখন তা পিছে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। এতে শ্রদ্ধাবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক লড়াই পরিচালিত হয় প্রায়ই লন্ডন ও ওয়াশিংটনে, ঢাকায় নয়। আমরা ভিয়েনা কূটনৈতিক কনভেনশনের লঙ্ঘন বলে দাবি করতে পারি, কিন্তু বাস্তবতা হলো জগৎ এখন বিশ্বায়িত। আমরা সবাই একজন আরেকজনের বিষয়ে নাক গলাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, পশ্চিমা সরকার কর্তৃক প্রদর্শিত দক্ষিণ এশিয়ায় এ বিপজ্জনক ও অশ্রদ্ধার প্রবণতা বাংলাদেশে অকার্যকর ও হিংস্র রাজনীতি যুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যরা যদি হাওয়া ভবন চক্রান্তের জন্য বিএনপি নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করত, যেখানে তারা ওসামা বিন লাদেনের হুজি গ্রুপকে দিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের বিরোধী দলীয়দের হত্যা করেছে, তাহলে হয়তো আমরা লন্ডন থেকে জুম সেশনের মাধ্যমে বিএনপিকে দল পরিচালনা করতে দেখতাম না। তাহলে হয়তো বিএনপি পরাজয়ের আঘাত সয়ে সংস্কারের দিকে এগোত। এটা এক জটিল ও হয়রানিমূলক অবস্থা, এর সংশোধন প্রয়োজন।

আমরা আরও দেখেছি বিদেশি লবিং কীভাবে বাংলাদেশের সাফল্য ও কৃতিত্বকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিকৃত করার অপচেষ্টা করে। বিএনপির সরকারবিরোধী ধাক্কার সমর্থনে আন্তর্জাতিক সাহায্য আদায়ের চেষ্টায় মানবাধিকারের রক্ষাকারী কাজের কেন্দ্রে রয়েছে কাতারের আলজাজিরা; বাড়াচ্ছে আগুন; ন্যারেটিভ আর বৈশ্বিক ডিসকোর্সকে বিকৃত, বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে।

একথা ঠিক, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও পুলিশ নিয়ে সমস্যা আছে। কিন্তু লবিস্টরা ছড়াচ্ছে যে, বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়া হয়ে যাছে। এটি একেবারেই এক অলীক তুলনা। বিদেশি আইনজীবী ও লবিস্টদের উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি ও বিভ্রান্তিকে চ্যালেঞ্জ করার দরকার আছে। কেননা এটা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভীত এবং নিরুৎসাহিত করছে। আর উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের রাজনীতিকদের টেনে আনছে মিথ্যা এবং বিভ্রান্ত কাহিনি বা আখ্যানের ঘেরাটোপে।

স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের অনেক কিছু নিয়েই বিজয়োৎসব করার আছে। দেশটি আজ এক শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ২০৪১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যমুক্ত অগ্রগামী অর্থনীতির প্রচেষ্টায় এগোনোর পথে চ্যালেঞ্জ অনেক কঠিন, তবে দুর্লঙ্ঘ্য নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস আগেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা প্রমাণ করেছে কীভাবে শক্তিশালী নেতৃত্ব, সুষ্ঠু নীতিনির্ধারণ এবং দৃঢ় সংকল্প দেশকে এগিয়ে নিতে পারে।

আমরা সবাই বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আমরা চাই রাজনীতি হোক চিন্তার দ্বন্দ্ব, রাজপথে রক্তাক্ত সংঘর্ষ নয়। সে জায়গায় পৌঁছতে জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক আলোচনার দরকার। আমার আস্থা আছে বাংলাদেশ সেটা অর্জনে সক্ষম হবে। সে অর্জনের পথে আসা সব বাধাকে তারা হয় লাথি মেরে নিচে ফেলে দিয়েছে, নয় লাফ দিয়ে তা অতিক্রম করেছে। দেশের রাজনীতির অবকাঠামো বিনির্মাণ করা এক বিশাল কাজ। যুক্তরাষ্ট্র আজও ট্র্যাম্প রেজিমের ধাক্কায় খাবি খাচ্ছে। উদারপন্থিরা গগনবিদারি চিৎকার করছে গণতন্ত্র শেষ হলো বলে। আমাদের সবারই সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ যে ব্যাপক ও কঠিন কাজ করেছে, সেজন্য তাকে তার স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং সেটা তার প্রাপ্য। সেজন্য প্রয়োজন শিরোনামের পরেও পড়া। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা যে মূল্যবোধের অংশীদার, উদযাপন করা। অতএব, আত্মশক্তি ও মূল্যবোধের ওপর জোর দিন। শিশু-গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত জটিলতার ওপর নয়। কেউ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাইলে এটা নিশ্চিত করুন যে, তার ইতিহাস আপনারা পড়েছেন।

গ্লোবাল অর্ডার থেকে অনুবাদ : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. রাশিদ আসকারী

ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন : যুক্তরাজ্যভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার লেখক এবং কাউন্টার টেরোরিজম ও নিরাপত্তা গবেষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম