Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দায় নিন, সংকট উত্তরণে এগিয়ে আসুন

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দায় নিন, সংকট উত্তরণে এগিয়ে আসুন

বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে কেন নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া অব্যাহত রয়েছে, তার কারণ অজানা নয়। সরকার এ বক্তব্য গ্রহণ না করলেও অতীতে এর চেয়েও কম জটিল পরিস্থিতিতে তারা একই ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠায় তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সে লক্ষ্য অর্জিত হলে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর তারা ফিরে আসে রাষ্ট্রক্ষমতায়। তেমন সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে তারা ক্ষমতায় যেতে পারত কি না, এ প্রশ্ন তোলা হলে কী উত্তর আসবে?

এটাও ঠিক, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ওই সরকার আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া প্রশাসনের খোলনলচে পালটে দিতে প্রথম প্রহর থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করে। আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেও দেখানো হয় কঠোর মনোভাব। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এসব করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তখনো রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে। দলটির পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের’ অভিযোগ তুলে তখন রাষ্ট্রপতির কাছেও যাওয়া হয়েছিল; কিন্তু প্রত্যাশিত প্রতিকার তারা পায়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাংক’ বলে পরিচিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরও বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটে। নির্বাচনে বিএনপি জোটের বিপুল বিজয়ের পর এসব আরও বেড়ে যেতে দেখা যায়।

এখন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে বিএনপি যখন নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড়, তখন ক্ষমতাসীনরা ২০০১-এর অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টায় আছেন, ওই অভিজ্ঞতা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দলনিরপেক্ষ নয়। তারা আসে আগের রাজনৈতিক সরকারের রেখে যাওয়া প্রশাসন ও দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তাতে সদ্য ক্ষমতা ছেড়ে আসা দলটি হয়ে পড়ে আরও অজনপ্রিয়।

এদিকে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত সরকার পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহারের লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নেয় বলেও জোরালো বক্তব্য রয়েছে। নির্বাচন কমিশনও তারা গঠন করেছিলেন পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়ে, যারা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে বিতর্কিত হন। বিএনপি মনোনীত রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নিজেই হয়ে যান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তার দলীয় আনুগত্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। তখন বিরোধী দলের আন্দোলনও ছিল জোরালো। তাতে সহিংসতা হয় রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে। সে অবস্থায় সেনা হস্তক্ষেপ ঘটে এবং জাতীয় জীবনে আসে নজিরবিহীন ‘ওয়ান-ইলেভেন’।

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে পরিস্থিতি এমন ঝুঁকিপূর্ণ দিকে চলে যেতে পারে, এটি কেউ ভাবতে পারেননি। তবে ওয়ান-ইলেভেনে আসা সরকারকে আওয়ামী লীগ তার ‘আন্দোলনের ফসল’ বলে অভিহিত করেছিল। নতুন উপদেষ্টা পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তারা যোগ দেন নিজেদের আংশিক বিজয় উদ্যাপন করতে। সে সরকার অবশ্য নির্ধারিত তিন মাসের বদলে দুই বছরের মতো সময় অতিবাহিত করে একটি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেয়। ‘সংস্কারমুখী’ বলে পরিচিত ওই সরকারের কর্মকাণ্ডে ক্ষমতা ছেড়ে আসা বিএনপিই হয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিএনপিকে ‘ক্যান্টনমেন্ট থেকে গঠিত’ বলে অভিহিত করা হলেও ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী ঘটনাবলির চাপ প্রধানত যায় এ দলের ওপর দিয়ে। একটি ক্ষতিগ্রস্ত ও কোণঠাসা দল হিসাবে অভিযোগ করতে করতে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে খারাপভাবে পরাজিত হয়। ৩০টি আসন পায় দলটি এবং প্রাপ্ত ভোটও কমে যায়। পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক, মাত্র ৩০ আসন লাভের মতো দল বিএনপি ছিল না, এ প্রশ্নে কম মানুষই বিতর্ক করবে। তা সত্ত্বেও দলটি ওই ফল মেনে নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে গিয়ে বসে।

নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন অংশীজনের ভূমিকা নিয়ে যত অভিযোগই উঠুক-আমরা লক্ষ করব, ২০০১ বা ২০০৮-এর নির্বাচন প্রধান কোনো দলই বর্জন করেনি। এর ফল পুরো প্রত্যাখ্যান করে সংসদে গিয়ে বসা থেকেও বিরত হয়নি পরাজিত পক্ষ। বিরোধী দলের অংশগ্রহণে সংসদ কতটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল, সে প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। তাদের সে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কি না, এ প্রশ্নও উঠতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এ পর্যন্ত চারটি নির্বাচন হলেও শেষের দুটির কথা এখানে আলাদাভাবে তোলা হলো এজন্য যে, ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রসঙ্গ এলে এ দুটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে তাদের সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যেও প্রশ্ন কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন সম্ভবত ছিল ১৯৯১ সালেরটি। সংবিধানের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হলেও তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। এর ভেতর দিয়ে আমরা জনপ্রতিধিত্বশীল সরকারের মাধ্যমে শাসিত হওয়ার নতুন কালপর্বে প্রবেশ করি। সে কারণেও ওই নির্বাচনের গুরুত্ব বিরাট। এর ভেতর দিয়ে এটিও প্রমাণ হয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছাপ্রসূত সমঝোতা অনেক সময় সংবিধানের নির্দেশনার চেয়েও গুরুত্ববহ হয়ে উঠতে পারে। তাতে দেশের সিংহভাগ মানুষের ইচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে কি না, সেটাই বড় বিষয়। বর্তমান সংকট উত্তরণেও ওই দৃষ্টান্ত অনুসৃত হতে পারে কি না, কেউ সে প্রশ্ন তুললে অবাক হওয়া যাবে না।

নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের বিধান আর সংবিধানে নেই, সেটিও সবার জানা। বিধানটি যখন করা হয়-তখন কেউ বলেনি, এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বরং এমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে কয়েকটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে হতে আমরা নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্যভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বীকৃত ব্যবস্থাটি গড়ে তুলব। তখন আর অনির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন হবে না। বাস্তবে দেখা গেল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটিরও অপব্যবহার করতে আমরা লেগে গেলাম। এটা ঘিরে সাংবিধানিক শূন্যতায় পড়ার মতো ঘটনাও ঘটল, যা ছিল বিপজ্জনক। নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকাও পক্ষপাতদুষ্ট হতে শুরু করেছে বলে অভিযোগ উঠতে লাগল। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও উঠতে থাকল প্রশ্ন।

এ অবস্থায় একটি বিকল্পই হাতে ছিল। তা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি দূর করা। সে উদ্যোগই কিন্তু নেওয়া হয় ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ শাসনামলে। সংসদীয় কমিটি দীর্ঘদিন আলোচনা করে তেমন প্রস্তাবই পেশ করে। পরে অকস্মাৎ ঘটনা চলে যায় অন্যদিকে। সংস্কারের বদলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলেরই উদ্যোগ নেওয়া হয়। উচ্চ আদালত থেকেও এর পক্ষে রায় আসে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রায়ে এমন অভিমতও ব্যক্ত করা হয় যে, জাতীয় সংসদ চাইলে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। কিন্তু সংসদের চাওয়াটা তো নির্ভর করে সরকারি দলের চাওয়ার ওপর।

এরপর আমরা দেখি দলীয় সরকারের অধীনে একটি একতরফা এবং আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়ে সরকারের বদল না ঘটতে। এদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়নি আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে জয়ী হয়নি। এ চিত্রও অনেক কথা বলে। ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত হয়েই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হবে কি না, এ প্রশ্ন অবশ্য কেউ কেউ তোলেন। গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়ে থাকে এবং তাতে ক্ষমতাসীন দল কখনো পুনর্নির্বাচিত হয় না, তা নয়। সেটি নিয়ে বিতর্ক উঠতেও দেখা যায় না। বিতর্ক উঠলেও অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে দেখা যায় কি? বাংলাদেশে এটি ঘটেছে এজন্য যে, এখানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা খারাপ। বিগত দুটি নির্বাচনের ঘটনাবলি এত খারাপ যে, খোদ সরকারকে এখন বলতে হচ্ছে-আগামী নির্বাচনে এর পুনরাবৃত্তি হবে না। বাংলাদেশে মানসম্মত নির্বাচন ও গণতন্ত্র দেখতে আগ্রহী পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মহলের কাছেও সরকার এ প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল কিন্তু অংশ নিয়েছিল এমন প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করেই। তাতে কী ফল হয়েছে, সেটি সবার জানা। ওটা কিন্তু ছিল একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সংসদ গঠন করে গণতন্ত্র চর্চার দিকে যাওয়ার সুযোগ। সেটি নেওয়া গেলে আজ হয়তো নির্বাচন আয়োজন নিয়ে এতটা অনাস্থার সৃষ্টি হতো না। নির্বাচনব্যবস্থার কিছু জরুরি সংস্কারও হয়তো এরই মধ্যে করে নেওয়া যেত। সেটি হয়নি বলে বর্তমান সংকট উত্তরণে নতুন পথ খোঁজা যাবে না, তাও নয়। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা সবকিছুর পরও ভালো বলেই কিন্তু এর দাবিটা সামনে এসেছে। সেটি ফিরিয়ে আনতেই হবে, তা নয়। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সব মহলে তথা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখার বদলে সেটি আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বের চোখেও আগামী নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হতে হবে। দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে তা বিদেশেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে সহজেই। এটি হলো চ্যালেঞ্জ। এর দায় যাদের বেশি, তাদেরই সংকট উত্তরণে বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম