শতফুল ফুটতে দাও
অবহেলার অন্ধকারে নিমজ্জিত উন্নয়ন
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল রেলওয়ে। রেলের পর যে মাধ্যমটি যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হতো তা ছিল নৌপথ। সড়কপথে যাতায়াত হতো না বললেই চলে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে সড়কপথ উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অসংখ্য নদনদী ও খালবিল। আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে সড়কপথে খুব সামান্যই যাতায়াত করেছি। যখন কলেজে পড়তাম, তখন সড়কপথে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য একটি সংস্থা গঠন করা হয়। এ সংস্থাটির নাম ছিল ইপিআরটিসি বা ইস্ট পাকিস্তান রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন। এ সংস্থাটি এখনো আছে। সংস্থাটির বর্তমান নাম বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন বা বিআরটিসি। ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম নগরীতে বাসে চলাচল করার জন্য ইপিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করেছে। ইপিআরটিসির সবুজ রঙের বাসগুলো দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ভাড়াও ছিল যৎসামান্য। দুআনা, চারআনা ভাড়ায় অনেক পথ যাওয়া যেত। বাসে যাত্রীর চাপ কম থাকায় চলাফেরা করা আরামদায়ক ছিল। প্রায় একই সময়ে ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যে ইপিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করে। দিনে চারবার বাস ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যে যাতায়াত করত। সে সময়ে ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যে বাস সার্ভিস বজায় রাখার জন্য চারটি স্থানে ফেরিতে বাস পারাপার করত। ফলে যাতায়াতে সময় লাগত বেশি। সে সময় দূরপাল্লার বাস সার্ভিস ছিল না বললেই চলে।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার পিতার কর্মস্থল ছিল কুমিল্লায়। ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যে যাতায়াতের জন্য তুলনামূলকভাবে বাসের চেয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করাই বেশি পছন্দের ছিল। সে সময় চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে একটি মেইল সার্ভিস চালু ছিল, যার নামকরণ করা হয়েছিল ‘গ্রিন অ্যারো’। ঢাকা-কুমিল্লা যাতায়াতের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি গ্রিন অ্যারো বেছে নিতাম।
উপমহাদেশে রেলওয়ে নির্মাণ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বন্দর রেলওয়ে দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছিল। রেলওয়ে নির্মাণে ব্রিটিশ সরকারকে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। রাজ কোষাগারে এ অর্থ আসত ব্রিটিশ শাসকদের প্রজাকুল প্রদত্ত খাজনা ও কর থেকে। রেলওয়ে নির্মাণে ব্রিটিশ শাসকদের আগ্রহের পেছনে দুটি বিষয় কাজ করেছে। সাম্রাজ্যে সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমনের জন্য দ্রুতগতিতে বিদ্রোহস্থলে সৈন্যসামন্ত পাঠাতে হতো। এ কাজটি করতে রেল যোগাযোগ চমৎকারভাবে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া ভারতে উৎপাদিত কাঁচামাল ও পণ্যসামগ্রী ব্রিটেন ও পাশ্চাত্যের অন্য দেশগুলোতে পাঠানোর জন্য ভারতের রেলব্যবস্থা ব্যবহার করা হতো। রেলব্যবস্থার মাধ্যমেই ভারতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পণ্যসামগ্রী ও কাঁচামাল কলকাতা, চেন্নাই, মুম্বাই, করাচি ইত্যাদি সমুদ্রবন্দরে নিয়ে আসা হতো। সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্যসামগ্রী জাহাজযোগে পাশ্চাত্যে প্রেরণ করা হতো।
শোষণ ও শাসন বজায় রাখার জন্য যে রেলওয়ে ব্যবস্থা ব্রিটিশ শাসকরা ভারতে গড়ে তুলেছিল, তা ভারতের পরিবর্তনহীন নিশ্চল সমাজে পরিবর্তনের তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশ শাসকরা যখন ভারতকে উপনিবেশে রূপান্তর ঘটিয়েছিল, তখন ভারতের গ্রামগুলো ছিল অন্যসব গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন খুদে প্রজাতন্ত্রের মতো। সমাজতত্ত্ববিদরা ওই সময়কার ভারতীয় গ্রামের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করতে গিয়ে গ্রামগুলোকে ‘লিটল রিপাবলিক’ বলে চিহ্নিত করেছিল। স্বনির্ভর এ গ্রামগুলো যুগের পর যুগ ধরে নিজের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা খুব একটা অনুভূত হয়নি। ব্যতিক্রম ঘটত দেশীয় সম্রাটদের সৈন্য বাহিনী যখন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সৈন্য পাঠাত। ব্রিটিশ শাসকরা রেলব্যবস্থা চালু করলে ভারতের সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে বিদ্যমান গ্রামগুলো স্পন্দিত হতে শুরু করে। মানুষ ধীরে ধীরে গ্রামের গণ্ডির বাইরে এসে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে চলাফেরা শুরু করে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আমাদের সামাজিক চালচিত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তনের সূচনা হয়। যানবাহনে প্রচণ্ড ভিড়ের সৃষ্টি হয়। বাস ও ট্রেনে, এমনকি নদীপথে লঞ্চে যাতায়াতে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের ফলে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। হঠাৎ করে দেশের অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষের যাতায়াত খুব বেড়ে যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে ওঠা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সামান্য উপার্জনের জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গমনাগমন বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। এ ধরনের অর্থনৈতিক অভিঘাত আজও অব্যাহত আছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সড়কপথে যাতায়াত ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ও বিকাশ হয়েছে। এখন সড়কপথে চলাচলের জন্য বিভিন্ন আয় গোষ্ঠীর মানুষের উপযোগী যানবাহন পাওয়া যাচ্ছে। তবে সড়ক যোগাযোগে সুশাসন না থাকায় অনেক যথেচ্ছাচারের ঘটনাও ঘটছে। নানা অজুহাতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সড়কপথে দুর্ঘটনাও বেড়ে চলেছে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রেলওয়ে ব্যবস্থার নিদারুণ অবনতি ঘটেছে। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ অবহেলা, অদক্ষতা, ও দুর্নীতি গোটা রেল বিভাগকে অচল করে দিচ্ছে। এই অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলো হলো লোকোমোটিভ, রেলট্র্যাক ও রেলের বগি। উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে দুটি ভালো ওয়ার্কশপ পেয়েছে। এগুলো হলো পাহাড়তলি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এবং সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। এসব ওয়ার্কশপে বেশকিছুসংখ্যক দক্ষ মেকানিক ছিল। তাদের অনেকেই ছিল বিহারি মুসলমান। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর জাতিগত দ্বন্দ্বের ফলে তারা কর্মস্থল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দক্ষ রেল শ্রমিক ও মেকানিকের অভাবে রেলের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। যে শ্রমিকরা কর্মস্থল ত্যাগে বাধ্য হয়, তাদের মধ্যে অনেকে কর্ম নৈতিকতা ও দক্ষতাগুণে যোগ্য ছিল। উচিত ছিল তাদের কাছ থেকে সার্ভিস নেওয়ার পলিসি গ্রহণ করা। এতে শেষ বিচারে দেশ উপকৃত হতো।
রেলব্যবস্থায় বিভিন্ন সময়ে টাকার অঙ্কে বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়েছে, কিন্তু রেল জীর্ণদশা ও লোকসান থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। সময়ের পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় দেখা যায় পুরোনো নিয়মকানুনে রাষ্ট্রের কোনো একটি অঙ্গ চালানো যাচ্ছে না। তখন প্রয়োজন হয় উদ্ভূত সমস্যার আলোকে পরিচালন ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন। দুঃখের বিষয় হলো, রেলের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনার জন্য যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। রেলে দুর্নীতি কোন পর্যায়ে চলে গেছে তা জানা যায় গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি বিশাল প্রতিবেদন থেকে। এ প্রতিবেদন থেকে ধারণা করা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেভাবে বালিশ-কাণ্ড হয়েছিল, প্রায় সেভাবে রেলের দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম হলো ‘১৯ হাজার টাকার যন্ত্র রেল কিনেছে ৩ লাখে’। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলওয়ের ১৫টি কার্যালয়ের কেনাকাটায় সরকারের ১১ কোটি ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৪২৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। দুর্নীতির ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তা যদি না হতো তাহলে এ টাকায় আরও অনেক বেশি কাজ করা সম্ভব হতো। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লাইনচ্যুত ট্রেনের চাকা বা দেবে যাওয়া রেললাইন উপরের দিকে তুলতে যে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয়, সেটি ‘লিফটিং জ্যাক’ নামে পরিচিত। এ ধরনের একটি যন্ত্র ভারত থেকে আমদানি করলে খরচ পড়ে প্রায় ১৯ হাজার টাকা। কিন্তু এই যন্ত্র ঠিকাদারের কাছ থেকে রেলওয়ে কিনেছে ৩ লাখ টাকায়। এ রকম যন্ত্র রেলওয়ে কিনেছে ১২টি। একইভাবে ৬৫ হাজার টাকার একটি ড্রিলিং মেশিন (লোহার পাত ছিদ্র করার যন্ত্র) কেনা হয়েছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকায়। প্রতিটি ড্রিলিং মেশিন কিনতে বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫ গুণ টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বাজারমূল্যের চেয়ে ৮ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে আরেকটি যন্ত্র, যার নাম ‘কাটিং ডিস্ক’ (দেখতে চাকতির মতো, লোহার পাত কাটার যন্ত্র)। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের একটি শাখা রয়েছে চট্টগ্রামে, যা জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণের কার্যালয় হিসাবে পরিচিত (আর অ্যান্ড আই শাখা)। এ শাখার একটি কক্ষ মেরামতের নামে মালামাল কেনাকাটা দেখিয়ে ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা তছরুপ (আত্মসাৎ) করা হয়েছে। মোট ৫৪ ধরনের মালামাল কেনার নামে কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা মিলে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। টাকা আত্মসাতের এসব ঘটনা সিএজির গত জুন মাসের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে আরও যে কয়টি সাবহেডিং আছে তা হলো, ‘সাড়ে ১৮ লাখ টাকার যন্ত্র কেনা হয় ২ কোটি টাকায়’, ‘ওয়াকিটকি কেনা হয় ৫ গুণ বেশি দামে’, ‘মালামাল সরবরাহ না করে অর্থ আত্মসাৎ’ এবং ‘পূর্বাঞ্চলের মতো পশ্চিমাঞ্চলেও কেনাকাটায় অনিয়ম’।
বাংলাদেশের রেলব্যবস্থা অনিয়ম ও দুর্নীতির জাঁতাকলে পড়ে ধুঁকছে। সরকার বিদেশ থেকে বেশ কিছুসংখ্যক লোকোমোটিভ ও যাত্রীবাহী বগি কিনছে। রেলব্যবস্থার অভ্যন্তরে এত দুর্নীতি থাকলে বিদেশ থেকে আমদানি করা লোকোমোটিভ ও বগিগুলো অচিরেই যে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। নিকট দূরত্বে চলাচলের জন্য চীন থেকে ডেমু ট্রেন আমদানি করা হয়েছিল। এ ট্রেনগুলো বেশিদিন চলতে পারেনি। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, এগুলো এখন পরিত্যক্ত। এ ট্রেনগুলো আমদানি করার জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়েছিল, তা উঠে এসেছে কিনা সন্দেহ আছে। ডেমু ট্রেনগুলো আবার ট্র্যাকে চালানোর উপযোগী করার জন্য চীনা কোম্পানির সঙ্গে নেগোশিয়েট করা যেত না? কেন জানি এদেশে সব কিছুতেই দুঃখজনক অবহেলা। অবহেলার সংস্কৃতি বন্ধ না হলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অনুন্নয়নের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ