শতফুল ফুটতে দাও
ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হবে
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটবর্তী কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করেছেন। তবে এই এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত গিয়ে সমাপ্ত হবে। সুতরাং এই এক্সপ্রেসওয়ের কাজ অনেকটাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
২০১৫ সালে শুরু হওয়া উড়াল সড়ক প্রকল্পের মেয়াদ ছিল সাড়ে তিন বছর। পরে বারবার এর মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। দফায় দফায় নকশা পালটে র্যাম্প যোগ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মাহামারির মধ্যেও নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়নি। এরপরও দীর্ঘ আট বছরে অর্ধেক অংশ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ। বাকি কাজ আগামী বছরের জুনে শেষ হবে-এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ অতিরিক্ত র্যাম্প নির্মাণ বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক হলেও এটি প্রকল্পের মূল লক্ষ্য যানবাহনের দ্রুতগতি ব্যাহত করতে পারে। সেজন্য র্যাম্প কমানোর বিষয়টি এখন আলোচনায় রয়েছে। এটি হালনাগাদ করতে গেলে বাড়তি সময়ের দরকার হবে সন্দেহ নেই। কাওলা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়ক নির্মিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে। এতে ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি ঢাকা। এর মধ্যে সরকার বহন করছে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। তিন ধাপে প্রকল্পটি সম্পন্ন হচ্ছে। প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৬৩.২০ শতাংশ।
প্রকল্পটি পুরোপুরি সম্পন্ন না হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করলেন ২ সেপ্টেম্বর। উন্নয়নশীল দেশে প্রেস্টিজ প্রজেক্ট বলে একটি কথা চালু আছে। বিশাল চোখ ধাঁধানো অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলো সরকারের জন্য মর্যাদাপূর্ণ প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে সরকার জনপ্রিয়তার দিক থেকে উচ্চতর আসনে সমাসীন হতে পারে। এ কারণেই প্রকল্পটি পুরোপুরি সম্পন্ন না হওয়া সত্ত্বেও উদ্বোধন করা হয়েছে। নির্বাচন আসছে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে সাফল্য দেখাতে হবে। সাফল্য দেখানোর তাগিদ থেকেই অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো ‘প্রেস্টিজ প্রজেক্ট’ নিয়ে মেতে ওঠে। এ ধরনের প্রজেক্ট খুবই দৃশ্যমান হয়। এগুলো সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। দৃষ্টিকাড়া এসব প্রকল্প দেশের মানুষের মধ্যে সরকারের জন্য মানসিক দুর্বলতা সৃষ্টি করে। এতে নির্বাচনে ভোট আকৃষ্ট করতে সুবিধা হয়। তবে এসব দৃশ্যমান চোখ ধাঁধানো প্রকল্পের তুলনায় কিছু প্রকল্প আছে, যেগুলো সহজে চোখে পড়ে না, কিন্তু দেশকে উন্নয়নের সড়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই লাগসই। বিশেষ করে মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়, সেগুলো উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি এবং টেকসই অবদান রাখে। মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক প্রকল্প সাদামাটা চোখে ধরা পড়ে না। সেজন্য অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো দৃশ্যমান অবকাঠামো প্রকল্প নিয়ে মেতে থাকে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রয়াস দৃশ্যমান মেগা প্রকল্প নিয়ে মেতে উঠেছে। সীমিত সম্পদ কোথায় ব্যয় করলে সর্বাধিক কল্যাণ পাওয়া যেতে পারে, সে রকম বিবেচনা থেকেই প্রকল্প নির্বাচন করতে হয়। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করার পেছনে যে চিন্তা কাজ করছে তা হলো, ঢাকা নগরীর দমবন্ধ করা যানজট থেকে মুক্তি অর্জন। বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যানজট সামাল দিতে পারবে না। যানজটের সমস্যাটি বৃহত্তর ক্যানভাসে বিশ্লেষণ করতে হবে। এ নগরমুখী অভিবাসন যতদিন অব্যাহত থাকবে, ততদিন যানজটের অবসান হবে বলে আশা করা যায় না। পৃথিবীর বেশকিছু শহরে যানজটের সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের নিকটবর্তী দেশ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে একসময় অসহনীয় যানজট ছিল। এ সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ব্যাংককে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়। এক্সপ্রেসওয়েগুলো চালু হলে যানজট অনেকটাই হ্রাস পায়। কিন্তু বছর কয়েক যাওয়ার পর পুরোনো যানজটের সমস্যা আবার ফিরে এসেছে। কারণ গ্রাম থেকে শহরমুখী অভিবাসন ক্রমপুঞ্জীভূত হয়ে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে প্রাপ্ত সুবিধা ক্রমেই হারিয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, যানজটের সমস্যার সমাধান নির্ভর করছে দেশের অভ্যন্তরে মাইগ্রেশনের বা অভিবাসনের গতিপ্রকৃতির ওপর।
রাজধানী ঢাকায় দুর্ভোগের অন্ত নেই। এ দুর্ভোগের গভীরে রয়েছে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ। প্রতিনিয়ত এ চাপ বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। রাজনীতির মাঠে অনেক বক্তৃতা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধানের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এটাই হলো এ নগরীর ট্র্যাজেডি। গত দুই সেপ্টেম্বর শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিআই) ঢাকা নগরীর সমস্যা নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, ‘ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বাংলাদেশের টেকসই নগরায়ণ।’ এ সেমিনারে যেসব তথ্য উঠে এসেছে তা রীতিমতো ভয়াবহ!
সেমিনারে উত্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দেশের মোট আয়তনের এক শতাংশ (১,৫২৮ বর্গকিলোমিটার) ভূমি নিয়ে ঢাকা মহানগর এলাকা গঠিত। অথচ দেশের নগর জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ ঢাকায় বাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর ভিটেমাটিছাড়া হয় ৭ লাখ মানুষ, যাদের বেশির ভাগ আশ্রয় নেয় ঢাকা শহরে। কেবল ঢাকায়, সবকিছু ঢাকাতেই এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার ফলে যানজট, পানিদূষণ ও বায়ুদূষণে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মানুষের বহু কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায় যানজটের নিশ্চলতায়। এছাড়া বেড়েই চলেছে জ্বালানি ব্যয় ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তার অনেকটাই ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানার পাশাপাশি শিক্ষা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা শহরে কেন্দ্রীভূত। ঢাকার অবস্থা এমন কেন হলো তা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায় নোবেল বিজয়ী সুইডিশ অর্থনীতিবিদ গুনার মির্ডাল-এর তত্ত্ব দিয়ে। একটি দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে একটি এলাকা সমৃদ্ধ হয় এবং অন্য এলাকাগুলো রক্তশূন্য হয়ে যায়, তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি দুই ধরনের কারণের কথা বলেছেন। এর একটি Back wash effect এবং অন্যটি হলো Spread effect! Back wash effect হলো এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, যার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেধা, পুঁজি এবং অন্যান্য সম্পদ গড়িয়ে আসে দেশের একটি বা দুটি এলাকায়। ঢাকায় যারা চিকিৎসাসেবা দেন তারা এসেছেন দেশের অন্য এলাকা থেকে। একই কথা প্রযোজ্য অন্য পেশা এবং ট্রেডের ক্ষেত্রে। ঢাকায় যে পুঁজি বিনিয়োগ হয়, তার উৎস প্রধানত ঢাকার বাইরে থেকে। ঢাকায় ছুটে আসে পরিবহণ শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক এবং মোটরযান শ্রমিক। বেশির ভাগ যারা আসে তারা আসে কেবল দুটি হাত ও দুটি পা নিয়ে। অচিরেই এরা চেষ্টা করে কোনো একটি বৃত্তির জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠতে এবং তা-ই তারা হয়। এছাড়া আমরা আরও দেখি নানা ধরনের হকার ও খুদে ব্যবসায়ী। চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় ক্ষমতা রয়েছে ঢাকায়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নানা ধরনের সম্পদ শুষে জড়ো হয় ঢাকায় এসে। এটাই হলো ঢাকার Back wash effect. হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে খাদ্যশস্য, সবজি, মাছ, মুরগি, পশু ঢাকায় আসে দেশের আপেক্ষিকভাবে অনুন্নত এলাকা থেকে। গ্রামে মাছের চাষ করে এমন একজন ব্যক্তি তার সন্তানের লেখাপড়ার জন্য অথবা রুজি-রোজগারের জন্য ঢাকাকেই বেছে নিতে চায়। গুনার মির্ডাল যে Spread effect-এর কথা বলেছেন তা হলো, বাজার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঢাকায় যে চাহিদার সৃষ্টি হয়, তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদনমূলক প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এভাবে সম্পৎশালী ঢাকা তার সম্পদের কিছু অংশ অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়। এটাই হলো Spread effect. তবে এ মুহূর্তে ঢাকার Back wash effect Spread effect-এর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। এ কারণেই ঢাকা হয়ে পড়েছে ‘আনম্যানেজেবল’। এভাবেই ঢাকার সমস্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের দেওয়া এক হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ১১তম। কিন্তু আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘন শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। দ্বিতীয় ঘনবসতিপূর্ণ শহর মুম্বাইয়ে বাস করে ৩২ হাজার ৪০০ জন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ মানুষ। বিগত দিনগুলোয় ঢাকামুখী জনস্রোত আরও প্রবল হয়েছে।
ইতোমধ্যে ঢাকার জীবন অনেকটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য Back wash effect ঠেকিয়ে দিতে হবে। উন্নয়নকে ঢাকামুখী প্রবণতা থেকে মুক্ত করার জন্য বিশাল আকারে বিকেন্দ্রীকরণের পথে হাঁটতে হবে। মফস্বল এলাকায় যতগুলো জেলা আছে, সেসব জেলায় পরিকল্পিত উপায়ে উন্নয়ন উদ্যোগ সৃষ্টিকারী প্রয়াসগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। যদি প্রত্যেক জেলায় কিছু কিছু উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, তাহলে ঢাকামুখী ছাত্রছাত্রীদের স্রোত হ্রাস পেতে শুরু করবে। এভাবেই উন্নয়ন প্রয়াসগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে ঢাকার বাইরে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ