চেতনায় বুদ্বুদ
ড. ইউনূসের মামলায় ৪০ ও ১৬০
বদিউর রহমান
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
‘ড. ইউনূসকে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে’ শিরোনামে ১৯ মার্চ ২০১১ এবং ‘গর্ব ও গ্লানির সংমিশ্রণ’ শিরোনামে ২৩ নভেম্বর ২০১৩ যুগান্তরে দুটি লেখা লিখেছিলাম। তাকে নিয়ে আবারও লিখব এমনটি আমার ভাবনায় ছিল না। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক ঘটনা পরম্পরায় তাকে নিয়ে একবার আমার টেলিভিশন টকশোতে কথা বলতে হয়েছে, এখন আবার লিখতেও হচ্ছে।
দানকর নিয়ে টেলিভশনে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মামলার প্রেক্ষাপটে আলোচনাটি হয়। ৪০ জন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের এক বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আমার অভিমত জানতে চাওয়া হয়েছিল।
আমি তখন সরাসরি টিভি টকশোতে যা বলেছিলাম, তার সারকথা ছিল ৪০ কেন, ৪০০ জনও যদি বিবৃতি দেন, তাতেও কিছু হবে না, কারণ রাজস্ব বোর্ড আয়করের মামলা করার আগে সাত-পাঁচ অনেক ভাবে, আইনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে থাকে। ঘটনার পেছনে সারবস্তু না থেকে থাকলে রাজস্ব বোর্ড অবশ্যই এমন একজন বিশ্ববিখ্যাত এবং আমাদের গর্ব নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করত না।
আইন নিজস্ব গতিতে চলবে, কোনো বিবৃতিতে মামলার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। ওই মামলায় ড. ইউনূসকে কর পরিশোধ করতে হয়েছে, তিনি মামলায় জিততে পারেননি, রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে রায় হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে নির্ধারিত বয়সের বেশি বয়সেও অধিষ্ঠিত থাকা নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত লড়েছেন এবং শেষতক হেরেছেন।
আমার খুব খারাপ লেগেছে এজন্য যে, ড. ইউনূস তো কোনো আমজনতার একজন নন, তিনি নোবেল বিজয়ী, তা-ও শান্তিতে এবং আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত; কিন্তু তিনি কেন নিয়মের বাইরে অধিক বয়সেও এমডি পদ আঁকড়ে ধরে থাকবেন। তাকে আমার তখন অপ্রয়োজনীয়ভাবে লোভী মনে হয়েছে। আমার শুধু মনে হয়, অনেকে কোনো পদে নিজেকে অপরিহার্য মনে করে থাকেন, ভাবেন তিনি না হলে বোধহয় ওই পদ আর চলবে না। কিন্তু এমনজন কখনো ভাবেন না যে, তিনি তো মরণশীল, একদিন তো মরে যাবেন, তখন কি ওই পদ কেউ চালাবে না?
কে ভালো চালাবেন আর কে খারাপ চালাবেন, তা তো আপেক্ষিক ব্যাপার, কিন্তু কোনো পদেই কেউ অপরিহার্য নন। হ্যাঁ, তর্ক হতে পারে যে, ওই একজন থাকলে হয়তো আরও একটু ভালো চলত। সেক্ষেত্রে তেমন দক্ষ ব্যক্তির তো উচিত তাড়াতাড়ি তার যোগ্য উত্তরসূরি গড়ে তোলা। দীর্ঘ চাকরিজীবনে এমন ‘অপরিহার্য-মনা’ কত কত হামবড়াকে দেখলাম, অথচ তারা চলে যাওয়ার পরও পদটি বেশ ভালোই চলেছে। এমন অনেক ‘অপরিহার্য-মনা’ শেষতক অসম্মানিত হয়েই বিদায় হয়েছেন, যেমনটি ঘটেছে গ্রামীণের এমডি পদ থেকে ড. ইউনূসের বিদায়ে।
গত ২৯ আগস্ট যুগান্তর প্রথম পৃষ্ঠায় খবর ছেপেছে ‘প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি ইউনূসের মামলা স্থগিত চান ১৬০ বিশ্বনেতা’। একই তারিখে প্রথম আলোর শেষ পাতায় বেশ বড় শিরোনামে ‘প্রধানমন্ত্রীকে শতাধিক নোবেল বিজয়ীর খোলা চিঠি’তে ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে উদ্বেগের খবর হয়েছে। এতে দেখা যায়, এ শতাধিক নোবেল বিজয়ীর মধ্যে ১৪ জন শান্তিতে, ২৮ জন রসায়নে, ২৯ জন চিকিৎসাশাস্ত্রে, ২২ জন পদার্থবিজ্ঞানে, ৪ জন সাহিত্যে এবং ৭ জন অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী।
হিসাব মতো ইউনূসের মামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশকারী খোলা চিঠিদাতাদের মধ্যে ১০৪ জনই নোবেল বিজয়ী। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান সিজিয়ন পিআর নিউজওয়্যার তাদের ওয়েবসাইটে এ চিঠি প্রকাশ করেছে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘন ও দুর্নীতির মামলা নিয়েই তারা উদ্বেগ জানিয়েছেন এবং তারা অবিলম্বে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতেরও আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তারা উল্লেখ করেছেন যে, ড. ইউনূসকে নিশানা (টার্গেট) করা হয়েছে এবং ধারাবাহিক বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন তিনি। ড. ইউনূসের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ৪০ জন বিশ্বনেতা আগে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান চিঠি।
নোবেলজয়ীরাসহ চিঠিদাতার সংখ্যা ১৬০-এর অধিক, বাংলাদেশের নাকি ৩৪ জন নেতাও চিঠিতে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। চিঠির সঙ্গে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাতে বিশ্বের জনগণকে ‘কল টু অ্যাকশন’ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। খবরে এ-ও জানা গেল যে, ড. ইউনূসের বিচার চলার দিন ৩১ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসের আন্তর্জাতিক সংস্করণে পূর্ণ পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন হিসাবে চিঠিটি প্রকাশিত হয়।
স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনসহ আরও মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সামরিক কমান্ডারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা রয়েছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, ১৬০ জনের অধিক গণ্যমান্য ব্যক্তির, যাদের মধ্যে ১০৪ জনই নোবেল বিজয়ী, স্বাক্ষর সংগ্রহে এবং তাদের সবাইকে একটা চিঠির জন্য একত্রিতকরণে একটা মহাযজ্ঞই হয়েছে। এমন একটা চিঠি বিশ্বে অবশ্যই রেকর্ড-সৃষ্টিকারী, হয়তো গিনেজবুকেও স্থান পাওয়ার যোগ্য একটা ঘটনা। কিন্তু বড় প্রশ্ন জাগে, এর উদ্যোক্তা কে বা কারা? নিশ্চয়ই বিদেশি কেউ বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থা এবং মামলা নিয়ে নিজ থেকে এমন একটা বিষয়ে উদ্যোগ নেননি ডা. ইউনূসের জন্য।
কোনো লবিস্ট ফার্ম এটা করে থাকতে পারে। সেখানেও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ড. ইউনূসের সরাসরি সম্পৃক্ততা না থেকে থাকলে এমনটা হওয়া অবশ্যই অস্বাভাবিক। ড. ইউনূসের নোবেলজয়ে হিলারির ভূমিকা ছিল মর্মে আমরা আগেও শুনেছি। হিলারির কোনো ফাউন্ডেশনে ইউনূসের বিরাট অঙ্কের অর্থদানের কথাও আমরা আগে শুনেছিলাম।
হিলারিরা ইউনূসের বন্ধু। কার্যক্ষেত্রে বান কি মুনের সঙ্গেও ইউনূসের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা যায়। হিলারির সঙ্গে বারাক ওবামা এসে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, কেননা ওবামারই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হিলারি। আর ড. ইউনূসের পক্ষে অন্যান্য নোবেলজয়ীকে একত্র করাও সংগত কারণেই সম্ভব। অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও ড. ইউনূসের সঙ্গে কোনো-না কোনোভাবে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট। অতএব, লবিস্ট দিয়েই হোক, কিংবা নিজ উদ্যোগেই হোক, ড. ইউনূসই এমন একটা চিঠির সুচারু সম্পাদন করতে সফল হয়েছেন বলা যায়। আগের ৪০ জনের চিঠিরও একই সূত্রে এবং একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে বোঝা যায়। ব্যক্তি ইউনূস এতে সায় না দিলে কার এমন দায় পড়েছে যে, বাংলাদেশের বিচারিক বিষয় নিয়ে এভাবে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি দেবেন? আমরা এখন এ চিঠির বিষয়ে আমাদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে চাই। এক. ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা দানকর মামলাটি ইতোমধ্যে নিষ্পন্ন, তিনি করের টাকা জমাও দিয়ে দিয়েছেন।
শ্রম আদালতের মামলাটি বিচারাধীন। বিচারাধীন একটা মামলা স্থগিতের জন্য কোন আইনের কোন বিধানে এত বরেণ্য ব্যক্তিরা অনুরোধ করলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। তারা বড়জোর স্বচ্ছতার স্বার্থে ইউনূসের পক্ষে মামলার কাগজপত্র চাইতে পারতেন। তাদের নিজেদের আইনি সহায়তাও না হয় দিতে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারতেন।
কিন্তু মামলা স্থগিতের অনুরোধ কি একটা স্বাধীন দেশের বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের শামিল নয়? দুই. তারা বিচারের আগে কীভাবে মন্তব্য করতে পারেন যে, তার (ইউনূসের) বিরুদ্ধে শ্রম আইন ও দুদকের যেসব মামলা চলছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে তার দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এমন মন্তব্য কি সাবজুডিস নয়? তিন. ড. ইউনূস নোবেলজয়ী, সামাজিক ব্যবস্থায় বিশ্বখ্যাতির অধিকারী, তাই বলে কি তিনি বাংলাদেশের আইনের ঊর্ধ্বে? বাংলাদেশে তো দুর্নীতির জন্য এক রাষ্ট্রপতিরও (এরশাদ) শাস্তি হয়েছে, এক প্রধানমন্ত্রীরও (খালেদা জিয়ার) শাস্তি হয়েছে, এক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি/স্পিকারও টাকা ফেরত দিয়েছেন (জমির উদ্দিন সরকার)। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার যদি বাংলাদেশে বিচারের আওতায় এসে থাকতে পারেন, তাহলে ড. ইউনূস কেন আসবেন না? খোদ এক সাবেক প্রধান বিচারপতিও (এস কে সিনহা) তো ধরা খেয়েছেন।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ড. ইউনূস আগে থেকেই সমালোচিত। তার গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ নিয়েও যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে। আমরা রাজনৈতিক অঙ্গনে ইউনূসের খোলা চিঠিতে বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম যে, তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত মান উন্নয়নে হয়তো ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু সেখান থেকে পিছু হটে আমাদের হতাশ করেছেন তিনি। এক-এগারোর সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবেও তাকেই নাকি প্রথম পছন্দ করেছিল কুশীলবরা, কিন্তু তিনি নিজে ওই পদে কেন এলেন না, আমরা বুঝলাম না।
ওই পদে এসেও তো তিনি একটা গুণগত পরিবর্তন করতে পারতেন। তিনি তখনো আমাদের হতাশ করলেন, তিনি সুপারিশ নাকি করে দিলেন ড. ফখরুদ্দীনের নাম। মেরুদণ্ডহীন ফখরুদ্দীন সাহসী কোনো কাজই করতে পারলেন না। আবার গ্রামীণের এমডি পদে অযথা নিয়ম ভঙ্গ করে থেকেও তিনি আমাদের হতাশ করলেন। এখন মামলায় তিনি লড়বেন-এটাই আইনের বিধান, যেমন তিনি লড়েছেন রাজস্ব বোর্ডের দানকর মামলায়। আইনিভাবে না লড়ে কেন যে তিনি এভাবে খোলা চিঠি আনাচ্ছেন এবং আমাদের অসম্মানিত করছেন তা আমরা অনুমানও করতে পারছি না। বাইরে এমনও শোনা যায় যে, আবার কোনো অস্বাভাবিক সরকারের সৃষ্টি হলে তিনি নাকি আর সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। গুঞ্জন আর গুজবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই না।
কিন্তু আমরা এটা তো চাইতে পারি যে, তিনি তো আমাদের দেশের গর্ব, তিনি অবশ্যই আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী লড়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন।
অযথা বিশ্ববরেণ্য বা স্বগোত্রীয় নোবেলজয়ীদের দিয়ে খোলা চিঠির তদবির করে তিনি নিজেকে আর হেয় প্রমাণিত করবেন না-এটাই আমাদের বিনীত অনুরোধ তার কাছে। আমরা তাকে গ্লানিতে দেখতে চাই না, গর্ব ও গ্লানির সংমিশ্রণেও না, আমরা তাকে শুধু আমাদের গর্বের আসনেই দেখতে চাই।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান