Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও অপচয় রোধ সময়ের দাবি

Icon

বশিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও অপচয় রোধ সময়ের দাবি

বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে ১ হাজার ১১৯ জন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। জাতিসংঘের প্রাক্কলন অনুসারে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ কোটি ৩০ লাখ। অপরদিকে প্রতিবছরই রাস্তাঘাট উন্নয়নের নামে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।

অনেক জায়গাতেই চির চেনা ফসলের খেত আড়াল করে ফেলছে নতুন নতুন আবাসন, কলকারখানা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ইটের ভাটা। ফলস্বরূপ, যে রাস্তার দুপাশে একসময় দেখা যেত কেবলই ফসলের খেত, সেই রাস্তার দুপাশে এখন দেখা যায় নানা অবকাঠামো। অথচ কৃষি জমি সুরক্ষা আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে কৃষিজমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মানুষ মনে করছে, আমাদের কৃষি সঠিক পথেই এগোচ্ছে। একদিকে জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে কৃষিজমি কমে যাওয়া-এ দুই প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার অসামান্য কাজটি করে চলছেন আমাদের কৃষক ও কৃষিবিদরা। কিন্তু কথা হলো, আগামী দিনে কেমন হবে আমাদের কৃষি? কারণ আমাদের অর্থনীতি এখনো নির্ধারিত হয়ে থাকে কৃষির উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর। অথচ কৃষক ও তার আবাদযোগ্য জমির পেছনের খবর নিয়ে আমাদের কারও কোনো মাথাব্যথা দেখা যায় না।

মনে আছে, একটা সময় চালের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির থাকার কারণে ‘ভাতের ওপর চাপ কমান, বেশি করে আলু খান’ এ রকম একটা স্লোগান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আবার গরিব মানুষের খাবারের মূল উপাদান ছিল গমের আটার রুটি, আর সচ্ছল মানুষ খেত ভাত। কিন্তু পরে পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। পুষ্টি বেশি বিবেচনায় রুটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আর বর্তমানে স্বাস্থ্যসচেতনতা, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব, রুচির পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। গবেষকরা দাবি করছেন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং ক্যানসার বেশি হচ্ছে। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে সেই হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মানুষের খাদ্য গ্রহণে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের প্রধান খাবার ভাতের ওপর নির্ভরতা কিছুটা কমেছে। তবে মোট খাদ্য গ্রহণের হার সামান্য বেড়েছে। অন্যদিকে ডাল, শাকসবজি, মাংস ও ফল খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। জরিপে দেখানো হয়, ২০১৬ সালে ভাত গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৩৬৭ দশমিক ০২ গ্রাম, যা ২০২২ সালে কমে দাঁড়ায় ৩২৯ গ্রামে। ২০১৬ সালে আটা গ্রহণের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৮ গ্রাম, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ গ্রামে। এর ফলে খাদ্যে ক্যালরি ও প্রোটিন গ্রহণের হারও কিছুটা বেড়েছে। ২০১৬ সালে মোট ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল দৈনিক ২২১০ দশমিক ৪ কিলো ক্যালরি, যা ২০২২-তে দাঁড়িয়েছে ২৩৯৩ কিলো ক্যালরিতে। প্রোটিন গ্রহণের হার ২০১০-এ ছিল ৬৬ দশমিক ২৬ গ্রাম, ২০১৬ সালে ৬৩ দশমিক ৮০ গ্রাম এবং ২০২২ সালে ৭২ দশমিক ৫ গ্রাম।

আমরা প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩৫০ গ্রাম ভাত খাচ্ছি, সেখানে পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ ২০০ গ্রামের বেশি ভাত খায় না। জাপানিদের প্রধান খাবার ভাত হলেও তারা আমাদের চেয়ে অনেক কম ভাত খায়। অনেকে আবার সুশি আর শাকসবজি খেয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়, যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করা একেবারেই অসম্ভব। আমাদেরও ভাতের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য হিসাবে ধীরে ধীরে আলু বা অন্য কোনো ধরনের শর্করাজাতীয় খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হতে হবে। চালের বিকল্প হিসাবে ভুট্টা, গম ও আলুর বিকল্প ইয়াম, কাসাভার চাষে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

দেশের কৃষক সম্প্রদায়কে এসব কৃষিপণ্যের আবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। দিতে হবে কৃষিঋণ সহায়তা। বিকল্প খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যয় চালের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম না হলে মানুষ ভাতের বিকল্প খাদ্য হিসাবে সহজে তা গ্রহণ করবে না। সবচেয়ে বড় কথা, প্রধান খাদ্য হিসাবে দেশের জনগণ ভাত, আলু বা অন্য যা কিছু গ্রহণ করুক না কেন, তা থাকতে হবে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার মধ্যে। আর দেশের সাধারণ মানুষকে ভাতের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। যখন চালের চেয়ে আটার দাম কম থাকে, তখন ভাতের বদলে আটার রুটি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। ভাতের বিকল্প না হলেও সম্পূরক খাদ্য হিসাবে আলু পেতে পারে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা।

এছাড়া আমাদের দেশের বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে মিনিকেট, নাজিরশাইল কিংবা মোটা চালে। বাস্তবতা হলো, এসব নামের কোনো ধানের আবাদ যেমন দেশের কোথাও হয় না, তেমনি এগুলো কেউ আমদানিও করে না। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের ধানের মাঠ আর বাজার সয়লাব থাকে ব্রি ধানে, কিন্তু বাজারে ব্রি চাল নামে কোনো চালের অস্তিত্বই নেই। আবার দেশে এখন বিপুল পরিমাণ হাইব্রিড ধান উৎপাদিত হলেও বাজারে হাইব্রিড ধানের চাল বা হাইব্রিড চাল বলে কিছু পাওয়া যায় না। যেহেতু মিনিকেট আর নাজিরশাইলে বাজারগুলো সয়লাব, তাই এগুলো দিয়ে খাদ্যাভ্যাস কীভাবে পরিবর্তন করা যায় সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।

মিনিকেট, নাজিরশাইল চাল নিয়ে মোহাম্মদপুরের চাল ব্যবসায়ী কবিরুল হোসেনের সঙ্গে আমার দীর্ঘ কথা হয়। আলাচারিতায় তিনি জানান, অধিকাংশ ক্রেতা এসে সর্বপ্রথম মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইল চালের কথা জিজ্ঞেস করে। তারপর তার চাহিদা অনুযায়ী চাল কিনে থাকে। যে বিষয়টির ব্যাপারে তিনি বেশি গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন তা হলো, যে ক্রেতা মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইল চাল কেনে, সে সারা বছরই মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইল কিনে থাকে। এর ফলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের কথা বিবেচনা করে সারা বছরই মিনিকেট কিংবা নাজিরশাইল চাল বাজারজাত করে থাকে।

আবার বেশি দামের আশায় অনেক বড় বড় কোম্পানি প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত গুদামজাত করেও রাখে। এ ব্যবসায়ী বলছেন, ফলস্বরূপ চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। চালের দাম পরিবর্তন রাখার ব্যাপারে তিনি বলছেন, একজন ক্রেতা যদি বোরো মৌসুমে মিনিকেট, আমন মৌসুমে নাজিরশাইল আর আউশ মৌসুমে অন্য চাল ক্রয় করে, তাহলে বিক্রেতা এক মৌসুমের চাল অন্য মৌসুমে বিক্রি করতে পারবে না। ফলে বিক্রেতা এক মৌসুমের চাল সেই মৌসুমে বিক্রি করবে। এতে চালের দাম অনেকাংশে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেটে’ ৩৬ জন বিজ্ঞানী একটি দল, যেখানে কৃষি থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সেই সঙ্গে পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা ছিলেন, বাড়তি জনগোষ্ঠীর খাবারের জোগান নিশ্চিত করতে তারা গবেষণাটি করেন যেন সব জায়গায় এ খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আনা যায়। টানা দু’বছর গবেষণার করে বলছেন-আমরা যেসব খাবারে আমাদের প্লেট ভরিয়ে রাখি, সেখানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার। তাদের পরামর্শ হলো, মাংসের পরিমাণ কমিয়ে বিকল্প প্রোটিনের উৎস খুঁজতে হবে। যেসব পুষ্টিকর খাবার আমরা এড়িয়ে যেতে চাই, সেগুলোর প্রতি আগ্রহ জন্মানোর ওপরও তারা জোর দেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেউ যদি প্রতিদিন মাংস খায়, তাহলে তার ডায়েটে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি। তার মানে এই নয় যে, সে আর মাংসই খাবে না। মাংস খাবে, তবে পরিমিত হারে। যেমন-লাল মাংসের কোনো খাবার, যেমন বার্গার যদি খেতেই হয়, তাহলে সেটা সপ্তাহে একদিন খাবে। এছাড়া সপ্তাহের অন্য আরেক দিন মাছ বা মুরগির মাংস দিয়ে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে পারে। আর বাকি দিনগুলোতে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে হবে বিভিন্ন উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে। এক্ষেত্রে গবেষকরা প্রতিদিন বাদাম, দানাশস্য বা ডাল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া নানা ধরনের ফল ও সবজি খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির কথাও জানান তারা। শ্বেতসারযুক্ত খাবার যেমন-আলু বা কাসাভাও যুক্ত করা যেতে পারে।

বিজ্ঞানীদের দেওয়া ডায়েটের তালিকা-বাদাম দিনে ৫০ গ্রাম, সিমের বিচি, ছোলা, বিভিন্ন ধরনের ডাল দিনে ৭৫ গ্রাম। মাছ দিনে ২৮ গ্রাম। ডিম একটি অথবা দুটির বেশি নয়। লাল গোশত দিনে ১৪ গ্রাম। মুরগির গোশত দিনে ২৯ গ্রাম। রুটি এবং চাল দিনে ২৩২ গ্রাম। আলুর মতো অন্যান্য শ্বেতসার সবজি দিনে ৫০ গ্রাম। দুগ্ধজাত খাবার দিনে ২৫০ গ্রাম। শাকসবজি দিনে ৩০০ গ্রাম এবং ফল ২০০ গ্রাম। এছাড়া এই ডায়েটে চাইলে ৩১ গ্রাম চিনি এবং ৫০ গ্রাম তেল, যেমন জলপাই তেল যোগ করা যাবে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অক্সিজেনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাবার। সেই প্রাচীনকাল থেকেই একমুঠো খাবারের আশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ করে অসংখ্য মানুষ। তবে অর্থনীতি আর সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের ধরনেরও পরিবর্তন এসেছে। আগে দরকারের বাইরে সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত খাবারের কথা চিন্তাই করত না, অথচ আজকাল প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই রেস্টুরেন্টে খাবার খায়। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি রেস্টুরেন্টের বদৌলতে নানা দেশের নানা স্বাদের খাবারও আজকাল খাবার সুযোগ মিলছে। কিন্তু এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাবার নষ্ট আর অপচয় হওয়া। অথচ বিশ্বে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাবারের চাহিদা, প্রচুর খাবার নষ্ট হওয়ার পরও অভুক্ত থেকে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, খাবার নষ্ট বা অপচয় বাসা-বাড়িতেই বেশি হয়। কিন্তু বাস্তবে খাবার ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে নষ্ট হওয়া শুরু হয়। খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত বেশ লম্বা একটি প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে। আর সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় এ পর্যায়েই। তবে যেসব দেশ প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে, তাদের খাবার নষ্ট হওয়ার পরিমাণ অন্য দেশগুলোর থেকে কম, স্বাভাবিকভাবেই।

শুধু খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনাই যথেষ্ট নয়। খাদ্যের ফলে সৃষ্ট বর্জ্যরে হার কমিয়ে আনতে হবে, সেই সঙ্গে বিদ্যমান জমিতে বাড়াতে হবে খাদ্যের উৎপাদন এবং কমাতে হবে খাবারের অপচয়ও।

কৃষিবিদ বশিরুল ইসলাম : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

mbashirpro1986@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম