বাইফোকাল লেন্স
মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, বীর-উত্তম
একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন বেশির ভাগ সময়ই আমরা স্থলযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করি। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হলেও মুক্তিযুদ্ধে তেজোদ্দীপ্ত কিছু বাঙালি বিমানসেনার আকাশযুদ্ধ নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিমানসেনারা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে সত্যিই বিরল। এ অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কজনেই বা চিনি। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যে কজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে দখলদার পাকিস্তানিদের যুদ্ধক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে স্কোয়াড্রন লিডার (পরবর্তী সময়ে এয়ার ভাইস মার্শাল) সুলতান মাহমুদ, বীর-উত্তম অন্যতম। ১৪ আগস্ট এ বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনাবসান হয়। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সুলতান মাহমুদ ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকেন। দিন যতই গড়িয়েছে, যুদ্ধের তীব্রতা যেন ততই বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানের বিভিন্ন বিমানঘাঁটি থেকে পালিয়ে আনুমানিক ৩৫ জন বাঙালি বিমান কর্মকর্তা এবং প্রায় ৫০০ জন বিমান সৈনিক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাছাড়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সসহ সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত ১৭ জন পাইলটও মুক্তিযুদ্ধে শামিল হন। ১৯৭১ সালে সুলতান মাহমুদ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর করাচিতে অবস্থিত মৌরীপুর বিমানঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্রেকডাউনের পরপরই সুলতান মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর মে মাসে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, গোপনে তিনি মৌরীপুর বিমানঘাঁটি ত্যাগ করেন। প্রথমে করাচি থেকে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শ্রীলংকায় পৌঁছান। তারপর ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসেই তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরে পড়ে যান। এজন্য ঢাকায় নিজ বাসভবনে অবস্থান না করে তিনি অন্যত্র গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পথিমধ্যে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভারতে পৌঁছান।
ভারতে পৌঁছে সুলতান মাহমুদ প্রথমে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। পরে তাকে ১ নম্বর সেক্টরে বদলি করা হয়। এ সময় তিনি বেশ কয়েকটি স্থলযুদ্ধে অংশ নেন। বিমানবাহিনীর একজন দক্ষ পাইলট হয়েও তিনি গেরিলাযুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সুলতান মাহমুদ যে কয়টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তার মধ্যে মদুনাঘাট সাব-স্টেশনে রেইড ছিল অন্যতম। সেক্টর সদর দপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রোডের পাশে হালদা নদীর তীরে মদুনাঘাটে অবস্থিত বিদ্যুৎ বিভাগের সাব-স্টেশন ধ্বংস করা প্রয়োজন। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এই সাব-স্টেশনের মাধ্যমেই পুরো চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। অতএব, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ সাব-স্টেশনটি ধ্বংস করে দিলে পুরো চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে পাকিস্তানিদের সামরিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়বে। লক্ষ্য অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করে সেক্টর সদর দপ্তর বিমানবাহিনীর নির্ভীক কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদকেই এ অভিযানের অধিনায়ক নিযুক্ত করে।
১১ সেপ্টেম্বর সুলতান মাহমুদ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত একদল গেরিলা ও নিয়মিত সৈন্য নিয়ে ভারতের হরিণা ক্যাম্প থেকে দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে রাউজানের উপকিচরের এক গোপন আস্তানায় পৌঁছান। এখান থেকেই তিনি চূড়ান্ত অভিযানে যাবেন। মদুনাঘাট অভিযানে তার সঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক ক্যাপ্টেন করিমও যোগ দেন। অভিযানের নির্দিষ্ট দিন রাত ৩টার মধ্যে সুলতান মাহমুদ তার মূল দল নিয়ে ২টি নৌকায় করে হালদা নদী পার হয়ে টার্গেটের কাছে পৌঁছান। পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযানের অন্য ছোট দলগুলো যে যার অবস্থানে চলে যায়। আগেই বলা ছিল, প্রথমে সুলতান মাহমুদ গুলি করবেন এবং এটি অভিযান শুরুর সংকেত হিসাবে বিবেচিত হবে। যে কথা সেই কাজ। আকস্মিক এই আক্রমণে সাব-স্টেশনে ডিউটিরত পাকিস্তানি মিলিশিয়া সদস্যরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি সামলে তারাও পালটা গুলিবর্ষণ করে। এ সময়ে সুলতান মাহমুদের দলের ছোড়া রকেট লঞ্চারের ২টি গোলা নিখুঁতভাবে ২টি ট্রান্সফর্মারে আঘাত করলে সে দুটি ধ্বংস হয়ে যায়। প্রচণ্ড গুলি বিনিময়কালে সুলতান মাহমুদের এক সহযোদ্ধা নায়েক মান্নান শহিদ হন। সুলতান মাহমুদের নিখুঁত পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণ, শত্রুর অবস্থান ও শক্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল এবং সঠিক নেতৃত্বই অভিযানের সফলতা বয়ে আনে। এ অভিযানের ফলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ শুধু স্থলযুদ্ধেই পারদর্শী ছিলেন না, তিনি মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্বে, জঙ্গি হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে দুঃসাহসিক হামলা চালিয়ে একটি তেলের ডিপো ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এ সফল অভিযানের ফলে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের সময় পাকিস্তানিদের জরুরি তেল সাপ্লাইয়ের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি মে মাসে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। একে খন্দকারের প্রস্তাব শুনে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের কাছে জোর অনুরোধ করলে সিদ্ধান্ত হয় বাঙালি বৈমানিকদের নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হবে। এজন্য ভারত বাংলাদেশকে একটি অটার বিমান, একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং একটি ডিসি-৩ ডাকোটা (সি-৪৭) বিমান হস্তান্তর করে। ভারতের দেওয়া বিমান তিনটি যুদ্ধবিমান ছিল না। এগুলো ছিল মূলত বেসামরিক বিমান। যাই হোক, এ তিনটি বেসামরিক এয়ারক্রাফটকে অনেক কষ্ট করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের জন্য নাগাল্যান্ড প্রদেশের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য নির্মিত ৫ হাজার ফুটের একটি পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড ব্যবহার করতে দেয়। এয়ারফিল্ডটি ছিল গহিন জঙ্গল, উঁচু পাহাড় ও বৃক্ষ দিয়ে ঘেরা। এমন পরিবেশে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ ছিল খুবই বিপৎসংকুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
অনেক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত একাত্তরের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার বিমানবাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। তিনি স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে এ নবগঠিত ফরমেশনের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং অটার বিমান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বৈমানিকদের দুভাগে ভাগ করা হয়। হেলিকপ্টারের ক্যাপ্টেন হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে এবং সহযোদ্ধা হিসাবে নিয়োজিত হন ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম ও ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন। অটার বিমানের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম এবং সহযোদ্ধা হন ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন। অপরদিকে ডাকোটা বিমানের ক্যাপ্টেন নিয়োজিত হন ক্যাপ্টেন খালেক এবং সহযোদ্ধা হিসাবে নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার ও ক্যাপ্টেন মুকিত।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে বিমান হামলা করলে ভারতও পালটা বিমান হামলা চালায়। সিদ্ধান্ত হয়, ভারতের পাশাপাশি বাঙালি বিমানযোদ্ধারাও পাকিস্তানিদের যুদ্ধক্ষমতা হ্রাস করার লক্ষ্যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয় বিমান হামলা করবে। ঠিক হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের ইউএসএসও তেল ডিপো এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলমের নেতৃত্বে অটার বিমানটি পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল ডিপোতে বিমান আক্রমণ করবে। এ ঐতিহাসিক অপারেশনের নাম দেওয়া হয় গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের নামের ইংরেজি প্রথম বর্ণ ‘কে’ অনুসারে ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’। অবশ্য, স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াই শুরুর আগেই ২৮ নভেম্বর এ বিমান হামলার পরিকল্পনা করা হলেও পরে এক অজানা কারণে ভারতের পক্ষ থেকে তা বাতিল করা হয়। ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পর্যাপ্ত জ্বালানি ও ১৪টি রকেট সংযোজন করে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ তার সঙ্গীসহ হেলিকপ্টার নিয়ে ভারতের কৈলাশহরের তেলিয়ামুরা বিমানঘাঁটি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হন। অপরদিকে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও তার দল অটোর বিমান নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন।
সুলতান মাহমুদ যখন রওনা দেন তখন জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক ঝলমল করছিল, যা ছিল হেলিকপ্টারের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। তাছাড়া হেলিকপ্টারের আওয়াজে এর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিল। হেলিকপ্টার বেশি উঁচু দিয়ে উড়তেও পারছিল না; পাকিস্তানি রাডারে ধরা পড়ার ভয়ে। তেলিয়ামুরা থেকে কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হয়ে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক ধরে হেলিকপ্টার নায়ারণগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ডেমরায় পৌঁছে যান। তারপর দক্ষিণে মোড় নিয়ে সোজা নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপো এলাকায় পৌঁছায়। রাতে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনে সবাই চমকে ওঠে। এ সময় সুলতান মাহমুদ হেলিকপ্টার নিয়ে তেলের ডিপোর ওপর বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়ে প্রথমে ২টি রকেট নিক্ষেপ করেন। শত্রুর অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানের গুলিবর্ষণ এড়ানোর জন্য রকেট নিক্ষেপের সময় কিছুটা আড়াআড়িভাবে অগ্রসর হয়ে কিছুটা নিচু দিয়ে গিয়ে রকেট নিক্ষেপ করেই তৎক্ষণাৎ বাঁক নেন। সুলতান মাহমুদ প্রথম কিস্তির রকেট নিক্ষেপ করেই হেলিকপ্টার ঘুরিয়ে আবার একসঙ্গে আরও রকেট নিক্ষেপ করেন। রকেট নিক্ষেপের পর বিকট শব্দে তা বিস্ফোরিত হয় এবং রাতের অন্ধকার ভেদ করে চারদিক আলোকিত করে তোলে। তাদের এ হামলা পাকিস্তানিদের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। এ বিমান হামলায় তেলের ডিপোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। অতঃপর তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই সুলতান মাহমুদ ও তার দল অপারেশন সম্পন্ন করে একইভাবে পূর্বনির্ধারিত বিমানঘাঁটিতে ফিরে আসেন। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ নারায়ণগঞ্জের অভিযান ছাড়াও পরবর্তী সময়ে সিলেট, শমশের নগর, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার ও কুমিল্লাসহ কয়েকটি যুদ্ধেক্ষেত্রে হেলিকপ্টার নিয়ে ৫০টির বেশি অভিযান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে ভৈরবের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। ১২ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী যখন ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া রোড ধরে ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তার আগেই ভৈরবে মেঘনা নদীর ওপর রেলসেতুটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বিধায় আর অগ্রসর হতে পারছিল না। এমতাবস্থায় বেশির ভাগ ভারতীয় সেনাসদস্য স্থানীয় নৌযানে করে নদী অতিক্রম করলেও তাদের বেশকিছু হেলিকপ্টারও সেনাসদস্য পারাপার করছিল। সেসময় সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে তার সহযোদ্ধারা হেলিকপ্টার নিয়ে ভারতীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। পাকিস্তানিরা ভারতীয়দের নদী পারাপারে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সুলতান মাহমুদের দল তাৎক্ষণিক আক্রমণ করে তাদের প্রতিহত করেছিলেন। এ ধরনের হামলায় তারা ২১ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে হত্যা করেন।
Heroes Live Forever। আমরা অনেকেই ভুলে যাই-বীরের মৃত্যু নেই। তারা তাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। এ বিশ্বে বাংলাদেশ যতদিন মাথা উঁচু করে থাকবে, এ মহান আত্মত্যাগী বীর যোদ্ধারাও ততদিন বেঁচে থাকবেন। এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যার বীরত্বগাথা এ দেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৪ আগস্ট তিনি মারা যান। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায়ই তেমন গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রচারিত হতে দেখা যায়নি। যেসব ইলেকট্রনিক মিডিয়া হরহামেশাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বলে নিজেদের দাবি করেন; সেই মিডিয়াগুলোর সংবাদ কিংবা টকশোগুলোয় মাওলানা সাঈদীর ঘটনা নিয়ে যে হারে মাতামাতি করতে দেখা গেছে, তার বিপরীতে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তাদের কাউকেই ন্যূনতম একটি আলোচনা অনুষ্ঠানও আয়োজন করতে দেখা যায়নি। তাই বলে সুলতান মাহমুদের মতো বীর যোদ্ধারা হারিয়ে যান না। তারা চিরকাল বেঁচে থাকেন এদেশের লক্ষ-কোটি বাঙালির অন্তরে।
একেএম শামসুদ্দিন : সাবেক সেনা কর্মকর্তা