বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে কেন তিন সেমিস্টার?
সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞান বিতরণ করা, শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। ব্রিটিশ আমলের এ অঞ্চলের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ তৎকালীন বড় স্কুল বা কলেজগুলো বেশির ভাগই জমিদারসহ সাধারণ মানুষের দান করা সম্পদ, অর্থ কিংবা পরিশ্রমেরই ফসল। যারা তখন এসব সহায়তা করেছিলেন, নিশ্চয়ই তাদের এ খাত থেকে ব্যবসা করা মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এ কথার সঙ্গে অন্তত কেউ দ্বিমত পোষণ করবে না। যুগের হাওয়া বদলে বদলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন, সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারিসহ কয়েক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে রয়েছে। ইউজিসির তথ্যমতে, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৪, এর মধ্যে কার্যক্রম চালু রয়েছে ১০০টির মতো। অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫২টি। সংখ্যার হিসাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও কম।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত আসন সংখ্যা না থাকায় প্রতিবছরই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা বড় একটা অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেহাত কম নয়, প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন থেকে বছরে তিন সেমিস্টারে পরিচালনায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ৩১ জুলাই তাদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তাই নয়, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় দুই সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পরিচালনার বিষয়ে সমাধানে আসতে কারিগরি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেখানে পুরোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখনো অনেক বিভাগ ইয়ার সিস্টেমে আর নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে দুই সেমিস্টার সিস্টেমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে বছরে দুই সেমিস্টার পরিচালনা করার। সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্ত আপতদৃষ্টিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব মনে হয়নি। কেননা এর আগেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদ্ধতি চালু থাকলেও এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর খুব বেশি একটা পড়েনি। কিন্তু এবার জোট বেঁধে মাঠে নেমেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আপতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, যারা দুই সেমিস্টার পরিচালনা করবে, তাদেরও বছরে তিন সেমিস্টার করার জন্য বাধ্য করা হবে।
বছরে তিন সেমিস্টারের উপকারিতা আমার চোখে খুব একটা পড়ে না। নিশ্চয়ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তাদের কাছে এর সুফল রয়েছে। বাংলাদেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যাই বেশি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খুব অল্পসংখ্যক উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে রয়েছে। তবে বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের। বছরে তিন সেমিস্টারের নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীরা খুশি হবেন না। খুশি হওয়ার মতো কোনো কারণও নেই। কেননা এটা তাদেরও বোঝার ক্ষমতা হয়েছে যে, বছরে তিন সেমিস্টার মানে বাড়তি খরচ। এমনিতে সাধারণত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ একটা বিষয়ের ওপর স্নাতক সম্পন্ন করতে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগে। অনেক সময় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকাও লেগে যায়। তিন সেমিস্টার করার ফলে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও খরচ আগের চেয়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ নতুন সেমিস্টার মানেই নতুন করে ভর্তি, নতুন করে সেমিস্টার ফিসহ নানা ফি শিক্ষার্থীদের পকেট কেটে নেওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে এরকম একটা
সিদ্ধান্ত কখনোই শিক্ষাবান্ধব নয়। বছরখানেকের মতো শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বছরে দুই সেমিস্টার পরিচালনায় এমনিতে শিক্ষক ও
শিক্ষার্থী উভয়কেই হিমশিম খেতে হয়। যেখানে ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ দিন দুই ঈদ ও শীতকালীন ছুটিসহ সরকারি বন্ধ থাকে। এছাড়া শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকলে আরও ৫০ থেকে ৬০ দিন বন্ধ থাকে। আবার প্রতি সেমিস্টারের পর সেমিস্টার ব্রেক থাকে, সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধেক বছরই বন্ধ থাকে। এছাড়া প্রতি সেমিস্টারের প্রতি কোর্সে ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ৩০টি ক্লাস নিতে হবে। প্রতিটি কোর্সে পাঠদানের মাঝামাঝি নিতে হবে মিড সেমিস্টার পরীক্ষা। আবার অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন তো আছেই। তারপর চূড়ান্ত পরীক্ষা নিতে হবে। একটা সেমিস্টারে নিশ্চয়ই একটা কোর্স থাকে না, কমপক্ষে চারটি বা পাঁচটি কোর্স তো থাকেই। যেখানে ছয় মাসে একটা সেমিস্টার শেষ করতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে চার মাসে কীভাবে এতগুলো কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব?
আবার শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়া ছাড়াও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন, গবেষণাসহ নানা কাজ করতে হয়। তাহলে চার মাসে শেষ করলে একটা কোর্সে কতটুকু শেখা হবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। শুধু কিছু অর্থের জন্য শিক্ষার্থীদের এত বড় ক্ষতি কোনোভাবেই হতে দেওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলোর পড়ালেখার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সেখানে তিন সেমিস্টার করলে মান কতটুকু রক্ষা হবে? তাছাড়া এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল, কারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাই একটা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তাদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই এরকম সিদ্ধান্ত আশা করি ইউজিসি বাস্তবায়ন হতে দেবে না। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। তা না হলে শিক্ষার মান ও টাকা, দুটিই নষ্ট হবে।
সাইফুল ইসলাম : প্রভাষক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর