বিভীষিকাময় যে স্মৃতি ভোলার নয়
ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে ঘাতকের নিষ্ঠুর ও হিংস্রতম আক্রমণে সপরিবারে শাহাদতবরণ করেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চরম নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করা হয় তার পরিবারের নারী-শিশুদেরও।
বিভীষিকাময় এ হত্যাকাণ্ডের কথা আমার যতবারই মনে পড়ে, শোকের মাতমে ততবারই বুক ডুকরে কেঁদে ওঠে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষ্যে শেখ কামাল ভাইসহ মাঝরাত অবধি আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দলবেঁধে কাজ করছিলাম।
কাজের এক ফাঁকে রাত ৯টার দিকে প্রিয় অনুজ, বরগুনা জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুর রশীদকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় গিয়ে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু তখন বাকশালের বিভিন্ন ফ্রন্ট গঠন করছেন। আমি বরগুনাতে যুবলীগ বা শ্রমিক লীগ যে কোনো একটা ফ্রন্টের চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে সেরনিয়াবাত সাহেব আমাকে যে কোনো একটা ফ্রন্টের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। এ নিয়েই দেখা করতে গিয়েছিলাম।
সেখানকার কাজ শেষ করে রাত একটার দিকে সলিমুল্লাহ হলে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে পুনরায় একত্রিত হই। রাত ২টার দিকে শেখ কামাল ভাই বাসায় চলে যেতে উদ্যত হলে, আমরা যারা তার সঙ্গে ছিলাম, না যাওয়ার অনুরোধ করে বলেছিলাম, আপনি যাবেন না, আমরা ভোরবেলা আপনাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে চাই। কিন্তু তিনি জানালেন তাকে যেতেই হবে বাসায়। মৃত্যুর মাত্র আড়াই-তিন ঘণ্টা আগেও তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন!
কামাল ভাই চলে যাওয়ার পর আরও কিছু কাজ করে রাত প্রায় তিনটার দিকে রুমে এসে ঘুমাতে যাই। তেমন একটা ঘুমাতে পারিনি, এরই মধ্যে খুব ভোরে হরিমানিক্য দত্ত নামে এক বন্ধু আর্তনাদের সুরে ডেকে আমার ঘুম ভাঙাল। উদ্বেগজড়িত কণ্ঠে সে বলছিল, ‘দাদা, ওঠেন ওঠেন, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে!’ তখন আমি জগন্নাথ হলের ইস্ট হাউজের দোতলায়। এখান থেকে পেছনে তাকালেই জগন্নাথের মাঠ। সেখানে তখন পুলিশ, আনসার সদস্যরা প্যারেড প্র্যাকটিস করছিল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য। হরিমানিক্যের কথাটা তাই কিছুতেই বিশ্বাস হলো না। ওকে বললাম, ‘যাও এটা কিছুতেই হতে পারে না।’ প্যারেড প্র্যাকটিস দেখিয়ে ওকে বলতে চাইলাম, ‘দেখছ না বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।’ আমাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলে, ‘ওরা এখনো জানে না।’ এরই মধ্যে হলের অনেকেই দৌড়াদৌড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, বঙ্গবন্ধু আর নেই। রুমে ছোট একটি রেডিও ছিল। আমি রেডিও অন করলাম। রেডিওতে ততক্ষণে মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে: ‘আমি মেজর ডালিম বলছি-শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ বলে কী? এ-ও কি হতে পারে? পাকিস্তানি ঘাতকরা সহস্র ষড়যন্ত্র করে, বিচারের নামে প্রহসন করেও যাকে হত্যা করতে পারেনি, সেই বঙ্গবন্ধুকেই স্বাধীন বাংলাদেশে হত্যা করা হয়েছে-এটি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, মাত্র দুই-তিনদিন আগে, আগস্টের ১২ তারিখ বিকালে ওবায়দুল কাদের ভাই, আশরাফুল ইসলাম ভাইসহ আমরা ৮-১০ জন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা গিয়ে যে মহান নেতার কাছ থেকে আশীর্বাদ আর দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছিলাম, স্বাধীনতার সে মহান স্থপতিকে এভাবে সপরিবারে হত্যা করা হতে পারে! আমরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সেদিন ২ ঘণ্টারও বেশি সময় বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসেছিলাম। এসব মনে পড়ছিল আর চোখ ভেসে যাচ্ছিল জলে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। দ্বিধাগ্রস্ত মনেই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর ছাত্রলীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমপিদের বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। কিন্তু কোনো দিকনির্দেশনা পেলাম না। ওখানে ছিল ছাত্রলীগের কয়েকজন। ওদের ডাকলাম। সেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং পরবর্তীকালে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়া শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকেও পেলাম। সে আমাকে বলল, চল দোস্ত, ড্রাম ফ্যাক্টরির ওদিকে যাই। তখন সব এলোমেলো, ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। আমরা ক’জন মিলে ড্রাম ফ্যাক্টরির সামনে, যেখানে এখন বিআরটিএর অফিস, সেখানে গিয়ে রাস্তার কোণায় দাঁড়াই। ওখানে দেখি কিছু বাঙালি আর বিহারি মিলে একটা দল পাকিয়েছে। তাদের টার্গেট হলো এমপি হোস্টেল লুট করা।
আমি আর জাফর মিলে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, ওদের এখান থেকে হটাতে হবে। নইলে একটা বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেলে সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। ওদের ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে আমরা কজন মিলে ইটপাটকেল ছুড়লাম। পরে আমাদের সঙ্গে উপস্থিত জনতার অনেকে এসে যোগ দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝতে না পেরে ওরা যে যেদিকে পারে সেদিকে ছুট দিল। সারা দিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে খাওয়া-দাওয়া না করে আমরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করলাম। তখন বারবার মনে হচ্ছিল, মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারিয়ে এতিম হওয়ার মতো বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আরও একবার এতিম হলাম।
এ অবস্থায় মানসিকভাবে আরেকটি যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে করতে আগস্টের ১৭ তারিখ ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। আমি বরগুনা পৌঁছে দেখি এসডিও সিরাজুদ্দিন সাহেব ও এসডিপিও ফারুক সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, মুক্তিযোদ্ধা, কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে একটা প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেছে। তারা সেখানে মোশতাক সরকারের কারফিউ জারি করতে দেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে যেটা একইসঙ্গে প্রথম প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ ছিল। এখানে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রক্ষীবাহিনীও তাদের অস্ত্র জমা দেয়নি। আমি এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম আর মনে মনে স্রষ্টার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সশরীরে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে। আমরা এখানে টানা ৮ দিন খুনি মোশতাক সরকারের কার্যক্রম থেকে সবকিছুকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পেরেছিলাম। এখানে একেকটা দিন আমরা শহরের জ্ঞানরঞ্জন ঘোষের বাড়িতে বসে মিটিং করতাম, প্রতিবাদের যাবতীয় কর্মসূচি ঠিক করতাম আর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান দিতাম, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই, খুনি মোশতাক সরকারের শাসন মানি না, মানব না।’ এভাবে সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন চলা অবস্থায় নুরুল ইসলাম শিকদার, ইউনুস শরীফ, সিদ্দিকুর রহমান, মোসলেম শরীফ, পাশা তালুকদার, মান্নান মিয়া, জাহাঙ্গীর কবীর, মোতালেব মৃধা, নাজেম আলীসহ আমরা যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম, তারা অনেকেই গ্রেফতার হয়ে গেলাম আর সিরাজউদ্দীন সাহেবকে চাকরিচ্যুত করা হলো।
জাতির পিতাকে হত্যার প্রতিবাদ করায় খুনি মোশতাক সরকার গ্রেফতার করে আমাকে। সে সময়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩(২) ধারা প্রয়োগ করে আমাদের ডিটেনশন দেওয়া হয়। সেই দুঃসহ সময়ে আমার জন্য খাবার নিয়ে প্রতিদিন জেলগেটে আসত আমার ছোট ভাই কেশব, বিপুল আর মুজিবভক্ত মোহন। আবার খাবার শেষে প্রতিদিন খালি বাটি নিয়ে যেত। ডিটেনশনে ছিলাম বলে খুবই কড়া পাহারায় রাখা হতো আমাকে। তবে ওদের মাধ্যমেই টুকটাক খবরাখবর আদান-প্রদান করতে পেরেছিলাম। পঁচাত্তর থেকে আটাত্তর পর্যন্ত জীবনের চরম দুঃখের তিনটি বছর আমার পাশে থেকেছে এ তিনজন।
অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু : সংসদ-সদস্য; সভাপতি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি