নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
অল্প রপ্তানি পণ্যের ওপর নির্ভরতায় ঝুঁকি বাড়ছে
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে দুটি ক্ষেত্রে সরকার নিয়মিতভাবে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, তার একটি হচ্ছে রাজস্ব আদায়, অন্যটি রপ্তানি আয়। আমদানি অথবা রেমিট্যান্সের লক্ষ্যমাত্রার কথা সেভাবে শোনা যায় না। কারও নজরও নেই। তবে আরও কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা থাকে। সেগুলোও বেশি আলোচিত বিষয় নয়। রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কত, কত আদায় হলো-এটি বেশ চর্চিত বিষয়। আর রপ্তানি, এটা তো এখন বহুল চর্চিত বিষয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানি। এর ওপর প্রায়ই কোথাও না কোথাও স্টোরি ছাপা হয়। হবেই বা না কেন?
রপ্তানি বাণিজ্য আমাদের জন্য এখন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে; যেমন করে রেমিট্যান্স এবং কৃষি উৎপাদন। এ তিনটি ক্ষেত্রে আমাদের ‘পারফরম্যান্সও’ ভালো। এই যেমন রপ্তানি আয়ের কথা যদি বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য এক বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। একটি কাগজে দেখলাম, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৭২ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি)। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি হবে ৬২ বিলিয়ন ডলার এবং সেবা সার্ভিস থেকে রপ্তানি আয় হবে ১০ বিলিয়ন ডলার।
পণ্যের মধ্যে আবার তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫২ বিলিয়ন ডলার। তার মানে মাসে ৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি। আমদানির তথ্য/পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলে বোঝা যেত কত পরিমাণ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে আয় আর কত পরিমাণের ব্যয় আমদানিতে। তাহলেই বোঝা যেত আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অবস্থা কী হবে। অথবা ভিন্নভাবে বলা যেত আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কত অথবা ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টের’ অবস্থা কী।
সে যাই হোক, একমাত্র রপ্তানির পরিসংখ্যান দেখলেই মাথা ঘুরে যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য টার্গেট ৭২ বিলিয়ন ডলার। দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩-এ শুধু পণ্যই রপ্তানি হয়েছিল প্রায় ৫৬ বিলিয়ন ডলারের। ভাবা যায় বিষয়টি কী? বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হবে ৭২ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর অর্থাৎ স্বাধীনতার পরপর রপ্তানি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা কী ছিল? বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘বিবি পরিক্রমা’ নামের একটি প্রকাশনায় দেখলাম, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এখন দেখুন, কোথায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার আর কোথায় ৭২ বিলিয়ন ডলার। অকল্পনীয় অগ্রগতি এক্ষেত্রে। অভাবনীয় ঘটনা, গর্ব করার মতো ঘটনাই বটে। কী করে তা সম্ভব হলো?
স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-৭১) আমাদের রপ্তানি পণ্য কী ছিল? হাতেগোনা কয়েকটি পণ্য ছিল আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্য। যেমন-কাঁচাপাট, পাটজাত দ্রব্য, চা, কাঁচা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। সঙ্গে আর কিছু হস্তশিল্প/কুটিরশিল্পজাত পণ্য। এই ছিল রপ্তানি দ্রব্য। এ দেখে ‘পাকিস্তানিরা’ আমাদের বলত-তোমরা হবে স্বাধীন? কী আছে তোমাদের? চালে ঘাটতি, রপ্তানির নেই কোনো ভালো পণ্য। এত লোক তোমাদের! না খেয়ে মরবে তোমরা। এই ভয় দেখাত তৎকালীন শাসক দল ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’ এবং তার অনুচররা। এতে অনেকে ভড়কে যেত।
স্বাধীনতার পর এতে ঘি ঢালেন মার্কিন ধুরন্দর রাজনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি ছিলেন তখন ওই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ঘোরতরভাবে ছিলেন আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ (বটমলেস বাস্কেট)। এ নিয়ে কত কথা, বিরুদ্ধ প্রচারণা স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তখনকার প্রতাবশালী একটি দৈনিক তো কিসিঞ্জারের বক্তব্য ধরে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে রীতিমতো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে। এই তো সেদিনের কথা। অনেকেই এ প্রচারণার শিকার হয়। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস, বাঙালির কী কীর্তি-আজ ৫০-৫২ বছর পর বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-সবাই বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করে। করবেই না কেন? আমাদের এ অগ্রগতি কি সামান্য? এই সেদিন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে বছরে গড়ে ৬-৭ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির আকার যেখানে ছিল মাত্র ৭ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কেবল প্রবাসী আয়ই মাসে আসে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর আজ বাজেটের আকার কত? বিশাল রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট এখন আমাদের।
কিসিঞ্জারের মুখে ছাই দিয়ে আমরা আজ শক্ত অবস্থানে। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও এখনো আমরা স্থিতিশীল আছি, যদিও বেশ চাপের মধ্যে। তা অবশ্য সব দেশের মতোই। এই যে সাফল্য তার তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে-রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি, প্রবাসী আয়ের ক্রম ঊর্ধ্বগতি এবং কৃষির পারফরম্যান্স-বিশেষ করে চালের উৎপাদনে। এর মধ্যে রপ্তানির বিষয়টি সবারই বিশেষ নজর কাড়ে। দেড় বিলিয়ন ডলারের স্থলে ৭২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি। তবে বর্তমানে এক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ের রপ্তানি দ্রব্যের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আমরা নতুন পণ্য যোগ করেছি আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে। কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের বদলে আমরা রপ্তানি দ্রব্য হিসাবে পেয়েছি কয়েকটি পণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে তৈরি পোশাক, যার পরিমাণ মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের মতো। তৈরি পোশাক কোনো ‘শিল্প’ নয়। এটি বস্তুত সেলাই কারখানাজাত পণ্য।
ঘটনাক্রমে প্রথমে ‘কোটার’ বদৌলতে, পরে প্রতিযোগিতায় তৈরি পোশাকই হয়ে উঠেছে আমাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য। এর সঙ্গে রয়েছে সামান্য হোম টেক্সটাইল, ওষুধ এবং নানাবিধ অগুরুত্বপূর্ণ কিছু পণ্য। অর্থাৎ স্বাধীনতার আগে যেখানে দুই-চারটি পণ্যের ওপর আমরা নির্ভরশীল ছিলাম রপ্তানির ক্ষেত্রে, আজ ৫২ বছর পরও আমরা রপ্তানির জন্য নির্ভরশীল দুই-চারটি পণ্যের ওপর। শুধু তাই নয়, আমাদের রপ্তানি বাজার, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাজার সীমিত হয়ে পড়েছে ৮-১০টি দেশের ওপর।
এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, ভারত, নেদারল্যান্ডস, জাপান, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশ। এসব দেশে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয় মোট রপ্তানির ৭০-৭২ শতাংশ। বাকি সব দেশে মাত্র ২৮-৩০ শতাংশ। তার মানে, আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য শুধু স্বল্পসংখ্যক পণ্যের ওপরই নির্ভরশীল নয়, নির্ভরশীল কয়েকটি বাজারের ওপরও। ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
বিপরীতে আমাদের আমদানি বাণিজ্য বেশি হচ্ছে দুটি দেশের সঙ্গে। আমাদের সবচেয়ে বড় আমদানির উৎস হচ্ছে চীন এবং দ্বিতীয় হচ্ছে ভারত। রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যে ৫২ বছরে আজ আমরা এ অবস্থায় পৌঁছেছি, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। অথচ রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো এবং রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার কথা শুনছি বহুদিন থেকে। বস্তুত, স্বাধীনতার পর থেকেই এসব কথা চলে আসছে। যেসব সরকার এসেছে, সবাই বলেছে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে, বাজার সম্প্রসারণ করতে। এসব করার সময় অনেকে স্লোগানও দিয়েছেন, ‘এক্সপোর্ট অর পেরিশ’।
অর্থাৎ রপ্তানি বাড়াও, নতুবা বিলীন হও। এর অর্থ এই যে, রপ্তানি বাড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো উপায়ান্তর নেই। কিন্তু এ স্লোগানের ফল দেখা যাচ্ছে শূন্য। রপ্তানি বেড়েছে বেশ ভালোভাবেই, কিন্তু তা এক পণ্যনির্ভর; আবার তা কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীল। সরকারি সহযোগিতা, সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণ, ঋণ মওকুফ, স্বল্প কর, কর অবকাশ, ভ্যাট থেকে মুক্তি, ‘ব্যাক টু ব্যাক’ ঋণপত্র খোলার সুবিধা ইত্যাদি দেওয়ার পরও আজ আমরা রয়েছি এ অবস্থায়।
বর্তমান সরকার আসার পর কতবার রপ্তানি বাণিজ্য বহুমুখীকরণের কথা বলেছে, তার কোনো হিসাব নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুযোগ এলেই রপ্তানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, বহুমুখীকরণ, বৈচিত্র্যকরণের কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু ফল শূন্য-‘যথা পূর্বং তথা পরং’। কোনো ইতরবিশেষ নেই। বাঙালির এক কথা, তারা একটি খাতকে লাভজনক মনে করলে সবাই মিলে তা-ই করবে। তৈরি পোশাক তো তৈরি পোশাকই করবে, অন্য কোনো শিল্পে যাবে না। দরকার হলে বিদেশে বিনিয়োগ করবে বেসরকারিভাবে, তবু দেশে ভিন্ন কোনো শিল্প করবে না। ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।
নতুন ব্যবসা, ‘স্টার্টআপ’, ‘উদ্যোক্তা ফান্ড’, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপসহ কত আয়োজন। কিন্তু ফলোদয় হচ্ছে না। বরং উলটো দেখা যাচ্ছে, রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি মারাÍক হারে বাড়ছে আমদানি বাণিজ্য। অনেক ক্ষেত্রে আমদানির নামে টাকা পাচার হচ্ছে। একথা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকই বলছে। রপ্তানির নামে আমদানি, আমদানির নামে টাকা পাচার।
আবার যে তৈরি পোশাক শিল্প (কারখানা) আমরা গড়ে তুলেছি, তার জন্য আমদানি করতে হচ্ছে প্রচুর। অথচ তা করার কথা ছিল না। কথা ছিল ‘ভ্যালু এডিশনের’। দেখা যাচ্ছে, ৪০-৫০ শতাংশের বেশি ‘ভ্যালু এডিশন’ হচ্ছে না। অথচ ভ্যালু এডিশনের কথা বলে বিশাল এক টেক্সটাইল শিল্প গড়ে উঠেছে। বিপুল অঙ্কের টাকা এতে বিনিয়োজিত। কিন্তু তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা সেখান থেকে কাপড় কেনেন না। তাদের নাকি পোষায় না। এভাবে সেখানে তৈরি হয়েছে ‘ওভার ক্যাপাসিটি’। ব্যাংকের টাকা আদায় হয় না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রপ্তানির পণ্যে বৈচিত্র্য আসছে না। বাজারে তো নয়ই। উপায়ান্তর না দেখে ব্যবসায়ীরা এমন সব পণ্য রপ্তানিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন, যেসব পণ্যের সবরাহ ঘাটতি রয়েছে। যেমন-শাকসবজি, মাছ। কয়েকটির কথা এখানে বললাম। বাজারে শাকসবজির দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কোনোটার গায়ে হাত দেওয়া যায় না। বিপুলসংখ্যক মানুষ শাকসবজি কিনে খেতে পারে না।
মাছের ক্ষেত্রেও তা-ই। ছোট পুঁটি মাছ, যা একসময় মানুষ প্রায় খেতই না, তার দামও কেজিপ্রতি ৪০০-৬০০ টাকা। একসময়ের সস্তা চিংড়ির দাম কেজিপ্রতি ৮০০-১৫০০ টাকা। একটা ইলিশের দাম এখন (কেজি হিসাবে) ১৮০০-২০০০ টাকা। যত বেশি ওজন, তত বেশি দাম। এসব খাওয়ার কোনো উপায় নেই। অথচ দেশে পুষ্টির অভাব আছে। শুধু চাল-ভাতই খাদ্য নয়; ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম সবই দরকার খাদ্য হিসাবে। প্রশ্ন হলো, কোনো রপ্তানি পণ্য না পেয়ে শাকসবজি, ইলিশ মাছ রপ্তানি করা কতটুকু যুক্তিসংগত, তা ভেবে দেখার দাবি রাখে না কি? দেশবাসীর চাহিদা বড়, না এসব শাকসবজি ও মাছ রপ্তানির বিষয় বড়? মাঝেমাঝে কিছুই বুঝে উঠতে পারি না।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়