Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ডলার সংকটের সমাধান হবে কবে?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডলার সংকটের সমাধান হবে কবে?

কাঁচাবাজারের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি আজকের নিবন্ধ। চার-পাঁচ দিন আগের কথা। মতিঝিল কলোনি বাজারে গিয়েছি ইলিশ মাছ কিনতে। অনেকদিন এ মাছ খাওয়া হয়নি। পহেলা বৈশাখে ইলিশের ধারেকাছে যাইনি। পরিচিত দোকানদারের কাছে গিয়ে দাম করতেই তিনি বললেন, ২২০০ টাকা, ২৫০০ টাকা কেজি। আমি বললাম, এত দাম কেন? আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে আগের দোকানের মাছওয়ালা বলে উঠলেন, ডলার নেই, ডলার নেই। একথা শুনে আমি তো অবাক।

বলে কী! ইলিশের বাজারের সঙ্গে ডলারের বাজারের সম্পর্ক কী? দোকানদার তখন বললেন, চাঁদপুরের মাছের আড়তদাররা নাকি ডলারের কারণে ইলিশের বাজার চড়া-একথা বলে মানুষকে ‘বুঝ’ দেয়। সত্যি-মিথ্যা বলতে পারব না; তবে ডলার সংকট যে মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকে বসে আছে, এটা ভালোভাবেই বুঝলাম।

ডলার এমনিতেই অতি পরিচিত মুদ্রা। এটা পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-৭১) নয় যে, মানুষ তখন ১০-১০০ রুপির নোট দেখতে বাজারে যেত। হাতে হাতে পয়সা, আনা, এক রুপি ইত্যাদি মুদ্রা। এখন এ অবস্থা নেই। ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা, ১০০০ টাকার নোট হাতে হাতে, এমনকি বাচ্চাদের হাতে পর্যন্ত। উপরন্তু ‘রেমিট্যান্স’ অঞ্চলে ঘরে ঘরে ক্যাশ ডলার। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হাতে পর্যন্ত ডলার নোট। সরকারিভাবেই একজন বাংলাদেশি এখন ১০ হাজার ডলার ক্যাশ রাখতে পারে বলে শুনেছি। এর অর্থ কী? দেশে ডলার এখন টাকার মতোই চালু মুদ্রা। এ পথ ধরেই ইলিশের বাজারে ডলার এসে হাজির। হাজির মানে ডলার সংকট হাজির।

দৃশ্যত ডলার সংকটের কারণে ইলিশের দাম বাড়া-কমার কোনো কারণ দেখি না। ইলিশ আমরা আমদানি করি না, বরং কিছুটা রপ্তানি করি। বছরে কয়েক লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হয়। পূর্ব-পাকিস্তান আমলে ইলিশ অনেকে খেত না, খেতে খেতে বিরক্ত লাগত। এক টাকা, দেড় টাকা, দুই টাকায় একটা বড় ইলিশ পাওয়া যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, হলের ‘মেসে’ প্রতি বেলায় ইলিশ খেতে খেতে ছাত্রছাত্রীরা বিরক্ত হয়ে উঠত। সেই ইলিশের দর বলে ২২০০ টাকা কেজি, ২৫০০ টাকা কেজি। অবশ্য বড় ইলিশের আরও বড় দাম। তাও এর সঙ্গে ডলার সংকটের সম্পর্ক টেনে দেওয়া হচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? আমার মাথায় ঢোকে না।

এটা অবশ্য বোঝা যায়, ইলিশের বিপণন ব্যবস্থা আগের মতো নেই। আগে ইলিশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা এতটা ছিল না। এখন চাঁদপুর, বরিশাল ইত্যাদি অঞ্চলে ইলিশ সংরক্ষণে নানা হিমাগার তৈরি হয়েছে। এতে প্রচুর ইলিশ স্টক করে রাখা যায়, সিন্ডিকেট করে তা বাজারজাত করা যায়। ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ ছাড়া ইলিশ ধরার পেশায় নিয়োজিত জেলেরা এখন কিছু চাল-গমের সুবিধা পান, বিশেষ করে যখন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হয়, যাতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। পাচ্ছেও। কিন্তু দাম তো কমেনি। সিন্ডিকেটই ইলিশের দাম কমতে দেয়নি। জেলেরা এর সুবিধা পান না। পান না ভোক্তারা। সুবিধা লুটে খায় মধ্যস্বত্বভোগীরা।

ইলিশের মতো অবস্থা গোল আলুতেও। গোল আলু উৎপাদনে আমরা অগ্রণী। আমাদের যা প্রয়োজন তার দ্বিগুণ আলু আমরা উৎপাদন করি। কোল্ড স্টোরেজে পর্যন্ত রাখার জায়গা নেই। অনেক গোল আলু পচে। কৃষক বাজার পায় না। এহেন গোল আলুর দাম ৪০-৫০-৬০ টাকা কেজি কেন হবে? এটা তো আমরা আমদানি করি না যে, ডলারের অভাবে আমদানি বিঘ্নিত হওয়ায় এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। দোকানদারদের জিজ্ঞেস করলে তাদের কাছে কারণের কোনো অভাব নেই। একশ একটা কারণ তারা প্রতিদিন দেখায়। এই কারণ দেখানোটা তাদের মজ্জাগত। ফলে ডলার সংকটে যেমন দাম বাড়ে, তেমনি ডলারের সঙ্গে, আমদানির সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন পণ্যের দামও বাড়ে।

ডলার সংকট যেমন ইলিশের বাজারে, আলুর বাজারে ছড়িয়েছে, তেমনি এর অভাব এখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। অথচ এই ডলার সংকট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫-৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল বলে আমাদের বলা হয়েছিল। একথা বলে যথেচ্ছভাবে পণ্য আমদানি করতে দেওয়া হয়, টাকা পাচার করা হয়। এর থেকে নানা ‘কাণ্ড’ সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রকে পর্যন্ত ডলার ঋণ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ধরা খেলাম আমরা আইএমএফ’র হাতে। ডলার রিজার্ভ হিসাবায়নে গন্ডগোল। কারা করছে? বাংলাদেশ ব্যাংকে বসে যেসব সিনিয়র কর্মকর্তা-নির্বাহী দিনের পর দিন আন্তর্জাতিক নিয়মগুলো ভেঙেছেন, তাদের কি কোনো বিচার হবে এখন? না, হবে না। অথচ তাদের ভুল পরামর্শেই আজকের এ পরিস্থিতি।

সাবধান করার কেউ ছিল না। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে যা রাখা দরকার, তা আমরা রাখতে পারছি না। বাজারে ডলার সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আমদানি সংকোচন চলছে। সরকারের রাজস্বের অভাব ঘটছে। সরকার বাধ্য হয়ে খরচ কমাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সমানে ঋণ নিচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অথচ ডলার সংকট ঘোচানোর কোনো পথই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ডলার সংকট থেকে মুক্তির পথ কী? ডলারে আমাদের আয় বাড়ানোটা হচ্ছে এক নম্বর পথ। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এর অন্যতম প্রধান পথ। কিন্তু রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নানা বাধার সম্মুখীন। বিদেশের বাজার সংকুচিত। এদিকে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের জন্য পোশাক শিল্পে উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির টার্গেট ৭২ বিলিয়ন ডলারে নির্ধারিত হয়েছে, তবু তা বাস্তবায়নে আমরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এদিকে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রেমিট্যান্স সামান্য বাড়ছে। যে হারে বাড়ার কথা, সে হারে বাড়ছে না। অভিযোগ, ‘হুন্ডিওয়ালারা’ বিদেশেই বাংলাদেশের ডলার কিনে নিচ্ছে বেশি দাম দিয়ে। তারা দেশে রেমিট্যান্স প্রাপকদের তা টাকায় শোধ করে দিচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, হুন্ডিওয়ালারা ওই ডলার নিয়ে কী করছে? এটা জানা প্রায় অসম্ভব। তবে দৃশ্যত মনে হয় তারা প্রধানত তিনটি উদ্দেশ্যে এ ডলার সংগ্রহ করে। আজকাল হুন্ডিওয়ালা, বড় বড় পোশাক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বিদেশে অনেক বিনিয়োগ আছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ইত্যাদি দেশে, এমনকি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও তাদের ব্যবসা আছে। আবাসনশিল্প, নির্মাণশিল্প, ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন ব্যবসায় তারা জড়িত। বস্তুত বড় বড় ব্যবসায়ী ও হুন্ডিওয়ালারা একই গোত্রভুক্ত। একজনকে ছাড়া অন্যজন অচল। ওই বিনিয়োগ, পুনর্বিনিয়োগের জন্য তাদের ডলার দরকার। অথচ তা বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো প্রায় অসম্ভব। এত ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক দিতে পারে না, দেয় না। সেজন্য তারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে বিদেশেই রেখে দেয়।

দ্বিতীয় কাজটি তারা করে প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনদের বাংলাদেশের টাকায় তা পরিশোধ করে। এর জন্য স্থানীয়ভাবে একটা ‘মেকানিজম’ গড়ে তোলা হয়েছে। শোনা যায়, বহু অনুমোদিত ডিলারও এ কাজে নিয়োজিত। তারা হুন্ডিওয়ালাদেরই লোক, বড় বড় ব্যবসায়ীদের লোক। বিদেশে বিনা অনুমতিতে বিনিয়োগ ছাড়া আরেকটা কাজ তারা করে। আর সেটা হচ্ছে চোরাচালানে ফিন্যান্স করা।

এটা কীভাবে হয়? ধরা যাক ভারত থেকে পণ্য আনা হবে। ভারত থেকে বৈধপথে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে আমদানি হয়। এর মধ্যে রয়েছে যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আনুমানিক যত পণ্য সরকারিভাবে বাংলাদেশে আসে, তার সমপরিমাণ আসে অবৈধভাবে। আসে প্রয়োজনের খাতিরেই। চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতেই তা হয়। একদম পাকা অর্থনৈতিক কাজ। অবশ্য আমরা একে বলি চোরাচালান। চোরাচালানও একটা ব্যবসা। তা সঙ্গতকারণেই সরকারিভাবে হয় না, তা সম্ভবও নয়। আমাদের সঙ্গে ভারতের বিশাল খোলা সীমান্ত।

অনেক মানুষের পৈতৃক ঘরবাড়ি আজও দুই দেশে বিরাজমান। সীমান্তবর্তী এলাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের অনেকেই ওপার থেকে ১৯৪৭-এর পর এসেছেন। একইভাবে বহুলোক আমাদের এখন থেকে গিয়ে সীমান্তের ওপারে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে ভালো যোগাযোগ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ১৯৭২-পরবর্তী সময়ে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শত শত ট্রাক-লরি এখান থেকে ওখানে যায়, আবার ওখান থেকে এখানে আসে। এখানে কোনো পণ্যের অভাব হলে সেখান থেকে আসে, আবার সেখানে কোনো পণ্যের অভাব হলে এখান থেকে যায়। এটা দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলছে। এমনকি গরু পর্যন্ত ভারত থেকে ‘আমদানি’ হয়। তবে তা বৈধভাবে নয়। একটা ‘মেকানিজম’ করে তা আনা হয়।

এ বাণিজ্য শুধু বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেই হয় না, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারেরও হয়। এর ফলে কত পণ্য বৈধ পথে আসে-যায়, আর কত পণ্য অবৈধ পথে, তার হিসাব করা কঠিন। এই বাণিজ্যে সীমান্তের লাখ লাখ লোক জড়িত। এটা একটা বড় ‘অ্যাকটিভিটি’। বহু লোক এ কাজ করে সংসার চালান। তবে এক্ষেত্রে একটা মুশকিল আছে। ভারতের রপ্তানিকারকরা কি বাংলাদেশের চোরাকারবারিদের পণ্য বিনা পয়সায় দেয়? নিশ্চয়ই না। এর জন্য নিশ্চিত পরিশোধ ব্যবস্থা থাকতে হয়। পণ্যের বেশিরভাগ আসে ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। সরকারিভাবে আমদানির পরিমাণ কম, কিন্তু আসে বেশি।

ঋণপত্রের মূল্য কম, কিন্তু পণ্য আসে বেশি। বলা বাহুল্য, ওই বাড়তি পণ্যের টাকা পরিশোধ করে হুন্ডিওয়ালারা। বিদেশে আহরিত ডলার এ কাজে ব্যবহৃত হয়। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। গড়ে ওঠে কালো অর্থনীতি-বাণিজ্য। তবে একটা ফল হয় উপকারভোগী ভোক্তাদের জন্য। সরকারের রাজস্ব না দেওয়ার কারণে পণ্যের ‘পড়তা’ কম পড়ে। সরকারি রাজস্ব দিতে হলে পণ্যের দাম বেশি পড়ত-অর্থনীতি হতো ‘হাইকস্ট ইকোনমি’।

অবশ্য এখানে কথা আছে। বিপুল পরিমাণ চোরাচালানির পণ্যের দাম হয় অনেক, যা অনেক সময় শুধু ডলারে পরিশোধ করা যায় না। দেনা-পাওনায় একটা ‘ইমব্যালেন্স’ থাকে। সেই ‘রেসিডিউ’ পাওনা বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা স্বর্ণে পরিশোধ করে। সেজন্য দুদিন পরপরই আমাদের এখানে চোরাচালানের স্বর্ণ ধরা পড়ে। এভাবেই চলছে অনেকদিন থেকে। প্রশ্ন হলো, এই লুকোচুরির কি শেষ হবে না কোনোদিন? বৈধপথে পণ্য আনার ব্যবস্থা করে কি সরকারের রাজস্ব বাড়ানো যায় না?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম