Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কেঁদে কেঁদে চোখ নষ্ট

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেঁদে কেঁদে চোখ নষ্ট

অনেকদিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছি। কখনো লাল, কখনো হলুদ, কখনো চুলকায়, ব্যথা করে, পানি পড়ে। হরেক রকম যাতনা। লেখা বন্ধ, পড়া বন্ধ। কালো চশমা পরে, চোখের ওপর কাপড় দিয়ে শুয়ে শুয়ে অতীত দিনের স্মৃতি রোমন্থন করি আর ভাবি কত ভালো ছিল এ চোখ দুটো!

এ চোখ দিয়ে কত কাজই না করেছি! এখন প্রায়ান্ধ। ভাবি আর কান্না পায়। চোখ ভালো না হলে আমি করবটা কী? আমার বেঁচে থাকা যে অনেকাংশেই চোখনির্ভর।

সুমন তো আর সাধে গাননি-চল্লিশ পেরুলেই ‘চালসে’। চালসে শব্দ আগে তেমন চাউর ছিল না। সুমন গাইবার পর খুব জনপ্রিয় হলো। পানসে চালসের মধ্যে কেমন যেন একটা হারাই হারাই ভাব আছে।

আমার চোখের অবস্থা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মতো। ছেলেবেলায় অনেক নেতা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বাবা-ভাইরা রাজনীতি করতেন, নেতা-মন্ত্রীদের আনাগোনা ছিল বাড়িতে। কাছ থেকে দেখেছি তাদের। তখনকার নেতারা ছিলেন জনবান্ধব। যে দলেরই হোক না কেন, সবার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন। সময় দিতেন। মিটিং-মিছিল-আন্দোলন ছাড়া তেমন রাগ করতেন না। নেতা মানেই কোটি কোটি টাকা, গাড়ি-বাড়ি এমনটাও ছিল না। সব কিছুর পেছনে একটা হিসাব-নিকাশ ছিল। ওরা জানতেন, ভালো ব্যবহার না করলে, কাজ না করলে ভোট পাবেন না।

তাই জনগণকে সমঝে চলতেন। দিন বদলেছে। এখনকার নেতাদের মেজাজ কখনো আমার চোখের মতো লাল, কখনো হলদে, কখনো চুলকানির মতো তিরিক্ষি, কখনো বাজখাই। ওদের মেজাজে পাবলিকের চোখে পানি ঝরে, ওদের চোখে না।

রাজনৈতিক বাড়ি বলে এলাকার অনেক তদবির আমার কাছে আসে। বাবা রাজনীতি করেছেন, ভাইরা করেছেন, এলাকার জনগণের দাবি আমাকেও করতে হবে। ওদের বোঝাতে পারি না, আমি অবসরে গিয়েছি। অবসরপ্রাপ্ত লোকের ফুটো পয়সাও দাম নেই। চাকরিতে থাকতেই বা কার জন্য কী করতে পেরেছি! যা হোক, নাছোড় লোকজন তদবির পাঠায়, আমিও সাধ্যমতো চেষ্টা করি। সম্প্রতি তেমনই কিছু তদবিরে কয়েকজন নেতা আর মন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হলো। প্রভাবশালী এবং সুনাম আছে এমন একজন মন্ত্রীর বাড়িতে গেলাম সময় নিয়ে। তিনি অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে বলে পাঠালেন, এখনই অফিসে যাবেন। আমি যেন অফিসে দেখা করি। তাই যদি হয় আমাকে সময় দেওয়া কেন! গেলাম অফিসে। সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বসে রইলাম। তার পিএসও যথেষ্ট চেষ্টা করল। দেখা হলো না। বাইরে তখন সারি সারি লোক দাঁড়িয়ে। আরেক মন্ত্রীর বাসায় গেলাম যোগাযোগ করে। সকাল ৯টায় গিয়ে ১২টা পর্যন্ত বসে রইলাম। ১২টার সময় একজন এসে বলল, অফিসে গিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করেন, না হলে অন্যদিন আসেন।

বন্ধের দিন এলে ভালো হয়। শুনলাম তিনি অফিসে যান ৩টা-সাড়ে ৩টায়। তিনি জনগণের সেবক। সময়মতো অফিসে না গেলেও চলে। তিনি তো আর চাকরি করেন না। যারা চাকরি করে তাদের জন্য ওই সাড়ে ৩টার পর অফিস শুরু করতে হয়। কিন্তু বলার সাধ্য কার! অফিসে না গিয়ে শুক্রবার তার বাসায় গেলাম। সেদিনও দুঘণ্টা বসিয়ে রেখে বলে দেওয়া হলো, তিনি বন্ধের দিন দেখা করেন না। কাকে বলব, আগের দিন বলা হয়েছিল তিনি বন্ধের দিন দেখা করেন। ওয়েটিংরুমে তখন বসে আছে দর্শনার্থীরা। তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ত্যাগ করলাম। এরপর একদিন গেলাম এক প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে। তিনি বাইরে প্রোগ্রামে আছেন। এলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে।

তিনি নাকি ভিআইপিদের নিয়ে বসে আছেন। সমানে চা-নাশতা সাপ্লাই হচ্ছে। তিনি যদি ভিআইপিদের নিয়ে বসেই থাকেন, অফিসের কাজ কখন করবেন; আর জনগণের সঙ্গেই বা কখন দেখা করবেন! চার পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর তিনি বলে পাঠালেন একসঙ্গে তিনজন করে পাঠাতে। গেলাম। ঘরবোঝাই তখনো লোক। ওই পরিস্থিতিতে কী আর বলা যায়, কতটুকু বলা যায়? তিনি যেন তাড়াতে পারলেই বাঁচেন! যাদের কথা বললাম, তারা সবাই পদে আছেন।

এ তো গেল এলাকার তদবিরের কথা। লেখালেখি করি বলে মাঝেমাঝে ইন্টারভিউ নিতে হয়। এক্ষেত্রে আছে হতাশ করা অভিজ্ঞতা। পদে নেই এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যিনি একাধিকবার মন্ত্রী ছিলেন, ছিলেন ছাত্রনেতা, তার কাছে গেলাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে। তিনি ইন্টারভিউ দিচ্ছেন টিভিতে। অল্পবয়সি একটা মেয়ে ইন্টারভিউ নিচ্ছে। খুবই হাসিমুখ! আমার সঙ্গে আরও দুজনকে ঢোকানো হলো। চেহারায় গাম্ভীর্য নেমে এলো। ইন্টারভিউয়ের কথা বলতেই রেগে উঠলেন। বললেন, ইন্টারভিউ দিতে পারবেন না। একটা লেখা আছে, ওটা যেন নিয়ে নেই। আমি এসেছি ইন্টারভিউ নিতে, তার লেখা দিয়ে আমি কী করব! তাতে ওই একই লেখা তিনি দশ জায়গায় পাঠিয়েছেন। আমি অন্তত তিন জায়গায় পড়েছি। ছবি তুলতে চাইলে আঁতকে উঠলেন। মনে হলো কোনো নারীর সঙ্গে তিনি জীবনে ছবিই তোলেননি।

‘নাউজুবিল্লাহ’টা খালি বলেননি। অথচ মাঝেমাঝেই তাকে নারী পরিবেষ্টিত দেখি। আরেক নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলে তার ইন্টারভিউ নিতে চাইলাম। তিনি সময় দিলেন। বাসার ঠিকানা জানতে চাইলে ভীষণ নাখোশ হলেন। যেন তার ঠিকানা না জানা বড় কোনো অপরাধ। অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে তার বাসায় গেলাম। আমার ছেলেও সঙ্গে গেল। তিনি এক সময়ের হিরো (নায়ক নন)। ছেলে তার ছবি তুলতে চায়। বাসায় গেলাম। ভালোই আপ্যায়ন করলেন। স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ইন্টারভিউ নিতে চাইলেই আগডুমবাগডুম শুরু করলেন।

কিছুতেই লাইনে আসবেন না তিনি। পরে বললেন, আগামীকাল আসুন। ইন্টারভিউ দেব। বেরিয়ে এলাম। পথে ছেলে বলল, আসবে তো? বললাম, মোটেও না। আস্তে আস্তে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে আমার। এরপর গেলাম আরেক নেতার কাছে। তিনিও অনেক গল্প করলেন। গা ঘেঁষে বসে ছবি তুললেন। আমি যত সরি, তিনি ততই এগিয়ে আসেন। শেষে বললাম, এমন করে তুললে এ ছবি বইতে দেওয়া যাবে না। তিনি নিরস্ত হলেন। এরপর বললাম ইন্টারভিউয়ের কথা।

হঠাৎ করেই যেন তার মাথাব্যথা শুরু হলো। এরপর প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। আমি বুঝলাম পুরোটাই অভিনয়। কথা তিনি বলতে জানেন না। মনে করে দেখলাম তাকে কোথাও বক্তৃতা দিতে দেখিনি। প্রশ্ন জাগল মনে, এতসব বই তার, সেগুলো তিনি লিখেছেন তো? মনে পড়ল, একজন বলেছিলেন তার বইগুলো অন্যের লেখা। তখন ভেবেছিলাম লোকটা দুর্মুখ!

একের পর এক অভিনব ও ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে! এরাই আমাদের জনপ্রতিনিধি! দিনকয়েক আগে একজনের ছোট্ট একটা কাজের জন্য এলাকার এমপিকে ফোন করলাম। তিনি যথারীতি ফোন ধরলেন না। তার পিএসকে ফোন করলাম। পরিচয় দিয়ে বললাম, এমপি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

পিএস কেবল হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট দেখাতে শুরু করেছিল। আমার পরিচয় শুনে চুপসে গেল। তারপরও বলল, তিনি এ প্রজেক্ট, সে প্রজেক্ট নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বললাম, আমার কথা বলেন, দেখা করবে। তিনি বললেন, একটু পরেই জানাচ্ছেন। তিনদিন অপেক্ষা করার পর আবার ফোন করলাম। এবারও বললেন এক্ষুণি জানাচ্ছেন। সে ফোন আর আসেনি। এমন নয় যে এই এমপিকে আমি চিনি না বা তিনি আমাকে চেনেন না। তারপরও এই অবস্থা!

মনে প্রশ্ন জাগে, তারা কি কখনো ভেবেছেন, তাদের কাছে যেতে জনগণের পয়সা খরচ হয়, সময় অপচয় হয়, মনের ওপর চাপ পড়ে। আর যারা প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকে, তাদের মন ভেঙে যায়। তাদের চারপাশে একটা বলয় আছে। সমস্বরে তাদের একটাই কথা-‘অনেক কাজ, অনেক কাজ, কাজের জ্বালায় তারা পথ চোখে দেখেন না।’ ছেলেবেলায় একটা কথা শুনেছিলাম, ‘অত গুড় একসের না’। এদের দেখে আমার তা-ই মনে হয়। তাদের কাজ যতটা, অকাজ তার চেয়ে অনেক বেশি!

আমি শুধু ভাবছি আর ভাবছি, আমার তবু একটা পরিচয় আছে। বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারি, বসার চেয়ার পাই, কখনো কখনো চা-ও পাই। কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে! তাদের কথা ভেবে, তাদের কাতারে নিজেকে দাঁড় করিয়ে আমি শুধু কাঁদছি আর কাঁদছি। আর সেই কান্না থেকেই আজ আমার চোখের এই দুরবস্থা!

আফরোজা পারভীন : কথাশিল্পী, গবেষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম