দেশে ডিমেনশিয়ার সামাজিক প্রভাব
ড. মতিউর রহমান
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডিমেনশিয়া কোনো মানসিক রোগ নয়। এটি মস্তিষ্কের একটি রোগ। ডিমেনশিয়া হলো এমন একটি সিনড্রোম যেখানে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করার ক্ষমতা লোপ পায়। কিন্তু পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে এ রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা। এগুলো দূর করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বয়স্ক ব্যক্তিরাই সাধারণত ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। তবে এটি বার্ধক্যের একটি স্বাভাবিক অংশ নয়। বয়স একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ হলেও নির্দিষ্ট জেনেটিক বা বংশগত কারণে অল্পবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যেও ডিমেনশিয়া হতে পারে। যদিও বেশিরভাগ ধরনের ডিমেনশিয়ার বর্তমানে তেমন কার্যকর কোনো প্রতিকার নেই, তবে লক্ষণগুলো বুঝতে, রোগের অগ্রগতি ধীর করতে এবং ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। ওষুধ, জ্ঞানীয় উদ্দীপনা, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ব্যক্তি এবং তার পরিবারের নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণের জন্য সহায়তা পরিষেবা এর অন্তর্ভুক্ত।
দেশে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে নথিভুক্ত নয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, ডিমেনশিয়া আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সি ব্যক্তিদের প্রবীণ নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হয় এবং সংখ্যাটি মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ (২.৫ কোটির বেশি)। ৬৫ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫.৮৮ শতাংশ। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে দেশে ৬৫ বছর বা এর বেশি বয়সি মানুষ রয়েছেন ১.৫৩ কোটি। দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। ২০১১ সালে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ছিল ১.০২ কোটি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১১ বছরে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৫০.০১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪.৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যার বৃদ্ধির হার ৩.৪১ গুণ বেশি। সমাজে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য সুবিধা ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ বর্তমানে মোট জিডিপির ১ শতাংশেরও কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩৫ সাল থেকে বাংলাদেশে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সংকুচিত হতে শুরু করবে এবং বাংলাদেশ ২০৪৭ সালে একটি ‘বয়স্ক জনগোষ্ঠীর’ দেশে পরিণত হতে শুরু করবে। আর এই বিপুলসংখ্যক বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিমেনশিয়াসহ মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ যে বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মানুষের ডিমেনশিয়া রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বাস করছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে খুব কম তথ্য রয়েছে। একটি জাতীয় সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশে ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সি প্রতি ১২ জনের একজনের ডিমেনশিয়া রয়েছে। সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, ২০২৫ সালে দেশে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখ ৩৭ হাজার এবং ২০৪১ সালে তা এর দ্বিগুণ হতে পারে, যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা না করলে আরও বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিন দিন এ রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। সে হিসাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা খুবই কম।
দেশে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি উচ্চবিত্তের মানুষও রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে আছেন, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। উচ্চবিত্ত অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে রোগটির ক্ষেত্রে বেশি দরকার সচেতনতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ রোগ, এর লক্ষণ এবং সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত। এ কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামাজিক কুসংস্কার, অযত্ন, অবহেলার শিকার হন। অপরদিকে যে পরিবারে এ রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী রয়েছেন, তাদেরও মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক দিক দিয়ে যন্ত্রণাময় দিন পার করতে হয়।
ডিমেনশিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি যত্ন ও সহায়তা প্রয়োজন, যা পরিবারের সদস্য বা পরিচর্যাকারীদের ওপর একটি উল্লেখযোগ্য বোঝা চাপিয়ে দেয়। বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন তুলনামূলক শক্তিশালী এবং যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে পরিবারের সদস্যদের ওপরই বর্তায়। যারা ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীর যত্ন নেন, তারা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক চাপ অনুভব করতে পারেন, যা তাদের সামাজিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
ডিমেনশিয়া পারিবারিক গতিশীলতা এবং সম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে। জ্ঞানীয় কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা আচরণ, ব্যক্তিত্ব ও যোগাযোগ ক্ষমতার পরিবর্তন অনুভব করতে পারে। এটি স্বামী, স্ত্রী, সন্তান এবং বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ঘটাতে পারে, যার ফলে পরিবারের মধ্যে উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশসহ অনেক সমাজে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীকে ভুল বোঝা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। এই ভুল ধারণার কারণে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা বৈষম্য ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হতে পারে।
ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির যত্ন ব্যয়বহুল হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে ওষুধসংক্রান্ত খরচ, চিকিৎসা পরামর্শ, বিশেষ যত্নের ব্যয় ও সহায়তা পরিষেবা। বাংলাদেশে যেখানে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার অনেকের জন্য এখনো একটি চ্যালেঞ্জ, সেখানে ডিমেনশিয়া চিকিৎসার আর্থিক বোঝা অনেক পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ হতে পারে।
ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারকে সহায়তা প্রদানে সমাজের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব কমিউনিটি সাপোর্ট সিস্টেমকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। দেশে ডিমেনশিয়ার সামাজিক প্রভাব মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারকে সম্পৃক্ত করে একটি ব্যাপক পদ্ধতির প্রয়োজন। ভুল ধারণা দূর করতে, কলঙ্ক কমাতে এবং বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্য ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিমেনশিয়া নিয়ে সরকারিভাবে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। রোগটির তেমন চিকিৎসা নেই। কাজেই চিকিৎসকরাও এ রোগে আক্রান্ত কারও চিকিৎসা করতে উৎসাহ দেখান না। কারণ, এতে তার প্রফেশনাল সুনাম নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু এটি শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়, রোগটি নিয়ে সচেতনতা তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এটি হলে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
ডিমেনশিয়া মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ চোখে না পড়লেও বেসরকারি উদ্যোগে গুটিকয়েক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কিছু কাজ করছে। এদের মধ্যে অ্যালঝেইমার সোসাইটি অব বাংলাদেশ অন্যতম। ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে তারা প্রায়ই বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে, যা ডিমেনশিয়া সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে এবং এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। অ্যালঝেইমার সোসাইটি অব বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে তাদের কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। এ সোসাইটি ২০০৭ সাল থেকে ডিমেনশিয়া রোগ সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি, তাদের পরিচর্যাকারী ও তাদের পরিবারগুলোর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিচর্যা করার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভার না থাকার কারণে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এজন্য ডিমেনশিয়া কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম।
ডিমেনশিয়া মোকাবিলায় এখনই সরকারিভাবে জাতীয় নীতি ও সেবাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এজন্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। তাদের মতে, হাসপাতালগুলোয় ডিমেনশিয়া কর্নার তৈরি করা এবং ডাক্তার ও নার্সদের তাদের করণীয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি হলে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীরা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।
ডিমেনশিয়া বয়োবৃদ্ধির স্বাভাবিক কোনো অংশ নয়, এটি মস্তিষ্কের রোগ। ডিমেনশিয়া পুরোপুরি ভালো করার কোনো কার্যকর ওষুধ নেই, তবে আমাদের যত্ন ও প্রতিরোধের দিকে নজর দিতে হবে, যাতে দেশের ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা মর্যাদাপূর্ণভাবে জীবনযাপন করতে পারেন।
ড. মতিউর রহমান : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী