ইসরাইল বর্ণবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে
ড. দনিয়া কোলেইলাত খতিব
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু গত মাসে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। জানা যায়, এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তিনি আইনপ্রণেতাদের বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ‘চূর্ণ করা প্রয়োজন’। সেসময় তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন। নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তার ইচ্ছা প্রকাশের পাশাপাশি এটাও বলেন যে, তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ধ্বংস করতে চান না।
যদিও এটা অনেক আগেই পরিষ্কার ছিল যে, ইসরাইলের উদ্দেশ্যই হলো ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রকে অস্বীকার করা, তবে এবারই প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী এতটা স্পষ্ট ও নির্লজ্জভাবে ঘোষণাটি দিলেন। অবশ্য আরিয়েল শ্যারন সবসময় বলতেন, জর্ডান হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের জন্য; তবে এর আগে কখনো কোনো প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা নির্মূলের কথা বলেননি।
ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা যে শূন্য, বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর বক্তব্য থেকেই তা স্পষ্ট। আব্রাহাম চুক্তির একটি অন্যতম প্রতিশ্রুতিই ছিল পশ্চিম তীরের বিশাল অংশে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার বিতর্কিত পরিকল্পনা বন্ধ করা হবে। নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, বসতি স্থাপনের সম্প্রসারণ অভিযান থেকে তিনি সরে আসবেন না। সত্যি বলতে কী, তিনি এখন নতুন করে আরও ৫ হাজার ৭০০টি বসতি গড়ার পরিকল্পনা করেছেন।
এমিরেটস পলিসি সেন্টারের প্রেসিডেন্ট এবতেসাম আল-কেতবি গত মাসে বলেছিলেন, ইসরাইলের আচরণ বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে কোনো আরব রাষ্ট্রের সঙ্গেই ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে না। তবে সামান্য হলেও এটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে, কারণ নেতানিয়াহুর মূল উদ্দেশ্য হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টের মতো পরিণতি এড়াতে তার জোটকে একসঙ্গে রাখা এবং ক্ষমতায় থাকা।
ইসরাইলের ঔদ্ধত্য এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার অর্থ হচ্ছে উদ্দেশ্য থেকে তারা এক পা-ও নড়বে না, এমনকি মিথ্যা আশ্বাস দিয়েও নয়। মার্কিন ইহুদি, যাদের ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রধান সমর্থক বলা হয়, তাদের ভাবনাকেও তিনি পরোয়া করছেন না বলেই মনে হচ্ছে। তাদের একটি মতাদর্শগত পরিকল্পনা আছে এবং তা অর্জনে তারা বদ্ধপরিকর। বস্তুত, গত সপ্তাহে যখন জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখলে থাকা ইভাতার চৌকিতে বসতি নির্মাণের জন্য অবিলম্বে অনুমোদন দেওয়ার আহ্বান জানান সরকারের প্রতি, তখন তিনি বলেছিলেন, ইসরাইলের উচিত ‘হাজার হাজার সন্ত্রাসীকে’ হত্যা করা। রাজনৈতিক বক্তব্য এতটা অশোভন না হলেও সরকারের সেসবে পরোয়া করছে না।
তবে নেতানিয়াহুর এ প্রতিজ্ঞা কাজে দেয়নি। এর আগে সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে দায়ানও এ চেষ্টা করেছিলেন। ইসরাইল ১৯৬৭ সালে যখন পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন তাদের নীতি ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অনুমতি দেওয়ার, আশা ছিল এর ফলে ফিলিস্তিনিরা তাদের রাজনৈতিক অধিকারের কথা ভুলে যাবে। কিন্তু ২০ বছর পর প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয় (পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল ওইসব অঞ্চলে ইসরাইলের দখলদারত্বের অবসান ঘটানো এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন করা)। ১৯৮৯ সালে টমাস ফ্রিডম্যান তার বিখ্যাত বই ‘ফ্রম বৈরুত টু জেরুসালেমে’ (বৈরুত থেকে জেরুসালেম) ফিলিস্তিনি ও দখলদারের মধ্যকার সম্পর্ককে একটি দম্পতির সঙ্গে তুলনা করেন, যারা ২০ বছর ধরে একসঙ্গে বসবাস করছিল। শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করে তারা চেয়েছিল বিচ্ছেদ ঘটাতে।
প্রথম ইন্তিফাদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে। তা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য ফিলিস্তিনিরা তাদের রাজনৈতিক অধিকার বিনিময় করবে না। তাদের চেতনার বিকাশ ঘটেছে এবং তারা তাদের নিজেদের দেশ চায়। চরমপন্থিরা যত বেশি ফিলিস্তিনিদের আরব হিসাবে আরও বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করার চেষ্টা করে, নিজস্ব রাষ্ট্র থাকার অধিকারকে অস্বীকার করায় তারা তাদের রাষ্ট্রত্বের দাবিতে ততই অনড় হয়ে ওঠে।
তবে ইসরাইলিদের জন্যও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে, ইসরাইল শান্তি আলোচনা দীর্ঘায়িত ও ব্যর্থ করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ইস্যুটি এড়াতে সক্ষম হয়েছে। সেটা একটা ভালো নাটক ছিল। সে আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকে দেখানো যে, ইসরাইল চেয়েছে ফিলিস্তিনিদের একটি রাষ্ট্র হোক; কিন্তু একই সময়ে তারা তাদের বসতি সম্প্রসারণ কার্যক্রমও চালু রাখে। এটি ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা। আসলে ইসরাইল এ স্থিতাবস্থাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল।
এখন ইসরাইল স্বীকার করেছে যে, ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র দিতে তারা চায় না, তাহলে এর সমাধান কী? ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক মর্যাদা কী হবে? ধরে নেওয়া গেল ইসরাইল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সুতরাং তার উচিত এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। কোনো অধিকার ছাড়া বসবাস করে তারা কী করে গণতন্ত্রের কথা বলতে পারে? বিতর্কিত তথাকথিত চিন্তাবিদ এডি কোহেন, যিনি আরবদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত কথা বলে থাকেন, তিনি এ ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন যে, ফিলিস্তিনিরা সেখানে বসবাস করতে পারে এবং তাদের ব্যক্তিগত অধিকার থাকতে পারে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক অধিকার থাকতে পারে না।
তবে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে এটা চলে না। ইসরাইল এই সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ধারণা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের কাছে বিব্রতকর হয়ে উঠছে, যা দেশটিতেও আলোচনার মূল বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু নেতানিয়াহু এবং তার লোকেরা এটা বুঝতে পারছেন না যে, যদি তারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণাকে নির্মূল করে দেন, তাহলে এসব মানুষের অন্য দেশের নাগরিক হওয়ার প্রয়োজন হবে; খুব সম্ভবত সেই দেশের, যার ভূমি দখল করে তারা বসবাস করছে-ইসরাইল। তা কি ইসরাইল চায়? এখন না হোক, কোনো সময়ে রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাইল আরব লীগে যোগ দিতে চাইবে। ইহুদিদের চেয়ে বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নিয়ে সেখানে তার যোগ দেওয়া কতটা সাহসিকতার কাজ হবে? খুব সম্ভবত ইসরাইলিরা তা চায় না। আসলে ইসরাইলিরা চায় ইহুদিদের নিজেদের একটি রাষ্ট্র হোক, যদিও বাস্তবায়িত সব নীতিই আসলে এর উদ্দেশ্যের বিপরীত।
ডেভিড বেন-গুরিয়ন যখন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি জানতেন যে ইসরাইল কখনোই ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদিদের গণতান্ত্রিক স্থান হতে পারে না। তিনি জানতেন, বসতি স্থাপনকারীদের রাষ্ট্রের চরিত্রের মতো একটি বিকল্প গঠন করতে হবে। বেন-গুরিয়ন এটাও জানতেন যে, নির্মমভাবে উচ্ছেদ এবং জাতিগত নির্মূল অভিযানের পরও ইহুদিরা ফিলিস্তিনের পুরো ভূমিকে তাদের নিজেদের করে পাবে না।
এখন, নেতানিয়াহু সরকারের অগণতান্ত্রিক ব্যক্তিরা, যারা মতাদর্শ দ্বারা অন্ধ, ফিলিস্তিনের পুরো ভূখণ্ডে একটি অগণতান্ত্রিক ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যতক্ষণ না তাদের এ উদ্দেশ্য সাধন হবে, তারা তাদের বর্ণবাদী শাসন চালিয়েই যাবে। এত কিছুর পরও এ ধরনের রাষ্ট্র টেকে না; যেখানে সমান অধিকার থাকলেও বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থাকে অনুসরণ করা হয়। ইহুদিরা যখন ইসরাইলে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে, তখন ইহুদিদের নিজস্ব একটি রাষ্ট্রের ধারণাই নষ্ট হবে।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস
ড. দনিয়া কোলেইলাত খতিব : মার্কিন-আরব সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ; সভাপতি, রিসার্চ সেন্টার ফর কোঅপারেশন অ্যান্ড পিস বিল্ডিং