মেগা প্রকল্পগুলো দেশকে করে তুলছে স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ
মো. নূরুল আমিন
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২৫ জুন ২০২২ তারিখে উদ্বোধন হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সড়কপথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে।
এটি বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত বাংলাদেশের একটি মেগা প্রকল্প। ২০১১ সালে এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই করে সরকার।
কিন্তু নির্মাণকাজ তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক, একের পর এক সব প্রতিষ্ঠানে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত করে। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন দেশের টাকায় হবে পদ্মা সেতু। ২০১৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়ে দেয় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোর এক আদালত জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্বার সাহস ও অসীম দৃঢ়তায় ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর নির্মাণকাজ উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু হয় পদ্মা সেতুর কাজ। পদ্মা সেতুর ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি. হলেও সেতুর বাইরে উড়াল পথ ৩.৬৮ কিমি.।
সব মিলে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯.৮৩ কিমি.। সেতু তৈরিতে পদ্মার দুই পাড়ে নদী শাসন করা হয়েছে প্রায় ১৪ কিমি.। সেতুটি ১০ হাজার টন ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বেয়ারিং ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার কারণে রিখটার স্কেলে ৯.০ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয়। বিশ্বের গভীরতম (১২০ মিটার) পাইলের সেতু এটি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন।
তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা, পদ্মা সেতু করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন। এমনকি গত ০১.০২.২০২৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসকে পদ্মা সেতুর চিত্রকর্ম উপহার দিয়ে একরকম মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন।
গত বছর পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল করেছে ৫৬ লাখ ৫৪ হাজার ২০৮টি এবং এ থেকে মোট টোল আদায় হয়েছে ৭৯৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা। সেতুটির মাধ্যমে যেমন দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমন পদ্মার দক্ষিণ পারে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প স্থাপনসহ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনীতিতে এসেছে দুর্বার গতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে ৪ লেনবিশিষ্ট প্রথম টানেল। এ টানেল কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এ টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন। এর জন্য ব্যয় হবে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা এবং ব্যবহার শুরু হবে ২০২৩ সালের শেষ দিকে।
এ টানেল দিয়ে যাতায়াতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে ৪০ কিলোমিটার। বাংলাদেশে নদীর তলদেশে টানেল হবে তা ছিল স্বপ্ন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানেলটি দেশের অন্যতম যানজটপূর্ণ শহর চট্টগ্রামে যানজট কমিয়ে দেবে। টানেল চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ২৮,৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল শুধু চট্টগ্রামের জন্য নয়, গোটা দেশের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এমআরটি লাইন (মেট্রোরেল) ৬-এর নির্মাণ কাজ। আর ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেলে চড়ে শুরু করলেন মেট্রোরেলের জয়যাত্রা। উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার চালু হয়েছে। মানুষের মাঝে যে উৎসাহ উদ্দীপনা, তা ট্রেনে যারা যাত্রী তারাই শুধু অনুধাবন করতে পারেন। যদি এই রেল কমলাপুর পর্যন্ত চালু হয়ে যায়, তবে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণ করা সম্ভব হবে। তখন যেমন ঢাকা শহরের মানুষ উপকৃত হবে, তেমনি যানজট কমবে, কর্মঘণ্টা বাঁচবে, পরিবেশ দূষণ কমবে, জ্বালানি সাশ্রয় হবে।
এটিও শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা এবং জুলাই মাসে মতিঝিল পর্যন্ত পরীক্ষামূলক চালু হয়ে অক্টোবরে চূড়ান্তভাবে এটি চালু হবে।
কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে মাতারবাড়ী এলাকায় নির্মাণ হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। এ কাজে অন্তত ১৫ মিটার গভীরতাসম্পন্ন জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। প্রতিটি জাহাজ ৮০০০-এর বেশি কনটেইনার আনতে পারবে। মাতারবাড়ী বন্দর স্থাপনের কাজে প্রায় ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নৌ-চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে।
যার ফলে আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, তেলবাহী ট্যাঙ্কার ও খোলা পণ্যবাহী জাহাজ জেটিতে ভেড়ার সুযোগ পাবে। দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় বিদেশ থেকে এলপিজি বা এলএনজি আনতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা চলে যেত। বর্তমানে এলপিজি নিয়ে জাহাজ আসছে সরাসরি। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম খননকৃত বন্দর। দেশের আমদানি-রপ্তানিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে এটি। গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে ব্যয় হবে ১৭,৭৭৭ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সক্ষমতায় এগিয়ে যাবে দেশ।
২০২৬ সালে নির্মাণকাজ শেষ হবে। তখন আর অন্য দেশের বন্দর আমাদের ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। এই কৃতিত্বের দাবিদার শেখ হাসিনা। পুরোদমে মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে এবং তা জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ অবদান রাখবে।
হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণ কাজের ৬০ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয়েছে। আগামী অক্টোবর মাসে এ টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন হবে বলে জানা গেছে। নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। তৃতীয় টার্মিনালটি হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকা নিয়ে।
তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে বছরে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। নতুন টার্মিনালে থাকবে ১ হাজার ৩০০ গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা। এটি হবে দৃষ্টিনন্দন, থাকবে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা। এতে বাড়বে দেশের মর্যাদা, ত্বরান্বিত হবে অর্থনীতির গতি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২,৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পরিকল্পিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর জন্য ব্যয় হবে ১,১৩,০৯,২৯১ কোটি টাকা এবং এ কেন্দ্রের ইতোমধ্যে ৭৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন কর্তৃক নির্মিত হচ্ছে।
২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া সফরকালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রাক-প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বাধুনিক নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে এ প্রকল্পে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান জ্বালানি হচ্ছে ইউরেনিয়াম। এটি জ্বালানি শক্তি আমদানি হ্রাস করবে।
গ্যাসনির্ভরতা, পেট্রোলিয়াম, কয়লানির্ভরতা কমে আসবে। এ কেন্দ্র ২টি এমনভাবে নির্মিত হচ্ছে, যেন শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা মোকাবিলা করে টিকে থাকতে পারে। এ কেন্দ্রটি নির্মিত হলে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটবে। নতুন শিল্প স্থাপন সম্ভব হবে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ও সুদৃঢ় হবে। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মানুষ রক্ষা পাবে।
পদ্মা সেতুসহ এসব মেগা প্রকল্প দেশকে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ হবে অর্থনীতিতে স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ।
মো. নূরুল আমিন : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন; সাবেক সিনিয়র সচিব