Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

পরিশুদ্ধ গণমাধ্যমের পথিকৃৎ

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পরিশুদ্ধ গণমাধ্যমের পথিকৃৎ

বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ‘সফলতা’ কবিতা উচ্চারণে দেশবরেণ্য শিল্পপতি এবং যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রয়াত নুরুল ইসলাম ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই স্বল্প পরিসরে এ নিবন্ধ উপস্থাপন করছি। ‘মাঝে মাঝে কতবার ভাবি, কর্মহীন/আজ নষ্ট হল বেলা, নষ্ট হল দিন।/নষ্ট হয় নাই, প্রভু, সে-সকল ক্ষণ-/আপনি তাদের তুমি করেছ গ্রহণ/ওগো অন্তর্যামী দেব! অন্তরে অন্তরে/ গোপনে প্রচ্ছন্ন রহি কোন অবসরে/ বীজেরে অঙ্কুররূপে তুলেছ জাগায়ে,/ মুকুলে প্রস্ফুট-বর্ণে দিয়েছ রাঙায়ে।/ ফুলেরে করেছ ফল রসে সুমধুর,/ বীজে পরিণতগর্ভ। আমি নিদ্রাতুর/ আলস্যশয্যার পরে শ্রান্তিতে মরিয়া/ ভেবেছিনু সব কর্ম রহিল পড়িয়া।/ প্রভাতে জাগিয়া উঠি মেলিনু নয়ন;/ দেখিনু, ভরিয়া আছে আমার কানন।’

এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শুধু শুদ্ধতম ব্যবসায়ী সমাজের পথিকৃৎ ছিলেন না; যমুনা গ্রুপ শিল্প পরিবারের অত্যন্ত সফল একজন উদ্যোক্তা হিসাবে নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অসময়ে তার আকস্মিক চলে যাওয়ায় বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের হৃদয়ে সীমাহীন শূন্যতা তৈরি হয়েছে। বিবেক-আবেগ-দেশপ্রেমে পরিশুদ্ধ এ মহান ব্যক্তির তিরোধানে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনের মতো যথাযথ ভাষাশৈলীর ব্যবহার সত্যিই দুরূহ।

এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, স্রষ্টার অখণ্ডনীয় বিধান অনুসারে জন্মেই মানুষের জীবনাবসানের দিনপঞ্জি নির্ধারিত থাকে। ধরিত্রীর বুকে ইহ-পরকালের নিগূঢ় বন্ধনকে পরিপূর্ণ উপলব্ধিতে নিয়ে পরপারের অমূল্য সময়কালকে অকৃত্রিম নিষ্ঠা-ভালোবাসা-শ্রমের মর্যাদায় যারা মহিমান্বিত করতে পেরেছেন; তারাই ইতিহাসের অধ্যায়ে সফল ও সার্থক অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। তেমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনগণের আকাক্সক্ষা লালনকারী পত্রিকা দৈনিক যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা জনাব নুরুল ইসলাম। তার নিরলস প্রচেষ্টা ও নিরন্তর পরীক্ষণ-সমীক্ষণ এ পত্রিকাকে সামগ্রিক আঙ্গিকে বিপুল সমাদৃত করেছে। পত্রিকটির প্রকাশনা, প্রচার-প্রসারে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন, মেধা-প্রজ্ঞার সম্মিলন ঘটিয়েছেন।

সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই ধরিত্রীর সব নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণের আড়ালে যাদের অবদান বিশ্বস্বীকৃত, প্রকৌশল বিজ্ঞানের আধুনিক ধারায় তারাই স্থপতি অভিধায় অভিসিক্ত। মনন-সৃজনশীল-অপরূপ সৌন্দর্যের দৃষ্টি-হৃদয়নন্দন শৈলীতে সৃষ্ট তাদের কর্মযজ্ঞ সময়ের আবর্তনে ইতিহাসের ঐতিহ্যিক অধ্যায়ে পরিণত। এখনো গ্রিক-রোমান-পাশ্চাত্য-প্রাচ্যের যেসব স্মৃতিস্তম্ভ নানামুখী কৃষ্টি-সংস্কৃতির স্মারক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, সেসবের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে মহান স্থপতিদের জ্ঞান-মেধা-যুক্তি-প্রকৃতিনির্ভর অনন্যসুন্দর কারুকাজের কাব্যগাথায়। একজন সার্থক-সফল স্থপতির জীবনগাথার অপূর্ব পটভূমি হচ্ছে তার সৃষ্ট কর্মের গ্রহণযোগ্যতা। আধুনিক ধ্যানধারণার অধিকারী কর্মবীর নুরুল ইসলাম এরই ধারাবাহিকতায় হয়েছেন অত্যুজ্জ্বল।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অপরিসীম অবদান রাখা শিল্প-উদ্যোক্তাদের অন্যতম হচ্ছেন যমুনা শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার নুরুল ইসলাম। স্বাধীনতার পর টগবগে তরুণ নুরুল ইসলাম অসীম সাহসীকতায় যমুনা গ্রুপ নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যমুনা গ্রুপ আজ দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানরূপে পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নসহ সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার বেজুড়া গ্রামে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তুলেছেন যমুনা শিল্পনগরী। যোগ্যতা-দক্ষতা-অক্লান্ত পরিশ্রমের সমাহারে আপসহীন এই কর্মবীর এ পর্যন্ত একে একে ৪১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। দেশের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার অগ্রদূত জনাব নুরুল ইসলাম শিল্প সাম্রাজ্য স্থাপনে অনন্য দৃষ্টান্ত রচনা করেছেন। তার নেতৃত্বে যমুনা গ্রুপ দেশীয়-বৈশ্বিক বাজারে গুণগত-মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।

জনাব নুরুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ৩ মে ঢাকার নবাবগঞ্জের চুড়াইন ইউনিয়নের কামারখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আমজাদ হোসেন ও মাতা জোমিলা খাতুন। তার সহধর্মিণী যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম।

জনাব নুরুল ইসলাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। যৌবনে অস্ত্র হাতে ১৯৭১ সালে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনের প্রথম সারির এ যোদ্ধা। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শুরু করেন আরেক যুদ্ধ। সারাটা জীবন তিনি সমাজহিতৈষী-সংস্কারক হিসাবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিবেদন করেছেন। দেশে করোনা মহামারিকালে করোনা চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ ছিল আর্তমানবতার সেবার অনন্য নিদর্শন। করোনা মোকাবিলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও দিয়েছিলেন ১০ কোটি টাকা। তাছাড়াও নিজ প্রতিষ্ঠানে তৈরি করেছিলেন স্বল্পমূল্যের হ্যান্ড স্যানিটাইজার। ২০২০ সালের ১৩ জুলাই তিনি নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মাটির পৃথিবীকে চির বিদায় জানিয়ে ৭৪ বছর বয়সে শেষ গন্তব্যে পাড়ি জমান।

কোনো ধরনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও জনাব নুরুল ইসলাম তার নীতিনিষ্ঠার জন্য জেল-জুলুমসহ অসহনীয় মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সব ধরনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত কর্ম যথাযথভাবে পালন করে গেছেন। সব ধরনের অশুভ শক্তির হয়রানি, প্রতারণামূলক দূরভিসন্ধি মোকাবিলা করে জনাব নুরুল ইসলাম সৃজন-মনন-প্রগতিশীল চিন্তা চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে উদারনৈতিক-গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিমানস নির্মাণে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্যমান হয়েছেন।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক গুণগত পরিবর্তন, সব স্তরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং দেশসেবার অংশ হিসাবে জনাব নুরুল ইসলাম ২০০১ সালে যুগান্তর পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। গণমাধ্যম্যের গুণগত উৎকর্ষ, বস্তু-সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনা, সাহিত্য-শিল্পকলা, ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির সার্বিক বিষয়ে সমসাময়িক পদচারণায় আকর্ষণীয় আঙ্গিক ও কলেবরে ব্যাপৃত মাটি-মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, মানবিক-দেশপ্রেমিক নুরুল ইসলাম ভাইয়ের জীবনপ্রবাহের আড়ালে বহু বিস্ময়কর ঘটনা এখনো অনাবিষ্কৃত। ক্ষণজন্মা এ ব্যক্তিত্বের জীবন ও সমাজ দর্শন দেশের তরুণ প্রজন্মকে নতুন পথের সন্ধান দেবে-এটি আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘তুমি কি গিয়াছ ভুলে’ কবিতার কয়েকটি চরণ নিবেদন করে জনাব নুরুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি আবারও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি : ‘তুমি কি গিয়াছ ভুলে?/ তোমার চরণ-স্মরণ-চিহ্ন আজও মোর নদীকূলে/ মুছিল না প্রিয়, মুছিল না তার বুকে যে লিখিলে লেখা!/ মাঝে বহে স্রোত, দু’কূল জুড়িয়া চরণ-স্মরণ-রেখা।/ বন্যার ঢল, জোয়ার, উজান আসে যায় ফিরে ফিরে,/ ও চরণলেখা মুছিল না মোর বালুচরে নদী তীরে!/ ঊর্ধ্বে ধূসর সান্ধ্য আকাশে ক্ষীণ চন্দ্রের লেখা,/ নিম্নে আমার শূন্য বালুচরে তোমার চরণরেখা।’

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম