চেতনায় বুদ্বুদ
জামায়াতি-হেফাজতিরা কি কখনো আওয়ামী লীগের হতে পারে?
বদিউর রহমান
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত বছর-দশেকের মধ্যে বোধকরি বড় চমক হলো সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রকাশ্যে মিটিং করেছে। পত্রিকার খবর অনুসারে ধরে নেওয়া যায়, তাদের বরং জামাই আদরে সমাবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। অন্যদের সরিয়ে দিয়ে তাদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কমিশনারের মৌখিক অনুমতিতে হলেও সমাবেশ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে সরকারের কৌশল টের পাওয়া গেল। গত কয়েক বছর থেকেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথা ফাঁকে-ফুঁকে আমরা শুনেছি, কিন্তু আইনিভাবে আওয়ামী লীগ সরকার সেদিকে গরজ করেনি। রাজনীতিতে যখন নীতি থাকে না, তখন এমনই হয়, হতে হয়। কে কখন আপন হবে, কাকে কখন কাজে লাগবে, তা কি চটজলদি বলা যায়? যায় না, যেতেও হয় না-প্রয়োজনে সুতাটা একটু একটু করে ছেড়ে দিতে হয়, নাটাইটা হাতে থাকলেই তো হলো। যখন দরকার পড়বে মাঝেমধ্যে একটু নাটাইয়ে সুতা গুটানো হবে, সবক যা দেওয়ার তা দেওয়া হবে, ঘুড়ি বুঝবে-সে স্বাধীন নয়, ইচ্ছা করলেই নীলিমায় উড়তে পারবে না।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের ক’নেতার যে ফাঁসি হলো, তখন এ বিচারের পক্ষে জনসমর্থন চাঙা, বরং বলা চলে মহাচাঙা করার জন্য একটা মঞ্চ হলো না এক মন্ত্রীর মেয়ের জামাইখ্যাত এক ডাক্তারের নেতৃত্বে-সেটা আমাদের কি অত তাড়াতাড়ি ভুললে চলবে? সেই মঞ্চের তখন কত জামাই আদর। শাহবাগ তো তখন ওই মঞ্চের দখলে, হাজার হাজার লোকের সে কী সরগরম উত্তাল স্লোগান! শোনা যায়, সরকার তাদের খানাপিনার জবরদস্ত ব্যবস্থাও করে দিত। আমিও গেলাম কয়েকবার, পরে তো মিরপুর ১০ নম্বরেও মহাসমাবেশ, স্বাক্ষর সংগ্রহ। তখন কিন্তু রাস্তা বন্ধের অভিযোগ নেই, পুলিশই রাস্তা বন্ধ করে দেয়। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সমর্থনে হলে তা তো জাতীয় প্রয়োজনে, রাস্তা বন্ধ, সেটা তো অন্যায় নয়! এখন ওই ডাক্তার সাহেব কোথায়? ওই মঞ্চ কোথায়? স্লোগানকন্যা ওই মেয়েটি এখন কোথায়? কাদের মোল্লার বিচারের রায় একটু ভিন্ন হলে সে কী প্রতিবাদ! আমিও কলাম লিখলাম-হায়, হায়, এ কী রায়? পরে তো কাদের মোল্লা, নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান গং ফাঁসিতে বিদায় হলেন। সাকা চৌধুরী দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যান কিনা আমার ভয় ছিল, না দড়ি ছিঁড়েনি।
স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে নিয়মমাফিক শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে, তাদের ‘সাইজ’ করা হলো, রাজনৈতিক নিবন্ধন বাতিল হলো। কিন্তু দল নিষিদ্ধ হলো না আইনিভাবে। অতএব জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ থেকেই গেল, সেই যে জিয়া গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন, তা আর বন্ধ হলো না। রাজনীতিতে নীতি থাকতে নেই, আওয়ামী লীগেও নেই; নীতিটা আছে যখন যাকে প্রয়োজন ক্ষমতার থাকার জন্য তখন তাকে পুষতে হবে। অতএব জামায়াত আগেও আওয়ামী লীগের কাজে লেগেছে, এক রাষ্ট্রপতির ভোটে আওয়ামী লীগ গোলাম আযমের দোয়া প্রার্থী হয়েছে, এরশাদকে হটানোর জন্য আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনের আপসে গিয়েছে, এমনকি জামায়াতের সঙ্গে কী যেন একটি চুক্তিতে গেছে জলিলের আমলে। অতএব জামায়াত আওয়ামী লীগের শত্রু নয়, প্রয়োজনে মিত্রই বলা চলে। মিত্র দু’রকমের হয়-এক. সরাসরি ক্ষমতার ভাগ নিয়ে, যেমন এরশাদ ছিলেন; দুই. সরাসরি ক্ষমতায় দৃশ্যমান না হয়ে সভা-আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সহযোগী হয়ে। জামায়াত আওয়ামী লীগের মিত্র হয়েছে এ দ্বিতীয় প্রকারে।
জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক রয়েছে প্রচুর। মৌলবাদী এ দলের কর্মীসংখ্যা শুধু প্রচুর নয়, এরা শিক্ষিত এবং কঠোর নিয়মের অনুশীলনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তও। এদের প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলাবোধ, আমার মতে, কমিউনিস্টদের থেকেও মজবুত। বায়তুল মোকাররম যখন ঐতিহাসিক বায়তুল মোকাররম ছিল এবং সেখানে রাজনৈতিক সভা হতো, তখন জামায়াতের এক সভায় দেখলাম বায়তুল মোকাররমের পূর্ব গেটে (ক্রীড়া পরিষদের কাছে) মাগরিবের নামাজের সময়ে জামায়াতের কয়েক কর্মী কর্তব্যরত। তাদের একজনকে আমি চিনলাম, জিজ্ঞেস করলাম-নামাজের জামাতে গেলেন না যে? তার উত্তর, তার ডিউটি এখানে, অতএব জামাতে নামাজ আদায় করতে তার যাওয়া যাবে না, অন্য গ্রুপ নামাজ পড়ে এলে তিনি যাবেন। দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আল্লাহর নামাজও পরে পড়বেন-এটা কেমন হলো, জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিলেন-কাবার জামাতেও প্রহরীরা জামাতে নামাজ আদায় করেন না, অন্যদের নামাজ নিশ্চিত করতে তারা ডিউটি করেন। আমি তার জবাবে তাদের কঠোর শৃঙ্খলাবোধ টের পেলাম।
কয়েক বছর ধরে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে দোটানায় থাকলেও জামায়াত বিএনপির বন্ধু, আপনজন। বিএনপি সেনাছাউনির পয়দা, জামায়াত স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাবিরোধী হলেও জিয়ার দয়ায় রাজনীতিতে পুনর্বাসিত এবং খালেদা জিয়ার সরকারেও ছিল। বিএনপির একটা ভোটব্যাংক এ জামায়াত, আদর্শিক মিলের এক বন্ধু, রাস্তার শক্তি হিসাবে একে বড় প্রয়োজন। জামায়াত মরলে শহিদ, বাঁচলে গাজি-এমন আদর্শে রাস্তায় মারমুখী হতে পারে, বিএনপি তা পারে না। অতএব মাঠের রাজনীতি দখলে রাখতে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে বিএনপির জামায়াতকেই দরকার। জামায়াতও বোঝে, বিএনপি তাদের যত বিশ্বাস করে, আপন ভাবে, সম্মান করে, আওয়ামী লীগ বেকায়দায় পড়ে তাদের দ্বারস্থ হলেও বিএনপির মতো মূল্যায়ন করে না, করবেও না। অতএব জামায়াত কখনো আওয়ামী লীগের হবে না, ছিলও না। এখন সাময়িক বেকায়দায় পড়ে জামায়াত তাদের অস্তিত্বের জন্য যদিও আওয়ামী ঘেঁষার ভাব দেখাতে চাইবে, এটি কখনো বিশ্বাস করা যাবে না, বিশ্বাস করা ঠিকও হবে না। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই জানে যে, জামায়াতের লোকদের ফাঁসি দেওয়া আওয়ামী লীগ কখনো তাদের বন্ধু হতে পারে না। জামায়াতকে ‘সাইজ’ করার জন্য এক নেতাকে নারী-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আটক করে রাখলেও তা এখন রাজনৈতিক দরকষাকষিতে ইস্যু হবে। নতুন মার্কিন ভিসানীতিতে সরকারও দেখাতে চাইছে তারা রাজনৈতিক মাঠে কত উদার, কত সহনশীল, জামায়াতকে প্রকাশ্যে সমাবেশ করতে সরকার সুযোগ দেয়। এসব রাজনৈতিক কলাকৌশল মাত্র।
এখন জামায়াতের অস্তিত্বের প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ বিএনপিবিহীন রাজনীতির মাঠে অন্য কোনো শক্তিকে ভোটে আনার চেষ্টা করছে। হতে পারে, বিএনপির শূন্যস্থানেই আওয়ামী লীগ এখন জামায়াতকে ছাড় দিয়ে রাজনীতিতে এনে বিএনপিকে আরও অস্তিত্বহীন করে দিতে চাইতে পারে। এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ যেমন গত তিন মেয়াদে খেলেছে, এখন জিএম কাদের আর রওশনকে দ্বিমুখী রেখে খেলার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতকে লাইম লাইটে এনে সামনের ভোট উতরাতে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা আরেক খেলার ফ্রন্ট খুললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নৌকা ভাড়া নেওয়া বামরা তো তার রয়েছেই, নতুন কোনো শক্তিকে বাগে আনতে পারলে ভালোই হয়। আবার ক্ষমতায় এসে গেলে তখন দেখা যাবে, কাকে মুলা কতটুকু দেবে, আর কাকে কতটুকু কোল দেখাবে। একটু স্বাধীনচেতা, একসময়ের সহযোগী জিএম কাদেরকে আওয়ামী লীগ হয়তো আর পুরো আস্থায় নিতে পারছে না। তাই দেবর-ভাবির বৈরিতা উসকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও রাজনীতির মাঠে একটু সাইজ করে দেওয়ার জন্য জামায়াত আওয়ামী লীগের নতুন মিত্র হতে পারে আবার।
রাজনীতিতে কৌশল বড় গুরুত্বপূর্ণ, ম্যাকিয়াভেলি হলেও ক্ষতির কিছু নেই। আমাদের কি মনে নেই শাপলা চত্বরে হেফাজত কী কাণ্ডই না করল! ঢাকা দখলের সে কী চেষ্টা! খালেদা জিয়াও তো তাদের সমর্থন দিলেন, ঢাকাবাসীকে তাদের খাবার দিতেও বললেন। মঞ্চে গিয়ে এরশাদসহ আরও কতজন সমর্থন দিলেন। হাসিনা সরকারকে যেন ওই সময়ে ফেলেই দেয়। বিডিআর বিদ্রোহ দমনের মতো হেফাজতিদের সুন্দরভাবে ‘সাইজ’ করে দিলেন শেখ হাসিনা। বিডিআর বিদ্রোহে অনেকের আশঙ্কা ছিল মইন ইউ আহমেদ হয়তো ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার হত্যার অসিলায় ক্ষমতা দখল করে ফেলবেন, আবাহনী মাঠে তো সেনা জমায়াত হয়েও গিয়েছিল বিডিআর ঠেকাতে, মুন্নী সাহাদের সে কী লাইভ টেলিকাস্ট! কিন্তু মাত্র ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা মইন ইউদের তার সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব পাশের গণভবনে বসিয়ে রেখে কী দক্ষতার সঙ্গে তা সামাল দিলেন। একইভাবে হেফাজতিদের মতিঝিল ছাড়তে বাধ্য করলেন, এক্সিটের পথও খোলা রেখে দিলেন। সেই শেখ হাসিনাই আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতের আমিরের পাশে বসে তাদের মহাসম্মেলনে ‘কওমি জননী’ খেতাবে ভূষিত হলেন। হেফাজতিরাও তখন একটু স্পেস চেয়েছে, কওমি মাদ্রাসার সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়েছে, মতিঝিল কাণ্ডের বাইরে এসে সরকারের ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগও হেফাজতিদের দেশব্যাপী বিস্তৃত কওমি মাদ্রাসার শক্তিকে নিজের পক্ষে চেয়েছে। হেফাজতিরা ভোট না করুন, কিন্তু তারাও একটি শক্তি। অতএব ‘কওমি জননী’ তাদের সমর্থনের জন্য, শাপলা চত্বরে পিটুনি দিলেও এখন তাদের বুকে টেনে নিতে চেয়েছেন।
কেউই রাজনীতিতে চিরশত্রু বা চিরমিত্র নয়, অতএব জামায়াতকে বাগে রাখা যেমন কৌশল, হেফাজতকে গুড হিউমারে রাখাও রাজনৈতিক কৌশল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চার্চিল আসলে একবারও আমেরিকায় নামেননি, কিন্তু তার বিমান বারবার আমেরিকার আকাশে গিয়েছে। এতেই হিটলার টের পেয়েছেন তার শত্রুপক্ষ কীভাবে এক হচ্ছে। শুনেছি, তখন একদিনেই চার্চিলের সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের শত্রুরা জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী আঁতাতে হয়তো ভয় পাবে, কিন্তু জামায়াতি-হেফাজতিরা কি কখনো আওয়ামী লীগের হবে? আওয়ামী লীগ সাবধান!
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান