বাইফোকাল লেন্স
শিল্প প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে
একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারের সাম্প্রতিক দেওয়া একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তিনি ১১ মে অর্থনৈতিক সাংবাদিক সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম বা ইআরএফ ও এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ বাজারের যে অবস্থা, তার পকেটে সে টাকা নেই। আমরা যখন বাজারে যাই, তখন দেখি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কেন ঊর্ধ্বগতি? আমাদের কিন্তু কোনো কিছুর অভাব নেই, আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও সিন্ডিকেটের কারণে দেশে এ অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থনীতি ও বাজার এ দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ‘তিনি যোগ করেন, যে ব্যক্তি লুটপাট করে বড়লোক হচ্ছেন, তাকে আরও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে কিছু ব্যক্তির কাছে ব্যাংক থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ সিন্ডিকেট আমাদের ভাঙতে হবে। এ বক্তব্য দেওয়া ছাড়াও ঢাকার জনপ্রিয় পত্রিকা যুগান্তরে একটি সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে। যারা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকেই এখন মন্ত্রী।’ শিল্প প্রতিমন্ত্রী অবশ্য মন্ত্রিপরিষদের কোন কোন মন্ত্রী সিন্ডিকেটে আছেন তাদের নাম বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘খামোখা নামটাম জিজ্ঞেস করে আমাকে ভেজালে ফেলবেন।’ প্রতিমন্ত্রীর সরল ও সহজ ভাষার এ বক্তব্য নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। আজ (১৯ মে) খবরের কাগজের মারফত জেনেছি, সরকারের মন্ত্রীরা নাকি বিব্রতবোধ করছেন। ওদিকে আওয়ামী লীগের নেতারাও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে অর্থনীতি ও বাজার পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার পেছনে পরিচিত কিছু সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে। এসব সিন্ডিকেটে মুখচেনা কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি যে জড়িত, দেশের মানুষ তাও বিশ্বাস করে। সময়ে সময়ে এসব ব্যক্তি সম্পর্কে খবরের কাগজে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী শুধু আপেক্ষিক সত্য নয়, বাস্তব সত্য কথাগুলো সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। মানুষের মনের কথাই যেন বলেছেন। সরকারের ভেতর এমন আরও অনেকেই আছেন যারা এসব অপকর্ম সহ্য করতে না পারলেও মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না শুধু পদ ও পদবি হারানোর ভয়ে। আওয়ামী লীগের ভেতরও অনেকেই এসব সহ্য করে যাচ্ছেন। তারা মুখ খুলছেন না দলের বদনাম হবে বলে। এসব চিহ্নিত ব্যক্তির বিভিন্ন অপকর্মের খবর যে সরকারের উঁচু মহলের জানা নেই তা নয়। যুগান্তরের এক প্রশ্নের জবাবে কামাল মজুমদার বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে নেত্রীকে বলেছি। তিনি অনেকের ওপর অ্যানোয়েড।’ এ দেশের মানুষ আরও বিশ্বাস করে, এখনো যারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করেন তাদের অনেকেই এসব নিয়ে মুখ খুলে দলের ভেতর কোণঠাসা হয়ে আছেন। বর্তমানের নীতিনির্ধারকরা তা স্বীকার করুক না করুক; এটাই বাস্তবতা।
কামাল মজুমদারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের নেতারা যা বলছেন তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্ন তো রয়েই গেছে। শিল্প প্রতিমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর ১৩ মে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সমাবেশে কামাল মজুমদারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘নিজে মন্ত্রী, সিন্ডিকেট নিজে থামান। এগুলো বললে নিজের গায়ে আসে।’ এ দেশের মানুষ মনে করেন, কামাল মজুমদার তার বক্তব্যের মাধ্যমে সিন্ডিকেটে যেসব ব্যক্তির জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন, ওবায়দুল কাদেরও জানেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া কামাল মজুমদারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেছেন, কামাল মজুমদার সরকারের অংশ। তিনি দলেও আছেন। তার এ ধরনের কথা বলা উচিত হয়নি। এসব নিয়ে তো ‘মানুষের মধ্যে খারাপ ধারণা’ হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, একদল মুখচেনা মুনাফাখোর, ক্ষমতাসীনদের চোখের সামনেই প্রতিনিয়ত মানুষের পেটে লাথি মেড়ে চলেছে, অথচ রাষ্ট্রের সব মেশিনারিজ সরকারের হাতে থাকতেও কিছুতেই কিছু করতে পারছে না, তখন জনগণের ভেতর খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয় না? দোষ হয় কেবল কেউ সত্যকে চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে! যারা সত্যকে উপলব্ধি করতে চান না এবং সত্য প্রকাশে বিব্রত ও বিরক্তবোধ করেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, যথোপযুক্ত যুক্তির মাধ্যমে তারা যেন কামাল মজুমদারের উত্থাপিত বক্তব্যকে খণ্ডন করে মানুষের সামনে তা মিথ্যা প্রমাণ করেন। তা হলেই মানুষের মধ্যে আর খারাপ ধারণার সৃষ্টি হবে না।
মন্ত্রণালয়ের আমলাদের নিয়েও শিল্প প্রতিমন্ত্রীর অনেক পর্যবেক্ষণ আছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও আছে তার। যুগান্তরে সাক্ষাৎকার দেওয়াকালে তিনি বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের অধীন সব সংস্থায় চেয়ারম্যান অথবা ডিজি হেড হিসাবে কর্মরত আছেন। তারা প্রতিমন্ত্রীর কথা না শুনলেও কিছু করার নেই। সব ক্ষমতা চেয়ারম্যানদের। প্রতিমন্ত্রী হিসাবে তার কোনো পাওয়ার নেই। মন্ত্রণালয়ের ‘অল ইন অল’ সচিব ও মন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রী মাঝখানে বসে আছেন এমনিতেই। তিনি যোগ করেন, ‘তারপরও সত্যটা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু বলতে গেলেই থামিয়ে দেওয়া হয়।’
সত্য কথা বলে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবারই প্রথম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। তিনি ২০২১ সালের ডিসেম্বরেও কোনো রাখঢাক না রেখে নির্মোহ সত্য বক্তব্য দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশ ইস্পাত প্রকৌশলী করপোরেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে আমলারা।’ তখন তিনি নেত্রীর প্রশংসা করে বলেছিলেন, দেশের অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। এ সাফল্য আরও উদ্ভাসিত হতো যদি দুর্নীতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা যেত। দুর্নীতির কারণেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য যথাসময়ে হাতে ধরা দেয় না। একটি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হলেও সচিবের ভূমিকা কিন্তু কম নয়। মন্ত্রীর কোনো সিদ্ধান্ত যদি জনগণের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হয়, তখন সচিব মন্ত্রীকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন। আবার সচিবের কাজের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে মন্ত্রী তা সুধরে দেন। অর্থাৎ এভাবেই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স রক্ষা করে একটি মন্ত্রণালয় পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্নীতির ক্ষেত্রে সচিব ও মন্ত্রী উভয়ে যদি আপস করে ফেলেন, তাহলে দুর্নীতি দমন করবে কে?
আমলাদের দুর্নীতি নিয়েও প্রচুর লেখালেখি ও সমালোচনা আছে। এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমলাদের দুর্নীতি ভয়াবহ। তাদের দুর্নীতি জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তবে এ কথা ঠিক, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়সংকল্পের অভাব আমলাদের দুর্নীতির জন্য বহুলাংশে দায়ী। মন্ত্রীরা সাময়িক কিন্তু আমলারা স্থায়ী। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সরকারের ক্ষমতা যেন আমলাদের কাছে আটকানো আছে। ক্ষমতাসীনদের এখানেই দুর্বলতা। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ক্ষমতাই দুর্নীতির উৎস। কাজেই ক্ষমতার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে দুর্নীতি হবে কি হবে না। তবে সব রাজনীতিবিদ যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তেমনই সব সরকারি আমলাও দুর্নীতিগ্রস্ত নন।
দেশের আর্থিক খাতে যে অরাজকতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে আজ যে লুটপাট হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থাই যেন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এ নিয়ে মানুষের ভেতর অনেক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে মনে করেন, আর্থিক দুর্নীতি দমনে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে অথবা দুর্নীতি দমনে যেসব সংস্থা সরকারের হয়ে কাজ করছে সেসব সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ কেউ নিজেরাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। আবার অনেকের ধারণা, সরকারের সিস্টেমেই গলদ রয়ে গেছে। বিশেষ করে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ও ঋণ মওকুফের ব্যাপারে। শিল্প প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়েও যথার্থই বলেছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ মওকুফ করা হয় না। কাদের ঋণ মওকুফ করা হচ্ছে? যারা ব্যাংক থেকে লক্ষকোটি টাকা নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, তাদেরটাই বারবার মওকুফ করা হচ্ছে। তারা মওকুফ পেয়ে আবার ঋণ নিচ্ছেন এবং যথারীতি ঋণখেলাপি হচ্ছেন।
দেশে যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠার জন্যই সরকার আইএমএফ-এর কাছে হাত পেতেছে। আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য যে শর্ত দিয়েছে তা হলো, রাষ্ট্রমালিকাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আছে ৫৬ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকের ৫৮ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম সোনালী ব্যাংকের ১৫ শতাংশ। এই ছয় ব্যাংকের গড় খেলাপি হার ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ। অথচ সাধারণ মানুষের অর্থ ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে যারা খেলাপি হয়েছে, তারা আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। এই বড় ঋণখেলাপিরা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় আজও বহাল তবিয়তেই আছেন।
দেশে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট কারা করছে তাদের পরিচয় জানা থাকলেও মুখ ফুটে কেউ বলার সাহস করেন না। শিল্প প্রতিমন্ত্রীও সেই দুষ্টচক্রের পরিচয় প্রকাশ করার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারেননি। কারণ তাদের পেশিশক্তির কাছে তিনি দুর্বল। মৃত্যুর ভয় তারও আছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি তা প্রকাশও করেছেন। একজন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার ব্যক্তির যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে অন্যদের কথা বাদই দিলাম। তবে এ কথা ঠিক, প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারের কথার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ের বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে। এতদিন যা মানুষের মুখে মুখে ছিল, তা এখন সরকারের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসছে। যে কথা মানুষ প্রকাশ্যে বলতে পারেনি, তাই যেন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তবে তার এ ধরনের বক্তব্যের পর অনেকেই বলছেন, প্রতিমন্ত্রী এসব কথা সংসদে দাঁড়িয়ে বললেই পারেন। তারপরও যদি প্রতিকার না হয়, তাহলে সবার সামনে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করলেই পারেন।
ভালো হয়, সরকার যদি প্রতিমন্ত্রীর উত্থাপিত বিষয়বস্তুগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখে। মানুষ সরকারের কাছে তাই আশা করে। এই মেয়াদে সরকারের হাতে এক বছরের মতো সময়ও নেই। তারপরেই নির্বাচন। সিন্ডিকেট বানিয়ে যে কুচক্রীমহল সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, যে কদিন সময় হাতে আছে, সেসময়ের মধ্যে সরকার কি সত্যিই আন্তরিকভাবে এসব চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে? সাধারণ মানুষের ভেতর হতাশাও আছে। তাদের মনে প্রশ্ন, যা এতদিন হয়নি, তা এখন কি হওয়া সম্ভব?
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, কলাম লেখক