শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশাগত নৈতিকতা : শিক্ষকের ভূমিকা
ড. মো. মাহমুদুল হাছান
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পেশাগত নৈতিকতা হলো এমন কিছু নীতি, যা একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্ব স্ব পরিবেশ বা কর্মক্ষেত্রে অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। এটি বিভিন্ন পেশার জন্য আলাদা দায়িত্ব ও কর্মপরিধির ওপর ভিত্তি করে নির্ণীত হয়ে থাকে।
তবে নৈতিকতার মানদণ্ডে মৌলিক কিছু নীতিমালা থাকে, যেগুলো সব পেশাতেই সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। সময়মতো কর্মস্থলে হাজির হওয়া, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক কাজ সম্পন্ন করা, সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, কোম্পানি বা সংস্থার প্রতি আনুগত্য পোষণ করা, সেবাগ্রহীতাদের প্রতি কমিটমেন্ট ঠিক রাখা, কাজেকর্মে ফাঁকিবাজি না করা ইত্যাদি।
পেশাগত নৈতিকতার মূল বিষয়গুলো সব প্রতিষ্ঠানে একই পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হয়। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেহেতু মানুষ গড়ার আদর্শ কারখানা, সেখানে শিক্ষকদের পেশাগত নৈতিকতা অবলম্বন অন্য পেশা থেকে একটু ভিন্ন ও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশাগত নৈতিকতার ব্যাপ্তি অন্য পেশা থেকে একটু ব্যতিক্রম হওয়ায় এখানে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেলায় শুধু লিখিত নীতিমালাই নৈতিকতা অবলম্বনের মানদণ্ড নয়, এর বাইরেও অবস্থা ও পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে তাদের নৈতিক ভূমিকা পালন করতে হয়।
পেশাগত নৈতিকতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যে ন্যায্যতা, সমতা, পক্ষপাতহীনতা এবং একটি সহযোগী মানসিকতা তৈরি করে। যে প্রতিষ্ঠানে সব লোকের সঙ্গে সমানভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে আচরণ করা হয়, সেখানে নৈতিক মান বজায় রাখা নিশ্চিতভাবেই সম্ভব এবং সে প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধির পাশাপাশি একজন শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্যও এটি একটি শক্তি হিসাবে কাজ করে।
উত্তম নৈতিকতা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুন্দর ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং শিক্ষক-কর্মকর্তাদের এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে, যা তাদের পেশাকে এবং সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানকে অসম্মানিত করে। তাই নৈতিকতার আনুগত্য হলো বিবেককে সর্বদা নেতৃত্ব দেওয়া।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশাগত নৈতিকতা শিক্ষকদের এমনভাবে অনুসরণ করতে হবে, ঠিক যেমনভাবে একটি ব্র্যান্ড বা উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এমন বিশেষ কিছু মান বজায় রাখতে হবে, যা একটি নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার পরিবেশের প্রচারে সহায়ক। শিক্ষকতা পেশায় নৈতিকতার বিষয়টি মোট পাঁচটি মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট :
১. শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া : প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান, তখন কয়েকটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে : যেমন-ক. শিক্ষকদের তাদের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মর্যাদা ও অধিকারকে সম্মান করতে হবে; খ. শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, রাজনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক মর্যাদা এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে ন্যায়সংগত ও নিরপেক্ষভাবে আচরণ করা; গ. শিক্ষকদের অবশ্যই তাদের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগ্যতা ও দক্ষতার পার্থক্য শনাক্ত করতে এবং চিনতে সক্ষম হতে হবে;
ঘ. শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত চাহিদা মেটাতে শিক্ষকদের সাধ্যমতো সর্বোত্তম চেষ্টা করতে হবে; ঙ. শিক্ষকরা পক্ষপাতহীনভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণ করবেন, যেন তা তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের একটি অন্যতম উপায় হিসাবে অনুমিত হয় এবং একইসঙ্গে তাদের কর্মতৎপরতা যেন সমাজ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখে; চ. শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা, অনুসন্ধিৎসু চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, পরিবেশ সুরক্ষা, দেশপ্রেম ও শান্তির আদর্শ জাগ্রত করতে হবে; ছ. তাদের অবশ্যই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই তাদের সঙ্গে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা যাবে না;
জ. ক্লাসের সময়ের বাইরেও শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকরা যেন নিজেদের উপলব্ধি করতে পারে এবং কোনো অতিরিক্ত পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদের সাহায্য ও গাইড করতে প্রস্তুত থাকে; ঝ. শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও জাতীয় লক্ষ্য সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি গড়ে তুলতে সাহায্য করা; ঞ. কোনোভাবেই একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে, অন্য শিক্ষক বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে উসকানি দেবেন না; ট. সাইবার বুলিং ও র্যাগিং করার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে।
২. শিক্ষক সহকর্মীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পেশাদারত্বে সহকর্মী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াকালে যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে তা হলো-ক. সব শিক্ষক অন্য অনুষদ বা বিভাগের শিক্ষক-সহকর্মী সদস্যদের সঙ্গে সমান আচরণ করবেন, যেমনটা তারা নিজেদের সঙ্গে করেন; খ. নিজেরা যেমন পেশাগত নৈতিকতা অবলম্বন করে চলবেন, অন্যদের সেভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবেন; গ. তারা অবশ্যই সহকর্মীদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করবেন না।
বরং তাদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সংশোধন করতে চেষ্টা করবেন; ঘ. সব সহকর্মী শিক্ষককে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, কর্মক্ষেত্রে তাদের পেশাগত প্রচেষ্টায় জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, জাতীয়তা, বর্ণ বা লিঙ্গের কারণে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই; ঙ. সাইবার সিকিউরিটির ব্যাপারে সবাইকে সম্যক জ্ঞান প্রদান করে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
৩. অশিক্ষক সহকর্মীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু শিক্ষকই থাকেন না, যারা অ-শিক্ষক সহকর্মী, তাদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ; তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সময় কয়েকটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল করতে হবে; যেমন-ক. শিক্ষক কর্মীদের অ-শিক্ষক কর্মীদের সঙ্গে অবশ্যই সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করতে হবে, যেমনটা তারা তাদের সহকর্মীদের সঙ্গে করে থাকেন;
খ. শিক্ষকরা কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিবিভাজন সৃষ্টি করবেন না। প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মচারী তার স্বপদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরা তাদের সমান চোখে দেখবেন এবং সহমর্মিতার আচরণ করবেন; গ. প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে তাদের সবাইকে সমঅধিকারের ভিত্তিতে দলীয়ভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে;
ঘ. প্রতিষ্ঠানের যৌথ-কাউন্সিল অধিবেশনের সাধারণ কার্যাবলিতে তাদের যোগদানে সহায়তা করতে হবে, যাতে শিক্ষক ও অ-শিক্ষক উভয় কর্মী জড়িত থেকে একে অন্যের মতামত শেয়ার করতে পারেন।
৪. প্রশাসনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যেসব বিধিনিষেধ রয়েছে এবং সেগুলোর সফল তদারকিতে যে প্রশাসন রয়েছে, তাদের সঙ্গে শিক্ষকদের মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে : ক. শিক্ষকরা অবশ্যই স্বীয় বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে কাজ করবেন এবং বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন;
খ. স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে; গ. শিক্ষকদের সব অবস্থাতেই প্রাইভেট টিউশন, কোচিং ক্লাস ইত্যাদিসহ তাদের পেশাগত দায়িত্বে প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে পারে এমন কর্মসংস্থান ও প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে; ঘ. তারা অবশ্যই তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নীতি প্রণয়নে ও তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবেন; ঙ. পেশার মর্যাদাকে সামনে রেখে তাদের প্রতিষ্ঠানের উন্নত ও অগ্রগতিতে আগ্রহ দেখাতে হবে;
চ. তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের সময় যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেগুলোসহ কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক প্রণীত সব নিয়ম-কানুন তাদের অবশ্যই কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে; ছ. চাকরি পরিবর্তনের ইচ্ছা থাকলে তাদের যথাযথ নোটিশ (চুক্তির নথিতে নির্ধারিত) প্রদান করতে হবে; জ. যদি একান্ত অনিবার্য না হয়, তাহলে পারতপক্ষে ছুটি চাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
৫. অভিভাবকদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সঙ্গে ইন্টার্যাকশন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কয়েকটি বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে : ক. অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের সচেতনতাপূর্ণ আচরণ করতে হবে এবং তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে; খ. শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও নৈতিক আচরণের উন্নতিকল্পে অভিভাবকদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে হবে;
গ. শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে কোনো নালিশ বা অভিযোগ থাকলে তা তাদের অভিভাবকদের যৌক্তিকভাবে অবহিত করতে হবে; ঘ. মাঝেমধ্যে শিক্ষক-অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করে শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন এবং শিক্ষার উন্নয়নে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করবেন; চ. অভিভাবকদের যে কোনো প্রশ্ন বা উন্নয়নমূলক পরামর্শ থাকলে তা মনোযোগ সহকারে শুনে শিক্ষকরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করবেন।
মোটকথা, পেশাগত নৈতিকতা পালন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও মনমানসিকতার ব্যাপার। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পেশাগত নৈতিকতার উন্নয়ন সম্ভব নয়, প্রয়োজন কর্মক্ষেত্রে আন্তরিকতা, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা ও সততার মাধ্যমে কর্মসম্পাদন। ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকুক বা না থাকুক, নিজ নিজ দায়িত্বের কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করে যথাযথ প্রতিবেদন দাখিল করাই পেশাগত নৈতিকতা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল কর্মস্থলে উপস্থিত আছেন কী নেই, এর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষক যদি তার কর্তব্যে অবহেলা করেন, তাহলে সেটি পেশাগত নৈতিকতা নয়; বরং তা পেশাগত অনৈতিকতা ও প্রহসন।
সুতরাং, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষকের পেশাগত নৈতিকতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থী, সহকর্মী, প্রশাসন ও অভিভাবকদের সঙ্গে একটি সুষম সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করার মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত নৈতিকতার মূল্যায়ন করা হয়।
কাজেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবার সঙ্গে শিক্ষকদের মিথস্ক্রিয়া এমন হতে হবে, যেন তারা পেশাগত নৈতিকতার আদর্শ উদাহরণ এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনের নিখুঁত রোল মডেল হতে পারেন।
ড. মো. মাহমুদুল হাছান : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক