মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান চিরস্মরণীয়
মাহবুবউল আলম হানিফ
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। এ দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়।
এ দেশ, এ দেশের মানুষ হাজার বছর ধরে বিদেশি হানাদারদের কবলে পড়েছে। অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছিল। কিন্তু তারা মাথা নোয়ায়নি। শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, লড়াই করেছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়ে ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের পর ’৬৬-তে ৬ দফার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতির মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি। এরপর ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। যার ফলে ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনেই বাঙালি স্বাধীনতার পক্ষে তাদের আকাক্সক্ষাটি জানিয়ে দেয়। তারপর তারা পথে নেমে আসে। স্লোগান তোলে : ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। জনতার মনের আকাক্সক্ষাটি বহু আগে থেকেই জানতেন জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরপরই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার সহচর সর্বাত্মক জনযুদ্ধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের এক অধ্যাদেশে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এ সরকার শপথগ্রহণ করে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দায় শোধ হয়েছিল মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে। সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষের সম্প্রীতির বন্ধনে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, এই দিনে তা সত্যিকার অর্থে বাস্তবে রূপ নিল সরকার গঠনের মাধ্যমে।
বিশ্বমানচিত্রে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক ধাপ পেরিয়েছিল বাংলাদেশ।
সেদিন ছিল শনিবার। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালির উপচে পড়া ভিড় চারদিকে। ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথমঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬টি চেয়ার। অনুষ্ঠানের প্রবেশপথে বাংলায় লেখা ‘স্বাগতম’।
স্থানীয় সময় বেলা ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথমঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তার পেছনে তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, বিশ্বাসঘাতক খুনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জেনারেল এমএজি ওসমানী।
যে কোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিমান হামলার আশঙ্কার মুখে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের স্থায়িত্ব হয় মাত্র ৪৫ মিনিট। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত এবং গীতা, বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী এবং হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। শপথগ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কায়দায় ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের।
শপথ গ্রহণের পরপরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যা করছি সবই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে।’ এ অনুষ্ঠান থেকে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।
বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণার কেন্দ্রে ধারণ করে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক মুজিবনগর সরকার দেশপ্রেমিক মুক্তিপাগল জনতাকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধকে একটি সফল জনযুদ্ধে পরিণত করে। আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ে তারা অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ফলে নয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এই ঐতিহাসিক দিনে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতাকে।
মাহবুবউল আলম হানিফ : যুগ্মসাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ