Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্বদেশ ভাবনা

আলোচনার মধ্যেই সমাধান খুঁজে পেতে হবে

Icon

আবদুল লতিফ মণ্ডল

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আলোচনার মধ্যেই সমাধান খুঁজে পেতে হবে

জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীর ভাষণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে সবাইকে সহায়তা করা উচিত।

গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয়, তা কখনো সর্বজনীন হতে পারে না। সে উন্নয়ন হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক।’ ৭ এপ্রিল প্রদত্ত এ ভাষণটি ছিল জাতীয় সংসদে তার শেষ ভাষণ।

টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে চলতি মাসের শেষদিকে তার বঙ্গভবন ছাড়ার কথা রয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির ভাষণকে ইতিবাচক হিসাবে দেখলেও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে তা রাজনৈতিকভাবে কোনো গুরুত্ব পায়নি। বিএনপির বক্তব্য-সংঘাত এড়াতে হলে সরকারকে আগে পদত্যাগ করে আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। এর একদিন আগে অর্থাৎ ৬ এপ্রিল সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ইভিএম বা ব্যালট পেপারে করা মোটেই বড় চ্যালেঞ্জ নয়। প্রধান দলগুলো আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কী করবে না সেটাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বড় দলগুলো অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচনের লিগ্যালিটি নিয়ে কোনো সংকট হবে না, তবে ল্যাজিটিম্যাসি শূন্যের কোঠায় চলে যেতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সংকটের সমাধান করে ভোটের পরিবেশ তৈরি করে দিক-এমন প্রত্যাশা সিইসির। আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছে রাজনৈতিক দলগুলো আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে সহায়তা করুক-এটি যেমন রাষ্ট্রপতির আবেগপূর্ণ বিদায়ি প্রত্যাশা, তেমনি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বর্জিত নির্বাচনের ‘লিগ্যালিটি’ ও ‘ল্যাজিটিম্যাসি’ নিয়ে সিইসির বক্তব্য বাস্তবতায় পরিপূর্ণ।

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল যখন শুধু নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনড় এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর, তখন আলোচনার টেবিলে ঐকমত্যে পৌঁছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা কতটুকু? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগে আজকের এ বিপরীতমুখী অবস্থানের পটভূমি জানা দরকার। ১৯৯৪ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং অন্য দুটি বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর দুর্বার আন্দোলন এবং সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবসানে মধ্যস্থতা করতে অক্টোবরে ঢাকায় আসা কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান মার্টিন স্টিফেনের মিশনের ব্যর্থতার পর তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি সংবিধান সংশোধনের (ত্রয়োদশ সংশোধন) মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের মার্চে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এ ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬ সালে (জুন) সপ্তম, ২০০১ সালে (অক্টোবর) অষ্টম এবং ২০০৮ সালে (ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও নবম নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের (পঞ্চদশ সংশোধন) মাধ্যমে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ৮টি সমমনা দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে আওয়ামী লীগ এবং গুটিকয়েক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের বেশিরভাগ আসনে অর্থাৎ ১৫৪টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন। এতে দেশে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গণতন্ত্রকামী বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে নির্বাচন-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি তার সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আওয়ামী লীগের এমন আশ্বাসে বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও সে নির্বাচন মোটেই অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। এ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল-নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত দিনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান। এ নির্বাচন দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়ে আসছে। মার্চে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘দ্য ২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কারণ হিসাবে তারা উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে জালভোট দেওয়া হয়েছে এবং বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়ম হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। এ নির্বাচনে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি কোনো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে দলটি ১০টি দাবি উত্থাপন করে। এর মধ্যে প্রধান দুটি দাবির একটি হলো সরকারের পদত্যাগ, আর অন্যটি দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ২৭ দফাসংবলিত ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের’ রূপরেখা ঘোষণা করে। ২৭ দফা রূপরেখার অন্যতম হলো নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন। ঘোষিত ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সদ্য বিলুপ্ত ২০ দলীয় জোটের ১১ দলসহ প্রায় তিন ডজন সরকারবিরোধী দল ও জোট।

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শুধু দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় নয়, তারা দলের বলয় বাড়াতেও সচেষ্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির সমর্থক বা বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। তবে এটা বহুল প্রচলিত যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ‘সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে সবাইকে সহায়তা করা উচিত’-রাষ্ট্রপতির বিদায়ি ভাষণে এমন প্রত্যাশা সরকারি দলে মনোভাবের কিছুটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় মনে করা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কারণ, এ ভাষণটি সরকারের লিখে দেওয়া।

অন্যদিকে পদত্যাগ করলে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই। তবে আলোচনার আগেই বিএনপির সরকারের পদত্যাগ দাবি করার পক্ষে জোরালো যুক্তির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ, সরকারি দল বা জোট এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ফলস্বরূপ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে সেটির বাস্তবায়ন সরকারকেই করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে সংবিধান সংশোধনসহ আরও কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ। এক্ষেত্রে আমরা বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে বিএনপি সরকারকে সংবিধান সংশোধন করার জন্য জাতীয় সংসদে বিল আনতে হয়েছিল, যা অনুমোদনের পর সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ নামে পরিচিতি পায়। এ আইন পাশের পর বিএনপি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়। তাই এ মুহূর্তে প্রথমে প্রয়োজন সরকারি দল, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের আলোচনার টেবিলে বসা। বৈঠকে করণীয় সম্পর্কে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হলে সে মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ। বৈঠকে বসেই আলোচনার বিষয়বস্তু, পদ্ধতি ইত্যাদি নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয় হবে। বৈঠকের আগে ‘এজেন্ডা’ নির্ধারণ করতে গেলে বৈঠক অনুষ্ঠানেই বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের উপরে উঠে সরকারি দল ও বিরোধী দলগুলোকে জাতীয় স্বার্থ হাসিলে কাজ করতে হবে। দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিকড় গভীরে প্রথিত হোক, নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক, মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত হোক, টেকসই উন্নয়নের বদৌলতে দেশ এগিয়ে যাক-এসবই জনগণের প্রত্যাশা। জনগণ আশা করে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এ প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম