পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বয়ানে জানা যায় অনেক কিছু
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিদ্দিক সালিক নামের একজন পাঞ্জাবি ঢাকায় আসেন ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে; তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর জনসংযোগ অফিসার। ঢাকায় পা দিয়েই শোনেন তাকে বহনকারী ড্রাইভারটি স্থানীয় লোকজনদের ডাকছে বেজন্মা (বাস্টার্ড) বলে।
তারপরে ওই ধ্বনি তাকে আরও শুনতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে সর্বাধিনায়ক ইয়াহিয়া খানের মুখেও; নিজের লোকদের শুনিয়ে শুনিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি বাস্টার্ড বলেছেন, ঠিক সেই সময়ে যখন তিনি পাকিস্তানের ওই সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপরত ছিলেন। ব্ল্যাক বাস্টার্ডদের যে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না, সে বিষয়েও তিনি তার সঙ্গীদের আশ্বস্ত করতেন, সালিক স্বকর্ণে শুনেছেন।
সেনাবাহিনীতে আনুগত্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। আনুগত্যের শৃঙ্খল ভাঙাটা আচরণগতভাবে তো অবশ্যই, মানসিকভাবেও কঠিন। এ ব্যাপারটায় একাত্তরে মুজিবনগরে চলে যাওয়া ফারুক আজিজ খানের অভিজ্ঞতা সত্য উন্মোচক।
তার কর্মস্থল ছিল কাপ্তাইয়ে, সেখানে ইপিআর’র একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল, ক্যাম্পে বাঙালি সেনা ছিল ১১০ জন, অবাঙালি ১৭-১৮ জন; কমান্ডিং অফিসারটি পাঞ্জাবি। ২৫ মার্চের পরে বাঙালি সেনারা স্থানীয় সংগ্রাম কমিটিকে জানিয়েছিল যে, তারা বিদ্রোহ করতে সম্মত, তবে কমান্ডিং অফিসার যদি কোনো হুকুম দেন, তবে সেটি অমান্য করতে পারবেন না। তাই কমান্ডিং অফিসারকে আগে সরাতে হবে, তারপর অন্য কথা। তাদের জন্য হুকুম মান্য করাটা সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছিল।
তবে এর মধ্যেও বিদ্রোহের চিন্তা ছিল, আগরতলা মামলার পেছনের ঘটনাটা মোটেই মিথ্যা ছিল না। নীরবে বাহিনী ত্যাগের ঘটনা ঘটেছে, সেনা ছাউনিতে সমষ্টিগত বিদ্রোহও হয়েছে, এমনকি ভীষণ বিপদ মাথায় নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেও কেউ কেউ যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন।
এদের মধ্যে আবু তাহের, এমএ মঞ্জুর ও জিয়াউদ্দিন ছিলেন। কামাল সিদ্দিকী লিখেছেন, ইংল্যান্ডে তার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, কথা প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘মঞ্জুর ও জিয়াউদ্দিন কেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছেড়ে গেল আমি বুঝলাম না। ওরা তো এমনিতেই জেনারেল হতো।’ বোঝা কঠিন হয় বৈকি, যদি না আদর্শবাদিতার সন্ধান পাওয়া যায়। প্রবল আদর্শবাদিতা ছিল বলেই এরা চলে এসেছেন, যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধবিমান চালিয়ে চলে আসার চেষ্টা করেছিলেন মতিউর রহমান। পারেননি, প্রাণ হারিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে এরা সবাই ছিলেন দক্ষ বলে স্বীকৃত ও সম্মানিত।
একাত্তরে যুদ্ধে যাওয়াটা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিল চরম মূর্খতা ও অন্ধত্ব। বিপর্যয় যে অবধারিত সেটা পিন্ডির জেনারেলরা না বুঝলেও পূর্ববঙ্গে যারা ছিলেন তারা বিলক্ষণ টের পেয়েছিলেন। এটা দেখা গেছে যে, পূর্ববঙ্গে বদলি হলে অনেকেরই মন খারাপ হয়ে যেত, কিন্তু এখানে আসার পর কেউ কেউ তাদের কর্মস্থলকে পছন্দ করে ফেলতেন। কারণ এখানে তারা যে ধরনের ক্ষমতা পেতেন, স্বদেশে সেটি ছিল দুরাশা। সেটি এক ধরনের ব্যাপার।
অন্য ধরনে দেখা যাচ্ছে যে, একাত্তরে পূর্বে অবস্থানরত সামরিক প্রধানরা প্রায় সবাই ছিলেন নরমপন্থি-মতাদর্শিকভাবে নয়, বাস্তববুদ্ধির তাড়নায়। এরা দেখতে পাচ্ছিলেন যে, যুদ্ধ বাধালে বিজয় তো আসবেই না, ভয়ংকর বিপদ ঘটবে। পিন্ডিতে যারা ছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন অত্যন্ত গরম। কারণ এদের জন্য কোনো বিপদের ঝুঁকি ছিল না। গরমপন্থিরা নরমপন্থিদের ঘাড় ধরে সরিয়ে দিয়েছেন।
গভর্নর এসএম আহসান ছিলেন অনেকটা ভদ্রস্বভাবের, তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনাপ্রধান সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ছিলেন রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে, তাকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। একই কারণে খাদিম হোসেন রাজাকে চলে যেতে হয়েছে, এপ্রিলের প্রথম দিকেই। তাদের জায়গায় এসেছেন কট্টরপন্থি টিক্কা খান ও এএকে নিয়াজী। যুদ্ধশেষে টিক্কা খান যুদ্ধবন্দি হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন, কারণ সৌভাগ্যবশত মাস তিনেক আগেই তিনি বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। নিয়াজীসহ অন্যদের আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে।
শীতল মতদ্বৈত ছিল। সেটি প্রকাশ্য যে হয়নি, তা-ও নয়। ইয়াহিয়া খান শেষবার ঢাকায় আসেন ১৫ মার্চ। সেই দিনই তিনি উচ্চপদস্থ সেনাকর্তাদের এক বৈঠক ডাকেন। সেখানে সামরিক পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে ইয়াহিয়া তার বক্তব্য সবাইকে শোনান। ভিন্ন মত ছিল, কিন্তু কেউ তা প্রকাশ করেননি, কেননা মত চাওয়া হয়নি। একজন তবু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার কমোডর মাসউদ।
ঘটনাটির সুন্দর বর্ণনা আছে সিদ্দিক সালিকের বইতে; বর্ণনাদানকারী এ ভদ্রলোক ইংরেজি সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ছাত্র ছিলেন, জীবন শুরু করেন অধ্যাপনা ও সাংবাদিকতা দিয়ে, পরে জনসংযোগ অফিসার হিসাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, একাত্তরে তিনি ঢাকার সাংবাদিকদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক বিশেষ ছিলেন, সুবিধাবাদিতাতেও বেশ প্রশস্ত ছিলেন, যুদ্ধের পরে তিনি জিয়াউল হকের ঘনিষ্ঠ এবং ওই কর্তার সঙ্গেই বিমান বিস্ফোরণে [আসলে ষড়যন্ত্রে] নিহত হন। তার লেখা বইটি বেশ সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন। তিনি লিখেছেন, সভা শেষ হচ্ছিল প্রেসিডেন্টের এ আশ্বাসবাণী দিয়ে যে, চিন্তার কোনো কারণ নেই, কারণ মুজিবকে কীভাবে জব্দ করতে হবে তা তিনি ভালোভাবেই জানেন।
এটাই ছিল ইয়াহিয়ার শেষ সামরিক সভা। এর কয়েকদিন পরেই মাসউদ তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান। তবে একটি সঙ্গী রয়ে গেল, সেটি তার নৈতিক সাহস। ঘটনাটি খাদিম হোসেনও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। খাদিমের ভাষ্য অনুযায়ী মাসউদ কথা বলেছিলেন আবেগ ও দৃঢ়তার সঙ্গে। খাদিম জানাচ্ছেন যে, মাসউদ তার বক্তব্যে এটিও উল্লেখ করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে অনেক অবাঙালি বসবাস করে, যাদের মানসম্মান, জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব প্রেসিডেন্টের।সামরিক হস্তক্ষেপে সবকিছুই বিপন্ন হবে।
মাসউদের বক্তৃতার সময় পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট তাকে নিবৃত্ত করলেন, বললেন যে, তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন; এবং দ্রুত সভাটি শেষ করে দিলেন। কয়েক সপ্তাহ পরে মাসউদকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এভাবে একজন অত্যন্ত দক্ষ ও সম্মানিত ব্যক্তির পেশাগত জীবন শেষ হয়ে গেল। এসব কথা দুঃখের সঙ্গেই লিখেছেন খাদিম হোসেন রাজা।
মাসউদের চাকরিচ্যুতিতে অনেকেই দুঃখিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কারোরই কিছু করার ছিল না, নিশ্চুপ থাকা ছাড়া। মাসউদ পরে কী করেছেন আমরা জানি না। কিন্তু সময়মতো পদচ্যুত হওয়ায় তিনি যে হিন্দুস্থানের বন্দিশিবিরে আড়াই বছর কাটানোর গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছেন, সেটি সত্য।
যুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষদের আত্মকথনগুলো বেশ উপভোগ্য। এরা সবাই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং দোষ চাপিয়েছেন অন্যের ঘাড়ে। হামুদুর রহমান কমিশন প্রধান অপরাধী হিসাবে ইয়াহিয়া খানকে চিহ্নিত করেছে বটে, তবে সর্বাধিক নিন্দা জানিয়েছেন নিয়াজীকে। অদক্ষতা, কাপুরুষতা, লাম্পট্য, পান-চোরাচালানে সংযুক্তি, কোনো কিছুরই অভাব দেখা যায়নি এ মহাবীরের কাজকর্মে। কিন্তু তিনিই আবার অন্যদের দুষেছেন তাদের ব্যর্থতার জন্য। ‘ব্রিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি বই লিখে তিনি পিন্ডিওয়ালাদের তো বটেই, রণাঙ্গনে তার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও খারাপ খারাপ কথা বলেছেন।
বলেছেন যে, ‘২৫ মার্চ টিক্কা অহেতুক রক্তপাত ঘটিয়েছেন, এক রাতেই পঞ্চাশ হাজার মানুষ মেরে ফেলেছেন এবং নিজের আয়ত্তাধীন সব শক্তিকে এমনভাবে লেলিয়ে দিয়েছেন যেন নিজের দেশের বিপথে পরিচালিত ও বিপথগামী মানুষের সঙ্গে নয়, বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছেন।’
নিয়াজী জানাচ্ছেন যে, টিক্কাকে লোকে চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, জেনারেল ডায়ার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছে। ২০০২ সালে উর্দু ডাইজেস্ট নামের একটি পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফরমান আলী সম্পর্কে তিনি অভিযোগ করেন যে, ওই সেনা অফিসারটি ভারতীয়দের দেওয়া শর্তে দ্রুত আত্মসমর্পণ করে বাঙালিদের হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলেন, কারণ ২৫ মার্চের অভিযানে জড়িত থাকার দরুন বাঙালিরা তাকে ভীষণ ঘৃণা করত।
নিয়াজী কোন ধরনের মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে খাদিম হোসেনের সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি। সিদ্দিক সালিকের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে ওই সেনাপতিটির বীরত্বের প্রমাণ। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নিয়াজী মাটির নিচে তৈরি তার হেডকোয়াটার্সে আশ্রয় নেন। ৪ ডিসেম্বর গুজব রটে গিয়েছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী অমৃতসর দখল করে নিয়েছে। এ গুজব শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজী তার চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে কুস্তিগিরের মতো নর্তন-কুর্দন শুরু করেন। দ্রুত গভর্নরকে ফোন করে তিনি শুভ সংবাদটি জানালেন। পরে ওটি যখন গুজব বলে প্রমাণিত হলো, তখন সেই যে চুপসে গেলেন আর সতেজ হতে পারলেন না।
তবে ৭ ডিসেম্বর তাকে একবার আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল, কেননা গভর্নর ডা. এমএ মালিক তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গভর্নমেন্ট হাউজে। সেখানে গিয়ে নিয়াজী কোনো কথা বলছেন না দেখে মালিক সাহেব তার পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর তখনই ঘটল মস্ত এক ঘটনা। জেনারেল সাহেবের নাদুসনুদুস দেহটি কেঁপে কেঁপে উঠল এবং তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দু-হাতে মুখ ঢেকে তিনি শিশুর মতো ফোঁপাতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময়ে একজন বাঙালি ওয়েটার ট্রেতে করে কফি ও ø্যাকস সাজিয়ে নিয়ে কামরায় ঢুকে পড়ে। ‘কুকুরের মতো গর্জন’ করে তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো।
ওয়েটারটি বের হয়ে এলো ঠিকই, কিন্তু সে তার বাঙালি সহকর্মীদের জানাতে ভুল করল না যে, সাহেবরা সবাই মিলে কান্নাকাটি করছেন। ১২ তারিখে নিয়াজী আবার বের হন, এবার তিনি সামরিক হাসপাতালে যান। সেখানে ছয়জন নার্স তার কাছে কোনোমতে এসে বলতে সক্ষম হয় যে, তারা মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা চায়। জেনারেল সাহেব তাদের আশ্বস্ত করে বলেন যে, ভয়ের কোনো কারণ নেই, কেননা খুব বড় রকমের সাহায্য (অর্থাৎ চীনারা) রওয়ানা হয়ে গেছে।
আর সাহায্য যদি নাই আসে, তাহলেও চিন্তা নেই; ‘মুক্তিবাহিনীর হাতে তোমাদেরকে আমরা কিছুতেই পড়তে দেব না, তার আগে আমরাই তোমাদেরকে মেরে ফেলবো।’ ওই যাত্রাতেই সাংবাদিকরা তাকে ঘেরাও করে ফেলেন; তাদের কাছে তিনি দম্ভভরে বলেন, ‘ঢাকার পতন ঘটবে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে।’
বলে নিজের বুক নিজেই চাপড়িয়েছিলেন। সিদ্দিক সালিক জানাচ্ছেন যে, ১৬ তারিখে খুব সকালে আহত মেজর-জেনারেল রহিম ও আরও কয়েকজন যখন তিনটি হেলিকপ্টারে করে বার্মায় পাড়ি দিলেন, তখন তাতে নার্সদের নেওয়া গেল না, কারণ তাদের হোস্টেল থেকে ‘সংগ্রহ করা’ সম্ভব হয়নি। সিদ্দিক সালিকের বইটি তথ্যে সমৃদ্ধ। তার দেওয়া একটি তথ্য তো বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়