দেশপ্রেমের চশমা
প্রকাশনার জগতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। বইমেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বইমেলার বিশৃঙ্খলা সাম্প্রতিক বিষয় নয়।
বইমেলার মূল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছেন লেখক, পাঠক, প্রকাশক এবং মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি। একাডেমি উদ্যোগ নিলে বইমেলার নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; কিন্তু একাডেমির সে উদ্যোগ নেই। উল্লেখ্য, বইমেলার প্রাণভোমরা হচ্ছে বই। বইকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় বইমেলা। আর বইয়ের স্রষ্টা হলেন লেখক। লেখক কষ্ট করে বই না লিখলে প্রকাশক তা প্রকাশ করতে পারতেন না।
পাঠক বই পড়তে বা সংগ্রহ করতে পারতেন না। অথচ বইমেলায় সবচেয়ে নিগৃহীত হন লেখক। লেখকের প্রাপ্য সম্মান বা সম্মানি দেওয়া তো দূরের কথা, তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার পর্যন্ত করা হয় না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রকাশক লেখকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে লেখকের অভিযোগের জায়গা নেই।
গরিব লেখকরা কি প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করতে আদালতে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখেন? লেখক সচ্ছল হলেও এমন উদ্যোগে জড়াতে চান না। বাংলা একাডেমি চাইলে লেখকদের জন্য একটি ‘অভিযোগ শাখা’ গঠন করে লেখকস্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে একাডেমির তেমন ইচ্ছা আছে বলে প্রতীয়মান নয়।
বইমেলার বিভিন্ন দিকে বিশৃঙ্খলা-স্টল বরাদ্দ, বইমেলাকে কেন্দ্র করে একাডেমি কর্তৃক বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান, প্রকাশিত বইয়ের সাহিত্য মান এবং লেখকবান্ধব না হয়ে মেলার প্রকাশকবান্ধব চরিত্র ধারণ ইত্যাদি নিয়ে রয়েছে অভিযোগ। বইমেলায় অধিক পাঠক সমাগম হয়। বই না কিনলেও মেলাকে অনেক কিশোর-যুবক বিনোদনকেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে। মেলাকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ প্রকাশক নতুন বই প্রকাশ করেন। প্রকাশনার ক্ষেত্রে কতিপয় খ্যাতিমান প্রকাশক নামি-দামি লেখকদের পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেন। তার মধ্যে আবার বিশেষ বিশেষ প্রকাশকের বিশেষ লেখক ঘরানার কথা শোনা যায়। তারা অনেকটাই রাজনৈতিক প্রভাব এবং নিজের তৈরি পলিসি স্মরণে রেখে বই ছাপেন। কোনো লেখক তাদের নিজস্ব ঘরানার না হলে তিনি যত ভালো বই লিখুন না কেন, ওই প্রকাশনা থেকে তার বই প্রকাশ করা হয় না। এক্ষেত্রে রাজধানীর বাইরের লেখকরা ভালো বই লিখলেও প্রকাশকদের কাছে পাত্তা পান না।
গ্রামে বসবাসকারী লেখক খুব ভালো একটি বই লিখলেও প্রকাশকদের সমাদর পান না। প্রকাশক তাকে এমন ভাব দেখান যে, তার বই ছাপলে পাঠক গ্রহণ করবেন না। যদি কোনো প্রকাশক ছাপেনও, লেখকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করেন না। লেখকের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন যাতে তার মনে হয়, তিনি দয়া করে তার বই ছাপছেন। অনেক ক্ষেত্রে এহেন নতুন লেখকদের সম্মানি দেওয়া তো দূরের কথা, বরং তাদের কাছে প্রকাশকরা প্রকাশনা খরচের অংশ হিসাবে অর্থ দাবি করেন। অনেক ক্ষেত্রে বলেন, আপনাকে কিন্তু ২০০ বা ২৫০ কপি বই কিনে নিতে হবে। অনেকে এমন প্রস্তাবে রাজি হন, অনেকে হন না। তার বই ভালো বিক্রি হলেও বলেন, বই বিক্রি হচ্ছে না। যদি ১৫৫০ কপি বিক্রি হয়, বলেন-২১ কপি বিক্রি হয়েছে। অসহায় লেখক কী করবেন? তিনি কি বইয়ের স্টলে দারোয়ান বসাবেন?
রকমারি, বই বাজার ইত্যাদি অনলাইন বই বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে বই বিক্রি হলেও লেখক জানতে পারেন না তার কত কপি বই বিক্রি হলো। ওই অনলাইনে বই বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো লেখককে তার বই বিক্রির তথ্য দেন না। লেখকের কত কপি বই প্রথম সংস্করণে ছাপা হলো, তা-ও লেখককে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশকরা সত্য তথ্য দেন না। অনেক ক্ষেত্রে বেশি বই ছেপে কমসংখ্যক বই প্রকাশের কথা বলা হয়।
বিরাজমান ব্যবস্থায় টাকা দিলে বই মানসম্পন্ন না হলেও অনেক প্রকাশক সেই বই ছেপে দেন। এ কারণে বইয়ের মান ভালো হয় না। এজন্য বিদেশে বসবাসকারী লেখকদের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকদের কাছে অধিকতর সমাদৃত হয়। কারণ, এমন লেখকরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজের বই প্রকাশে অর্থের জোগান দেন। বইয়ের নামে মলাট বাঁধানো কাগজে কী ছাপা হচ্ছে, তা দেখভালের জন্য যোগ্য কর্তৃপক্ষ নেই। স্মর্তব্য, ২০০০ সালে একুশে বইমেলায় ৫ হাজারের কিছু কম বই প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১০ শতাংশের সামান্য কম বই ছিল মানসম্মত। বাকি ৯০ শতাংশ বই মানসম্মত ছিল না। প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুসংখ্যক প্রকাশক বই প্রকাশের জন্য উদীয়মান লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অব্যাহতভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। লেখক যোগাযোগ করলে তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে বই প্রকাশ করেন। ফলে এসব বইয়ের মান কেমন তা অনুমেয়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে যে প্রকাশনা, তা মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বই প্রকাশিত হয় না। ফলে রাজধানীতে বসবাসকারী লেখকরা বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান। মফস্বল থেকে প্রকাশিত বইগুলোকে যদি একাডেমি উৎসাহ দিত, তাহলে গ্রামাঞ্চল থেকে অনেক লেখক উঠে আসতেন।
প্রতিবছর বইমেলায় কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। এ অর্থের কত ভাগ প্রকাশকের আর কত ভাগ লেখকের পকেটে যায়, সে হিসাব করার কেউ নেই। বইয়ের স্রষ্টা হলেও দুই-চারজন জনপ্রিয় লেখক ছাড়া অধিকাংশ লেখকের পকেটে টাকা ঢোকে না। লেখককে ‘দেব’, ‘দিচ্ছি’ করে অধিকাংশ প্রকাশক ২-৫ বছরেও অনেক ক্ষেত্রে লেখক সম্মানি দেন না। এক্ষেত্রে পাঠকদের সঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমার চার দশকের শিক্ষকতা জীবনে একুশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হাতে আরও পাণ্ডুলিপি আছে। তবে প্রকাশকদের সঙ্গে আলাপ করতে রুচি হয় না। এই একুশটি বইয়ের মধ্যে একটি বাদে ২০টি কারও অনুদান না নিয়ে নিজের রক্ত আর ঘাম পানি করে নিজ খরচে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে লেখা। বাকি কাজটি করেছি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রদত্ত ফেলোশিপের অধীনে, যা টিআইবি বই আকারে প্রকাশ করেছে। উল্লেখিত ২০টি বইয়ের প্রকাশকদের আচরণেই আমি হতাশ ও মর্মাহত। তাদের মধ্যে একজন একটি বইয়ের প্রথম সংস্করণ শেষ হলে আমাকে সামান্য অর্থ দেন। কিন্তু প্রথম সংস্করণে তিনি কতসংখ্যক বই ছেপেছিলেন, তা আমায় বলেননি। তবে যে অন্যায়টি তিনি করেন তা হলো, আমার অনুমতি না নিয়ে তিনি দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে ফেলেন। বইটির প্রচ্ছদের রং পরিবর্তন করেন। আমাকে দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন। বানানসহ অন্য যেসব ভুল ছিল তা সংশোধন করেননি, বা আমাকে করার সুযোগ দেননি। দ্বিতীয় সংস্করণে কতসংখ্যক বই ছেপেছেন তা-ও আমাকে বলেননি। কেবল আমাকে ১৫ কপি বই দিয়েছেন। এখন এ বইটি আমাজন ডটকম থেকে শুরু করে স্বদেশি অনলাইনে এবং বইয়ের স্টলে বিক্রি হচ্ছে।
বহু বছর প্রকাশক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার বছর দুই পর আমি প্রকাশকের ঢাকাস্থ অফিসে গিয়ে আমার বইয়ের কত কপি বিক্রি হয়েছে জানতে চাই। প্রকাশকের অফিস সহকারী কম্পিউটার দেখে বলেন, ৯৯ কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু তার দু-তিন বছর পর প্রকাশককে রয়্যালিটির ব্যাপারে ফোন করলে তিনি বলেন, আমার বই এক কপিও বিক্রি হয়নি। এরপর আমি কয়েক বছর পর আবারও একবার ফোন করে একই রকম উত্তর পাই। জানি না এর মধ্যে ওই মিথ্যাবাদী প্রকাশক ওই বইয়ের আর কয়টি সংস্করণ বের করেছেন বা করেননি। আর দ্বিতীয় সংস্করণেই বা কত কপি বই ছেপেছিলেন।
এই হচ্ছে প্রকাশকদের সততার নমুনা। বিরল ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলব না। আমার পর্যবেক্ষণে সৎ প্রকাশকের সংখ্যা অনেক কম। আরেকজন বন্ধুস্থানীয় প্রকাশক আমার লেখা অর্ধ ডজনের বেশি বই প্রকাশ করেছেন। চুক্তি করা হবে বলেও গড়িমসি করে চুক্তি করেননি। কিছু বই অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। কখনো যোগাযোগ করেন না। আমি ফোন করলে ফোন ধরেন না।
বাংলাবাজারের আরেক মধ্যম মানের প্রকাশক আমার একটি বই পুনঃমুদ্রণ করেছেন। চুক্তি করেছেন। এ বইটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত। কাজেই ভালো বিক্রি হচ্ছে। সে কারণে প্রকাশক পুনঃমুদ্রণ করেছেন। কিন্তু ফলাফল একই। ফোন করলে বলেন, বই ২/৩ কপি বিক্রি হয়েছে। এখন ভাবছি, এ বইটি অন্য কোনো প্রকাশককে দিয়ে পুনঃমুদ্রণ করাব। কিন্তু একজন লেখকের কাজ কি প্রকাশকের পেছনে লেগে থাকা? তার কি অন্য কাজ নেই? নতুন বই লেখার কাজ নেই? প্রকাশনা জগতের এ বিশৃঙ্খলা সামনের দিনগুলোতে বাড়বে। কারণ, বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ না নিলে তা আরও সম্প্র্রসারিত হয়। নিজে একজন লেখক হয়ে ২১টির মধ্যে ২০টি বইয়ের একটি প্রথম প্রকাশনা থেকে একবার পাওয়া সামান্য টাকাই আমার লেখকজীবনের সম্মানি।
একজন লেখক হিসাবে আমি চাই লেখালেখি ও প্রকাশনার জগতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক। লেখকরা তাদের মর্যাদা ও সম্মান পান। প্রকাশকরা সততার সঙ্গে বই প্রকাশ করুন। বই প্রকাশের সময় লেখকের সঙ্গে ঠিকভাবে চুক্তি করুন। সেই চুক্তি অনুযায়ী লেখককে সম্মানি প্রদান করুন। লেখককে উৎসাহিত করে নতুন বই লিখতে অনুপ্রাণিত করুন। বাংলা একাডেমি লেখকদের যেসব পুরস্কার দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক। অখ্যাত লেখকদের জাতীয় পদকে পুরস্কৃত করে সে পুরস্কার আবার প্রত্যাহার করার মতো লজ্জাজনক ঘটনা প্রত্যাশিত নয়। লেখালেখি ও প্রকাশনা জগতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমিকে স্বাধীনতা দিয়ে অধিকতর সক্রিয় করার সুযোগ রয়েছে। সুযোগ রয়েছে বইমেলাকে প্রকাশকবান্ধব থেকে লেখকবান্ধব করার। একজন ক্ষুদ্র লেখক হিসাবে আমি সরকারি অফিস-আদালতে বিরাজমান বিশৃঙ্খলার মতো প্রকাশনা জগতেও সুশাসনের ঘাটতি ও বিশৃঙ্খলা দেখতে চাই না। আমার বিশ্বাস, দেশপ্রেমিক লেখকসমাজও তা চায় না।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক (এলপিআর), রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com