অঙ্গদান একটি মানবিক উপহার
ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার বা অন্য কোনো কারণে যদি আমাদের ব্রেন স্টেমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তখন একে বলা হবে ব্রেন ডেথ।
ব্রেন স্টেম হলো মস্তিষ্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য। মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর (হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস ও অন্যান্য) নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হলো ব্রেন স্টেম। ব্রেন স্টেম অকার্যকর হয়ে গেলেও আমাদের হৃদ্যন্ত্রের মাংসপেশির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে লাইফ সাপোর্ট যন্ত্রের সাহায্যে আরও কিছুদিন সেই মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
যদিও তার বাকি অঙ্গগুলো অকার্যকর হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। একমাত্র নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) বিশেষ মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর (লাইফ সাপোর্ট) যন্ত্রের মাধ্যমে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস পরিচালনা করা হয় এবং অন্য অঙ্গগুলো সচল রাখার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, ব্রেন ডেথ নিশ্চিত হয়ে গেলে সেই মানুষটি আর ফিরে আসবে না।
ক্যাডাভেরিক হলো যাদের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায় এবং যাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় তাদের ক্যাডাভেরিক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। যদি তারা ক্যানসার, হেপাটাইটিস, এইচআইভি বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত না হন, তাহলে তারা ক্যাডাভেরিক হিসাবে অঙ্গদান করতে পারেন।
মরণোত্তর অঙ্গদান আর ক্যাডাভেরিক অঙ্গদান এক বিষয় নয়। মানুষ মারা যাওয়ার পর শুধু তার কর্নিয়া (যা ৬ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হয়) প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আইসিইউতে ব্রেন ডেথ রোগীর হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গ সচল থাকে। ব্রেন ডেথ রোগীর ব্রেন ছাড়া সব সচল থাকে। এমন রোগী থেকে আটটি অঙ্গ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্য মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। আর ব্রেন ডেথ রোগী শুধু আইসিইউতেই পাওয়া যায়।
কোনো ব্যক্তি ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হওয়ার পর কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় ও খাদ্যনালির মতো অঙ্গগুলো দান করলে অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। তবে হৃৎপিণ্ড থেমে গেলেও কর্নিয়া, অস্থি, অস্থিমজ্জা ও চর্ম প্রতিস্থাপন করা যায়। এগুলোকে ক্যাডাভেরিক প্রতিস্থাপন বলা হয়।
একজন ব্রেন ডেথ মানুষের দেওয়া অঙ্গগুলোর মাধ্যমে মোট আটজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। দুটি কিডনি, দুটি ফুসফুস, একটি হৃদ্যন্ত্র, একটি অগ্ন্যাশয়, পূর্ণাঙ্গ অন্ত্রনালি ও যকৃৎ। উন্নত দেশগুলোয় অনেক আগে থেকেই ব্রেন ডেথ রোগীর শরীর থেকে অঙ্গগুলো সংগ্রহ করে অন্যের জীবন রক্ষা করার কাজ প্রচলিত আছে।
মৃত্যু এক অবধারিত সত্য। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এ মৃত্যুর ধরনে রয়েছে নানা মত। ঐতিহাসিকভাবে একজন মানুষকে তখনই শুধু মৃত বলা হতো, যখন তার হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তবে ৫০-৬০ বছর ধরে মৃত্যুর আরেকটি রূপ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেটি হলো ব্রেন ডেথ বা ব্রেন স্টেম ডেথ। এ ধারণাটি ব্যবহৃত হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মৃত্যুকে বলা হয় ‘হোল ব্রেন ডেথ’। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের মাধ্যমে দুই ধরনের মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। একটি হলো ‘সারকুলেটরি ডেথ’ (হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধজনিত মৃত্যু); অন্যটি ‘হোল ব্রেন ডেথ’ (মস্তিষ্কের পুরো কর্মকাণ্ড বন্ধ, কিন্তু হৃদ্যন্ত্র সচল থাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত)। সারকুলেটরি ডেথ ইংল্যান্ডেও প্রচলিত। তবে হোল ব্রেন ডেথ ইংল্যান্ডে ব্রেন ডেথ বা ব্রেন স্টেম ডেথ নামে সংজ্ঞায়িত।
আমাদের দেশের আইসিইউতেও অনেক সময় ব্রেন ডেথ রোগী ভর্তি হয়ে থাকেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের সময়মতো ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা যায় না। এর একটি কারণ হলো এ ধরনের মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। তারা এ রোগীকে মৃত বলে মেনে নিতে চান না। কারণ, তখনও রোগীর হৃদ্যন্ত্র সচল থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও অনাহূত বিপদের আশঙ্কায় ব্রেন ডেথ ঘোষণা এড়িয়ে যেতে চান। অনেক হাসপাতালে হয়তো ব্রেন ডেথ ঘোষণাদানকারী কমিটি থাকে না। একজন সারাহ ইসলামের মাধ্যমে আলোকিত হয়ে উঠেছে ব্রেন ডেথের ধারণা। সারাহ ইসলাম ২০ বছরের এক তরুণী। তার মা শবনম সুলতানা একজন শিক্ষক। জন্মের মাত্র ১০ মাস পরেই ধরা পড়ে সারাহ ইসলাম টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত। মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেশি, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তখন থেকে সারাহ ও তার পরিবারের যুদ্ধ শুরু হয় এ রোগটির বিরুদ্ধে। দীর্ঘ প্রায় ১৯ বছর সারাহ এ রোগটির সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।
সারাহ ইসলাম মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। জটিল এ রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে চারুকলায় স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি সুদক্ষ চিত্রশিল্পী ছিলেন। মানবতাবাদী ছিলেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। তাই তার মা শবনম সুলতানা তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এ অঙ্গদানে সম্মতি দিয়েছেন। সম্মতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করা হয় সঠিক অঙ্গগ্রহীতার খোঁজ।
প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ছয়জন সম্ভাব্য রোগীকে পরীক্ষা করে সেখান থেকে দুজনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। গত ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা থেকে জটিল এ অস্ত্রোপচার শুরু হয় এবং শেষ হয় পরদিন ভোর প্রায় ৫টার দিকে। আইন অনুযায়ী গঠিত প্রতিটি টিম এখানে সুদক্ষভাবে কাজ করেছে। প্রতিস্থাপন দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ইউরোলজিস্ট ও ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান।
ইউরোলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট, আইসিইউ বিশেষজ্ঞ, কিডনি ফাউন্ডেশন, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান কমিটির সবাই সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে এ কাজে যুক্ত ছিলেন।
আমি উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিই। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন লজিস্টিক সহায়তাসহ প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রিফ কাউন্সিলর (শোকার্ত মানুষকে মানসিক সহায়তাদানকারী) গঠন, অন্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি প্রভৃতি কাজ শুরু করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ প্রস্তুতির পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো মরণোত্তর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেই। জরুরি ভিত্তিতে কিডনি প্রয়োজন এমন ৫০ রোগীর তালিকা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
এর মধ্যে অন্তত তিনবার মৃত ব্যক্তির কিডনি পাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের অনীহায় প্রতিস্থাপন করা যায়নি। মরণোত্তর দানের কিডনি প্রতিস্থাপনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এজন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চুক্তি করেছে। সেখানে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত আইসিইউর রোগীদের পরিবার সম্মতি দিলে কিডনি নেওয়া হবে। ছয় মাস ধরে বেশ কয়েকবার এমন কিডনি পাওয়ার ব্যবস্থা হলেও তা সংগ্রহ করা যায়নি। এক রোগী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইসিইউতে। ওই রোগীর পরিবার কিডনি দান করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আইসিইউ থেকে ওই রোগীর টিউব খুলে ফেলা হয়। এ কারণে আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যক্তিদের ভুলে শেষ মুহূর্তে কিডনি সংগ্রহ করা যায়নি। একই ঘটনা ঘটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরেক রোগীর ক্ষেত্রে। আগে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে এক রোগী ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হলে পরিবার কিডনি দিতে সম্মত হয়। তবে ভোরবেলা রোগীর মৃত্যু হলে পরিবারটি মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। হাসপাতাল থেকেও দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সারাহ ইসলামই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ব্রেন ডেথ থেকে মৃত্যুর আগে নিজের অঙ্গদান করে চারজন মানুষের জীবনে আশা জাগিয়ে গেলেন। সারাহ ইসলামের দিয়ে যাওয়া উপহার সবচেয়ে দামি উপহার। জীবনদায়ী উপহার। একজন মানুষ কতটা মহান হলে এ কাজ করতে পারেন! সারাহ দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে মৃত্যুকে পরাজিত করা যায়। মৃত্যুর পরও সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা যায়। মৃত্যুর পরও কীভাবে অন্য মানুষের উপকার করা যায়। আমার কাছে সারাহ ইসলাম হলো মানবতার প্রকৃত ফেরিওয়ালা। নশ্বর দেহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপর এক প্রাণের নাম হলো সারাহ ইসলাম। বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে এ নাম চিরদিন খোদাই হয়ে থাকবে। মানবতার জগতে তিনি আমাদের কাছে এক অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়