Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

অবৈধ আয়ে বিত্তশালীর সংখ্যা বাড়ছে

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অবৈধ আয়ে বিত্তশালীর সংখ্যা বাড়ছে

টাকা-পয়সা বানানো কি অপরাধ? অর্থবিত্তের মালিক হওয়া কি অনৈতিক অথবা বেআইনি? সমাজ কি তাদের অনুকূল দৃষ্টিতে দেখে? এসব প্রশ্ন মাঝেমাঝেই আমাদের মধ্যে জাগে। বিশেষ করে যখন খবরের কাগজে বিত্ত ও বিত্তবানদের ওপর নানা ধরনের খবর দেখি। কখনো দেখি অর্থনীতিতে নাকি নগদ টাকার ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে অশনিসংকেত।

কখনো দেখি ব্যাংকে নাকি লকারের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভর্তি করা হচ্ছে ডলার, সোনাদানা ইত্যাদি। কখনো দেখি কারও কারও কোটি কোটি টাকার বাড়ি। আবার খবর দেখি একশ্রেণির মানুষের দেদার খরচের। এ ধরনের খবর পড়ে, ঘটনা দেখে কার না চিত্ত বিচলিত হয়! কার না মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জাগে।

প্রশ্ন জাগে, কী করে এত টাকার মালিক হয় একজন? কী করে একজন এত ধন-সম্পদের মালিক হয়? বিশেষ করে যখন দেশের প্রায় ৪-৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। বিশেষ করে যখন বহু মানুষ প্রতিদিন দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে যখন মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচতে কষ্ট পাচ্ছে, ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। এ ধরনের পরিবেশে কেউ টাকা বানালে, বিত্তশালী হলে প্রশ্ন জাগবেই।

যেমন এ মুহূর্তে আমার ভীষণভাবে প্রশ্ন জাগছে খবরের কাগজের একটি রিপোর্ট দেখে। খবরটির শিরোনাম : ‘দেশে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির। দেশে ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। মহামারির মধ্যেও দেশে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ।’

এসব খবর পাঠ করে কার না চিত্ত জ্বালা করে? আমার সেই অর্থে চিত্ত জ্বালা নয়; আমার প্রশ্ন, এও কি এই নিু-মধ্যআয়ের দেশে সম্ভব? কিন্তু সম্ভব হয়েছে। কারণ খবরটি দেখছি একটি নামকরা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের। প্রতিষ্ঠানটি জুরিখভিত্তিক ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক। সেদেশে গোপন অর্থ, বৈধ-অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ রাখা যায় অতি সহজে। বিশ্বে দুই-তিনশ বেসরকারি ব্যাংক আছে, যারা অর্থ গোপন করার কাজে সাহায্য করে।

সংশ্লিষ্ট খবরটিতে দেখলাম ক্রেডিট সুইস ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনে অনেক দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের খবর দিয়েছে। এতে বাংলাদেশও আছে। খবরটি ডলারের ওপর ভিত্তি করে রচিত। এতে টাকায় রূপান্তর করে হিসাব দেওয়া হয়েছে। সর্বনিু সম্পদের মালিক ধরা হয়েছে ১০ লাখ ডলার। আর সর্বোচ্চ ধনাঢ্য ব্যক্তি ধরা হয়েছে তাকে, যার ৫০ কোটি ডলারের বেশি সম্পদ আছে।

বলা হয়েছে-খানা জরিপ, অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান, ফোর্বসের তথ্য এবং ডলারের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি প্রকাশ করা হয়েছে। এসব কারণে মনে হয় খবরটির বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। বিশেষ করে যখন তা তৈরি করেছে ক্রেডিট সুইসের মতো আন্তর্জাতিক ব্যাংক, যারা গোপন অর্থ, বৈধ-অবৈধ অর্থের খবর রাখে। এ কারণে খবরটি পাঠ করেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে-এও কি সম্ভব আমাদের দেশে? ৫ হাজার কোটি টাকা! কত টাকা তা অনুমান করা সাধারণ লোকের পক্ষে অসম্ভব। এক কোটি, দুই কোটি, পাঁচ কোটি পর্যন্ত বোঝা যায়। কিন্তু ৫ হাজার কোটি টাকা! মাই গড! ভাবার বিষয়। তবে ভাবার আগে আরেকটা কথা।

আসলে কি দেশে ৫ হাজার কোটি টাকার মালিক মাত্র ২১ ব্যক্তি, আর ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি? সাদা চোখে দেখলে, চারদিকের বাস্তব অবস্থা দেখলে মনে হয় এ তথ্য একটা ‘আন্ডার এস্টিমেট’। প্রকৃতপক্ষে ধনাঢ্য ব্যক্তির সংখ্যা হবে আরও বেশি, অনেক বেশি। ঢাকা শহরে যার একটি ফ্ল্যাট আছে, সেই-ই কমপক্ষে কোটিপতি।

গুলশান, বনানী, উত্তরা, বসুন্ধরা, পূর্বাচল ইত্যাদি এলাকায় যাদের ৩-৫ কাঠা করে জমি আছে, সেই ব্যক্তিদের সম্পদের পরিমাণ কত? ৫০-১০০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তো এসব এলাকায় ঘরে ঘরে। আর ২-৪-৫ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণগ্রহীতার সংখ্যা কত? যে ব্যক্তি এত টাকার ঋণ নিতে পারে, তার ‘কোলেটারেল’ কত? গ্রামাঞ্চলে, উপজেলা শহরে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ভূরি ভূরি, যারা ১০-২০-৫০ কোটি টাকার সম্পদ-সম্পত্তির মালিক।

এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে, এসব অনুমানের ভিত্তি কী? কোনো জরিপ কি আছে? কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান কি কোনো জরিপ করে দেখেছে? না, এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। তবে সাদা চোখ যা দেখে, সাধারণভাবে মানুষ যা দেখে ও বিশ্বাস করে, তা সবসময় অমূলক হয় না। বিশেষ করে যখন ‘লাখ’ টাকার কোনো মূল্য নেই। একসময় ‘লাখপতি’ হলে তার বাড়িতে ঘি-এর বাতি জ্বলত। আমাদের হিসাবও ‘লাখে’ গিয়ে শেষ হয়ে যেত। হাজার, লাখ-এখানেই শেষ।

আর আজ? আজ লাখ কোনো ঘটনা নয়। মিলিয়নও (দশ লাখ) কোনো ঘটনা নয়। বিলিয়নও (শত কোটি) কোনো বিষয় নয়। আজকাল হিসাব হয় কোটিতে নয়-মিলিয়ন, বিলিয়ন ও ট্রিলিয়নে। বাঙালি অনেক সাবালক এখন। এ অবস্থায় ‘ক্রেডিট সুইস’ যখন বলে, ৫৫ থেকে ১০৭ কোটি টাকার সম্পদের মালিক দেশে ১ হাজার ১২৫ জন, এদের প্রত্যেকের সর্বনিু সম্পদ ৫৪ কোটি টাকা থেকে ১০৭ কোটি টাকা, তখন বিষয়টি হাস্যকর মনে হয় আমার কাছে।

বস্তুত কে কত টাকার সম্পদের মালিক, কে কত টাকা ব্যাংকে আমানত রেখেছে, কে কত টাকা লকারে রেখেছে-এটা কোনো খবর নয়। খবর হচ্ছে, এই টাকা-সম্পদ বৈধভাবে অর্জিত কিনা, এই সম্পদ কর-পরিশোধিত সম্পদ কিনা। যদি বৈধভাবে কেউ শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিক হয়, তাহলে কার কী আপত্তি আছে বা আপত্তি থাকতে পারে? বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। অবাধ ধনবাদের দেশ, বাজার অর্থনীতির দেশ। উগ্র ধনবাদের দেশ।

এখানে মেধা, শ্রম, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ আছে। এটা হতে হবে আইনের মধ্যে, নিয়ম-কানুনের মধ্যে। দেশের প্রচলিত আইন-বিধি মেনে সম্পদ করতে হবে। সরকারের সব কর পরিশোধ করতে হবে। গ্যাসের বিল, বিদ্যুতের বিল নিয়মিত পরিশোধ করে, খাজনা-কাস্টম ডিউটি-ভ্যাট-আয়কর দিয়ে অর্থসম্পদ বানালে কি কারও আপত্তি থাকার কথা? অবশ্যই না। যদি কেউ ব্যাংকের টাকা না মেরে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়, তাহলে আপত্তি কোথায়? মানুষের সম্পত্তি জবরদখল, সরকারি সম্পত্তি জবরদখল না করে কেউ যদি টাকা বানায়, তাহলে আপত্তির কথা উঠবে কেন?

এই জায়গাতেই প্রশ্ন। আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে, যারা সম্পদশালী হচ্ছেন, টাকা-পয়সা করছেন, তাদের অনেকের সঙ্গে মেধা, প্রতিযোগিতা ও শ্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক ক্ষেত্রেই এর সম্পর্ক ‘পাওয়ারের’ সঙ্গে। ‘এক্সেস টু পাওয়ার’ই হচ্ছে বিত্তশালী হওয়ার পথ। অনেক ক্ষেত্রে বিত্তশালীরা সরকারের পাওনা টাকা দেন না। ভ্যাট দেন না, আয়কর দেন না, গ্যাসের টাকা দেন না। ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন না। নানা ধরনের রেয়াত তারা নিয়মিত পান সরকারের কাছ থেকে। সস্তায় ঋণ, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠন করা ইত্যাদি নিয়মিত ঘটনা। আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং ইত্যাদি ঘটনা নিয়মিত।

রপ্তানির টাকা অনেকেই দেশে আনেন না। খাল-বিল, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, খাসজমি দখল করা অনেকেরই একটা নেশা এবং তা করে অনেকেই ভীষণ বিত্তশালী। ক্যাসিনো চালিয়ে ‘বিলিয়নিয়ার’। পরের ধন হরণ করা বহু লোক দেশে আছে, যাদের পেশাই হচ্ছে মানুষের অর্জিত সম্পত্তি-সম্পদ জবরদখল করে। এ জায়গাতেই প্রশ্ন, এ জায়গাতেই আপত্তি। এসব বেআইনি কাজ করে যারা সম্পদশালী, শত কোটি, সহস্র কোটিপতি, তাদের খবর দেখলে সবারই উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। হবে না-ই বা কেন?

একদিকে এভাবে অবৈধ সম্পদের মালিক দেশে থাকবে, সবকিছু ভোগ করবে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পড়ে দিনাতিপাত করবে-তা কী করে হয়? সবচেয়ে বড় কথা, এই যে সহায়-সম্পত্তি, তা কি দেশে আছে? যে রিপোর্টটি পাঠ করে এই আলোচনা করছি, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে না এই হাজার হাজার কোটি টাকা-সম্পদের মালিকদের সম্পদ দেশে আছে কিনা।

চারদিকের যে খবর, খবরের কাগজে প্রতিদিন যেসব খবর ছাপা হচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায়, দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একটি বড় অংশের সহায়-সম্পদ দেশে নেই। অনেকের ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন থাকে বিদেশে। তারা বিদেশের নাগরিক। ‘রোজগার’ দেশে, পাচার বিদেশে। দুবাই, ইউরোপীয় দেশগুলো, আমেরিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, অস্ট্রেলিয়ায় বিপুলসংখ্যক ধনাঢ্য ব্যক্তি তাদের সহায়-সম্পত্তি ‘ট্রান্সফার’ করে রেখেছেন। এসব খবর কয়েকদিন পরপর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা আমাদের দেয়। বিদেশে কাদের সহায়-সম্পদ আছে, তাদের খবর সবাই জানলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো তা জানে না বলে আমাদের জানানো হয়।

একবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বলেছিলেন, তার কাছে নাকি বিদেশে সহায়-সম্পত্তির মালিক এমন লোকের তালিকা আছে। এবং এ তালিকাতে নাকি অবিশ্বাস্য সব নাম-ধাম আছে। আজকাল অবশ্য ইউটিউবের বদৌলতে আমরা অনেক বাড়ি-ঘরের ছবি দেখি, যেখানে বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজন বসবাস করে। এ অবস্থায় বলাই যায়, যদি আমাদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহায়-সম্পদ দেশে থাকত, তাহলে দেশ উপকৃত হতো, দেশের অর্থনীতি উপকৃত হতো।

পরিশেষে বলা দরকার, আমি অর্থবিত্তের বিরোধী নই। ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ এসব তত্ত্বেও বিশ্বাস করি না। তবে যেটা দরকার তা হচ্ছে বৈধ পথে টাকা কামানো। অনেকে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথম ধাপে নাকি টাকা বৈধভাবে না অবৈধভাবে অর্জিত, তা বিবেচনা করলে চলে না। প্রথমে পুঁজি গঠন করতে দিতে হবে। কিছু লোকের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। কিছু লোককে ধনাঢ্য করতে হবে। এরাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ, শিল্পায়নের কাজ করবে। বলা হয়, ‘এভরি ফার্স্ট ডলার ইজ ডার্টি ডলার।’ আমাদের দেশেও তা-ই। যদি তাই হয়, তাহলে এত আইন-কানুনের দরকার কী?

কালো টাকা, সাদা টাকা বিতর্কের প্রয়োজন কী? মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্টের প্রয়োজন কী? দুর্নীতি হ্রাসের জন্য এত প্রচেষ্টার দরকার কী? যেহেতু সভ্য দেশের জন্য এসব দরকার, তাই সম্পদশালী হতে হলে আইন-কানুন মানতে হবে। বৈধ পথে টাকা বানাতে হবে। এর মধ্যে হাজার কেন, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও কারও আপত্তি থাকবে না। এটি হচ্ছে না বলেই বাঙালির মধ্যে একটা ‘অ্যান্টি-মানি’ অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। ‘অ্যান্টি-মানি’ মনোভাবাপন্ন হওয়া যেমন উচিত নয়, তেমনি বৈধপথে সম্পদশালী হওয়াটাও জরুরি। ভীষণ জরুরি।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম