Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

সামাজিক অবক্ষয় ও কিশোর গ্যাং

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সামাজিক অবক্ষয় ও কিশোর গ্যাং

বাংলাদেশের সমাজ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। যদি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটি তালিকা করা সম্ভব হয় তাহলে দেখা যাবে, পুরোনো ধাঁচের সম্পর্কগুলো বদলে যাচ্ছে অথবা দুর্বল হয়ে পড়ছে। সমাজদেহে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কগুলো দানা বাঁধে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংস্থার মধ্যে। এগুলোর মধ্যে আমরা চিহ্নিত করতে পারি বিশেষ কারণে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলো।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পরিবারের মধ্যেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের প্রাথমিক ভিত্তিগুলো গড়ে ওঠে। আমাদের ছেলেবেলায় মাতা-পিতার সঙ্গে সন্তানদের যেরূপ সম্পর্ক ছিল, সেগুলো বেশ কিছুটা বদলে যায় আমরা যখন পরিবারপ্রধান হই। আমাদের নাতি-পুতিরা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়েছে, তা কার্যত ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত সম্পর্ক।

আমাদের ছোটবেলায় আমাদের পিতা-মাতা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন কী করা যাবে এবং কী করা যাবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে হবে। আমরা সেই আদেশ মান্য করেছি। আমরা যখন স্কুলে পড়ছিলাম, তখন সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের পিতা-মাতা পকেট খরচের জন্য কোনো টাকা-পয়সা দিতেন না। তারা যে কারণে আমাদের পকেট খরচের পয়সা দিতেন না, তা হলো চায়ের দোকানে বসে আমরা যাতে আড্ডা দিতে না পারি।

তাদের ধারণা ছিল চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট খেতে খেতে সমবয়সি অথবা জ্যেষ্ঠরা আমাদের কুমন্ত্রণা দিয়ে বিপথগামী করতে পারে। এক্ষেত্রে নৈতিকতার সূত্রটি ছিল-‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস/অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। শৈশবে সঙ্গী বা বন্ধু নির্বাচন নিয়ে হিসাবি হতে উৎসাহিত করতেন বাবা-মা। পরিবারের গণ্ডিতে বাবা-মা ছিলেন আমাদের প্রধান মুরব্বি। মুরব্বিদের সম্বোধন করতে গিয়ে আমরা কখনোই আপনির পরিবর্তে তুমি ব্যবহার করিনি। আমরা নিজেরা যখন সন্তানের পিতা-মাতা হলাম, তখন দেখলাম আমাদের সন্তানরা আমাদের ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছে। এভাবে বাবা-মাকে সম্বোধন করা কি বেয়াদবি? না, তা কোনোমতেই নয়। বরং আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন তুমি বলে সম্বোধন করেছে, তার মধ্যে এক ধরনের মাধুর্য ছিল। মনে হতো, এভাবে আমাদের সন্তানরা আমাদের অনেক কাছে চলে এসেছে, আমাদের ছোটবেলায় আমরা বাবা-মার অত কাছে ছিলাম না। আমরা যখন পাশ্চাত্যে গিয়েছি উচ্চতর শিক্ষার জন্য, তখন দেখেছি ছাত্ররা অধ্যাপকদের নাম ধরে সম্বোধন করত।

এই রেওয়াজের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা ক্লাস চলা অবস্থায় আদব লেহাজের রীতি অনুযায়ী কোনো কিছু ভক্ষণ করে না। অথচ বিদেশে উচ্চতর লেখাপড়া করতে গিয়ে ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। একদিন ক্লাসে লেকচার দিতে দিতে প্রফেসর বললেন, তোমরা যদি ক্ষুধার্ত বোধ করো তাহলে নিজ ব্যাগ থেকে একটা আপেল নিয়ে খেতে পারো। ওই সময় একেকটি ক্লাসের সময়-দৈর্ঘ্য ছিল বড়। অধিকাংশ ক্লাস ছিল ৯০ মিনিটের, আবার কিছু কিছু ক্লাস ছিল ১৮০ মিনিটের। এত দীর্ঘ ক্লাসে প্রফেসরের বক্তৃতা শুনতে শুনতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তাম। যাই হোক, পরবর্তীকালে ক্লাস করতে গিয়ে যদি ক্ষুধার্ত বোধ করতাম, তখন কিছু একটা খেয়ে নিতাম। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ রেওয়াজ এখনো চালু হয়নি।

পরিবারের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ অথবা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আরও অনেক রকমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবারের মধ্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের যেমন সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা বিস্তৃত হয় কর্মস্থলে, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়, রাজনীতির মাঠে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক যদি ইতিবাচক থাকে, তাহলে সামাজিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতিতে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন, মানুষে মানুষে সম্পর্কের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক সংস্থাগুলো কারও না কারও নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এখানে পরিচালকের দায়িত্ব হলো সংস্থায় যত বিরোধ তৈরি হয় সেগুলো সার্থকভাবে মিটিয়ে ফেলা। আমাদের সমাজসহ যে কোনো সমাজে দ্বন্দ্ব-বিরোধ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। পুরোনো দ্বন্দ্ব-বিরোধ নিষ্পত্তির পর নতুন ধরনের দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা যেতে পারে। এভাবে বিরোধগুলো একের পর এক মিটিয়ে ফেলতে পারলে সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি হবে।

গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশে নতুন ধরনের অপরাধী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এ কথা সত্য, শতভাগ অপরাধমুক্ত সমাজ নেই। যা বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো, সমাজে আবির্ভূত অপরাধগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একটি সমাজে নতুন ধরনের অপরাধচর্চা শুরু হলে তার বিহিত করা খুব সহজ নয়। কারণ সমাজপতিরা এগুলো কখনো দেখেননি বলে অনভিজ্ঞতার জন্য হতাশা বোধ করেন। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের সমাজে যে নতুন ধরনের অপরাধ ও অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে, সেগুলো কিশোর গ্যাং নামে পরিচিত। রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের বিনাশি কর্মকাণ্ড সামাজিক নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বয়সের দিক থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ১৭-১৮ বছর বয়সের। একেকটি গ্যাং ৬-৭ জনকে নিয়ে গড়ে ওঠে। এরা যেসব অপরাধ করে, সেগুলো অনেক ক্ষত্রেই ভিন্ন ধরনের। এদের উৎপাতে পাড়া-মহল্লায় শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে এবং তা সমাজপতিদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংশ্লেষ দেখা যায়। এর ফলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এদের ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতি করা হয়, রাজনৈতিক বিরোধীদের ভয়-ডর দেখানো হয়। সমাজকে কিশোর গ্যাংয়ের আস্ফালন ও বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন নষ্ট রাজনীতিকে প্রতিহত করা। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আরও অনেক ধরনের অপরাধকর্ম করে। ইভটিজিং এদের এক ধরনের খেলায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিকে খেলা মনে করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা রাজনীতিকে আরও বিষাক্ত করে তুলবে। বিষাক্ত রাজনীতি দিয়ে রাষ্ট্রের নাগরিকরা কোনোরকম ভালো কাজ করতে সক্ষম হবে না।

অপরাধ এবং ব্যত্যয়ী আচরণ সম্পর্কে বুঝতে হলে আমাদের সমাজবিজ্ঞানের একাধিক শাখা থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতে হবে। অপরাধ বোঝার জন্য সমাজবিজ্ঞানের কয়েকটি শাখাকে ব্যবহার করতে হবে। এগুলো হচ্ছে-সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব ও আইন। অপরাধতত্ত্ব বুঝতে হলে বুঝতে হবে দুটি পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত কিন্তু প্রয়োজনে পার্থক্যকৃত উদ্বেগের বিষয়গুলো। ঐতিহাসিকভাবে আইন শাস্ত্রের বিকাশ হয়েছে এবং এর প্রয়োগও হয়েছে, যা থেকে আমরা বুঝতে পারি কোন ধরনের কর্মকাণ্ড অপরাধমূলক অথবা ব্যত্যয়ী ধরনের। আমরা বুঝতে পারি সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রাণিবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত শক্তিগুলো মানুষের অপরাধ ও ব্যত্যয়ী আচরণের জন্য দায়ী।

সমাজবিজ্ঞানীরা যেসব গবেষণা ও অধ্যয়ন করেছেন, তা দিয়ে সর্বসাধারণ্যে প্রচলিত মিথগুলোকে ফুটো করে দিয়েছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইতিহাসভিত্তিক গবেষণা থেকে যেসব প্রক্রিয়া অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে যেমন-হত্যাকাণ্ড, চুরি, ভিক্ষাবৃত্তি, কাউকে দৈহিকভাবে হামলা করা ইত্যাদি কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা প্রথাগত বিশ্বাস অথবা নৈতিক ঐকমত্য নির্ধারণ করে কোন কাজটিকে আমরা অপরাধ বলে গণ্য করব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাকে অপরাধ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়, সেগুলোর ব্যাপারে সহমতই দেখা যায়। রাজনীতির লড়াইয়ে দেখা গেছে, একটি স্বার্থবাদী গ্রুপ অন্য একটি স্বার্থবাদী গ্রুপকে পরাজিত করে অপরাধ সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা আইনের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছে। এমনিভাবে ইংল্যান্ডে প্রথমদিকে খুনকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ইংল্যান্ডে যখন রাজশক্তি গির্জার ক্ষমতার বিরুদ্ধে এবং সামন্ততান্ত্রিক অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তখন তারা নাগরিকদের মধ্যে যেসব বিরোধ ছিল সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ অপসারণ করে স্বকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। আমরা দেখেছি বনের গাছ চুরি, শিকারের প্রাণীকে হত্যা করা এবং অভিন্ন জলাধার থেকে মাছ তুলে নেওয়া ইত্যাদিকে ফৌজদারি আইনের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ আইন যারা ভঙ্গ করবে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে বলে বিবেচনা করা হতো। ইংল্যান্ডের রাজশক্তি তখন অনুগত অভিজাতদের পুরস্কৃত করার চেষ্টা করেছিল। তাদের ব্যক্তিমালিকানায় মাছ ও পশু শিকার করার সুযোগ দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

অপরাধ এবং ব্যত্যয়ী আচরণ বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে কিছু অকাট্য ঘটনা ও তত্ত্ব রয়েছে। মনে করা হয়, সমাজে বিদ্যমান সব শ্রেণির মানুষ জীবনে কোনো না কোনো অপরাধ করে। আইনে কীভাবে অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে অবশ্যই ব্যাখ্যা দিতে হবে। অন্যদিকে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় সবাই যেসব কাজকে অপরাধ মনে করে না এবং তা স্বাভাবিক বলে মনে করে-এ বিষয়টি সর্বজনগ্রাহ্য বলে বিবেচনা করা যায়। মানুষ তার জীবনে কোনো না কোনো একটি সময়ে অপরাধ করতে পারে। অপরাধ বিজ্ঞানের একটি ধারণা থেকে জানা যায়, ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ে মানুষ কিছুটা হলেও অপরাধপ্রবণ থাকে। দেখা গেছে, এ বয়সে যারা নিয়মিত অপরাধ করেছে, তারা এ বয়সটি পেরিয়ে এসে অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকে না।

বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীরা এ রকম বয়সেই সমাজের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড লাভ করার জন্যও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে এখনো আমরা কাদের কিশোর অপরাধী বলব, তা নিয়ে আরও চিন্তা করার অবকাশ আছে। কিশোর অপরাধীদের সমাজে পুনর্বাসিত করার জন্য আমাদের কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। এসব অপরাধীকে কিশোর সংশোধনাগারে পৌঁছানো হলেই দায়িত্ব এড়ানো যায় না। যেহেতু কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে অল্পবয়সি অপরাধী তৈরি হয়েছে, সেহেতু এ বিষয়ে অবশ্যই যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ড. মাহবুব উল্লাহ্ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম