পাঠক, উপরের ‘খিচুড়ি’ বাংলার নাম দেখে ঘাবড়াবেন না। সাবেক রাজার ভাষার শব্দ একটা বসিয়েছি ইংরেজি কাগজে এই রকম একটা শিরোনাম হতো অনুমান করে, তাতে একটু নাটকীয়তা আসে। নইলে লেখাটা তো আমার ছেঁদো বাংলাতেই লিখব।
তা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, আমি অর্থনীতিবিদদের খানসামা হওয়ারও যোগ্য নই। একবার অর্থনীতিতে অনার্স পড়ার জন্য কলকাতার এক পাদরিদের কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম বটে, তবে নানা কারণে টিকতে পারিনি।
এক বছর পরে পালিয়ে শেয়ালদার এক মধ্যবিত্ত কলেজে বাংলা নিয়ে পড়েছিলাম বলে এ জীবনে একটু-আধটু করে খাবার সুযোগ পেয়েছি। তাই সংগত কারণেই অর্থনীতিকে আমি যমের মতো ভয় করি। তা সত্ত্বেও যখন আমারই দেশের, আমারই ভাষার একজন মানুষ অর্থনীতিতে ‘নোবেল’ পুরস্কার পান, তখন আমার গর্বিত হওয়ার বিষয়টি কেউ আটকাতে পারে না। এখন দেখছি, বিশ্বভারতীর মাননীয় উপাচার্য আর আরও কেউ কেউ বলছেন যে, অমর্ত্যবাবু অর্থনীতিত ‘নোবেল’ পুরস্কার পাননি।
মনে পড়ছে, তার পুরস্কার পাওয়ার বছরেও এ কথাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তখন বিশেষ পাত্তা পায়নি। আবার এ খবরটাকে তার সমাধি খুঁড়ে তুলছে কেউ কেউ, পচাগলা-দুর্গন্ধ শবের মতো, নতুন করে কাটাছেঁড়া করবে বলে। কেন, তা খুব দুর্বোধ্য নয়। তারা অমর্ত্য সেনকে পছন্দ করে না। কেন করে না, তা-ও খুব দুর্বোধ্য নয়।
যারা এ কথাটা বলছেন, তারা একটা নিচুদরের চালাকি করছেন মনে হয়। অমর্ত্যবাবু একটা পুরস্কার পেয়েছিলেন কি না, সেটা খোলসা করে বলছেন না। হ্যাঁ, একটা বিশাল পুরস্কার পেয়েছিলেন তো, সেটা এরা কেন চেপে যাচ্ছেন, বুঝি না। পুরস্কারটার সঙ্গে ‘নোবেল’ নামটা যুক্ত। কিন্তু যারা বলছেন এটা নোবেল পুরস্কার নয়, তারা ধরে নিয়েছেন বাঙালিরা গণ্ডমূর্খ, তারা কোনো খোঁজখবরই রাখে না, কাজেই ওই সব আধাসত্য যারা চাউর করছে, তাদের কথা ছাগলের মতো কপ করে খেয়ে নেবে (জানি না, এ কথা বলে আমি পশুপ্রেমিকদের আহত করলাম কি না)।
আরে, এটা তো সবাই জানে যে, ডাইনামাইট আর বহুকিছুর আবিষ্কারক, মহাধনী আলফ্রেড নোবেলের ঘোষিত মূল পুরস্কারের বিষয়গুলোর মধ্যে অর্থনীতি ছিল না। তিনি যখন মৃত্যুর এক বছর আগে সেই ১৮৯৫ সালে উইল করেন যে, মানুষের সর্বাধিক/সর্বোত্তম উপকারে (the greatest benefit of humankind) লাগে এমন কাজ যারা আগের বছরে করেছেন এ পাঁচটি বিষয়ে-পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরতত্ত্ব ও ওষুধ (ইচ্ছে করেই ‘ভেষজশাস্ত্র’ লিখলাম না), আর বিশ্বশান্তি, তার প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশন তাদের পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করবে। এই পাঁচটিই হলো প্রথাগত বা ধ্রুপদি নোবেল পুরস্কারের বিষয়।
কিন্তু আলফ্রেড নোবেল তো এখন আর বেঁচে থেকে পুরস্কার দেন না, তার মৃত্যুর পরে পুরস্কার দেয় ওই কমিটি বা ফাউন্ডেশন। নোবেল মশাই কমিটিকে এমন কথা চোখ রাঙিয়ে বা না রাঙিয়ে বলেও যাননি যে, শোনো হে, অনন্তকাল পর্যন্ত ওই পাঁচটি বিষয়েই আটকে থেকো, খবরদার বাপু তার বাইরে আর বেরিয়ো না। সেই কমিটি নতুন পুরস্কারের কথা ভাবতেই পারে। পারে এজন্য যে, আলফ্রেড নোবেলের পর পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার পরিধি অনেক বেড়ে গেছে, আর সেই সঙ্গে অর্থনীতির তখন যে গুরুত্ব ছিল, তা-ও তুলনায় অনেক পোক্ত হয়েছে। নোবেলের মূল কথাগুলো অর্থাৎ the greatest benefit of humankind আমরা যদি মনে রাখি, তাহলে অর্থনীতিতে একটি নতুন পুরস্কার প্রবর্তনের কারণটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।
তবে পুরস্কারটার কথা নোবেল কমিটি ভেবেছে, না সুইডেনের সেন্ট্রাল ব্যাংক স্বেভিক রিক্সবাংক (Svevik Riksbank) তাদের ভাবতে প্ররোচিত করেছে, তা আমরা জানি না। কারণ, তারাই নোবেল কমিটিকে এ পুরস্কার দেওয়ার জন্য যে বিপুল অর্থ দরকার তা দিয়েছে। আর নোবেল কমিটিও পুরস্কারটিকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য In Memory of Alfred Nobel কথাটা জুড়ে দিয়েছে তার সঙ্গে। আলফ্রেড নোবেল বেঁচে নেই, ফলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নোবেল কমিটির ঝুঁটি ধরে বলতে আসেননি যে, ‘এই তোরা আমার অনুমতি না নিয়ে আমার নাম জুড়ে দিলি যে বড়! তোদের আস্পর্ধা তো কম নয়! দাঁড়া তোদের যাতে নরকে গতি হয় তার ব্যবস্থা করছি!’ এ পুরস্কারটা শুরু হয় ১৯৬৮ সাল থেকে। তিরিশ বছর পরে সেটাই অমর্ত্য সেন পেয়েছেন। ফলে এটাকে একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারই বলা যেতে পারে, আর এটি নোবেল কমিটিই দেয়।
পুরস্কারটা দেয় মানব উন্নয়নের অর্থনীতি আর সামাজিক নির্বাচনের অধীনে ভারতের দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নিয়ে তার অসামান্য কাজের জন্য; যা সাম্রাজ্যবাদের একটা কুৎসিত চেহারা নতুন করে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছে। এ পুরস্কার সর্বত্রই ‘নোবেল’ পুরস্কার হিসাবেই গ্রাহ্য। গুগলে যে সূত্রই খুঁজবেন সর্বত্রই অমর্ত্যবাবু অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন বলেই উল্লেখ আছে, তাতে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস বা এ রকম একাধিক ওয়েবসাইটে এটাকে অর্থনীতিতে ‘নোবেল’ পুরস্কার বলেই বলা হয়েছে। আমাদের মতো কেউ কম্বলের লোম বাছেনি। তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষ এ নিয়ে মানুষটির নিগ্রহে নেমে পড়েছেন দেখে আমাদের ‘শিক্ষা’ সম্বন্ধে বীভৎস ধারণা তৈরি হবে, এখানে না হোক, দেশে-বিদেশে।
২.
আচ্ছা, এবার ধরি অমর্ত্য সেন সুমহান ‘নোবেল পুরস্কার পাননি, কিছু একটা হিজিবিজি পুরস্কার পেয়েছেন’। এ পুরস্কারের টাকা নিয়ে তিনি কী করেছেন, সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। ওই পুরস্কার ছাড়াও তার আর কী সম্বল আছে দেখা যাক। ছাত্র হিসাবে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজ থেকে বিএ, এমএ আর পিএইচডি করেছেন। তারপর যাদবপুর, দিল্লি স্কুল অব ইকনোমিকসে পড়িয়েছেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে আমাদের ‘শিক্ষিত’ লোকেরা যদি এলেবেলে মনে করেন, তাহলে যোগ করি, তিনি পড়িয়েছেন তার ওপরে লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, নিজের ট্রিনিটি কলেজের তিনি ‘মাস্টার’ ছিলেন, তার ওপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি লামন্টের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসরের আসন দখল করে আছেন এখনো। সেই সঙ্গে যোগ করি, তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট বহন করেন, অর্থাৎ এখনো এ দেশের নাগরিক। তার আরও পুরস্কার জুটেছে। অর্থনীতিতে অ্যাডাম স্মিথ প্রাইজ, আমেরিকার আইসেন হাওয়ার পুরস্কার এবং ভারত সরকারের ভারত রত্ন।
আর নোবেল পুরস্কারের টাকা নিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেননি, শুরু করেছেন ‘প্রতীচী ট্রাস্ট’ বলে একটি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোর শিক্ষা নিয়ে কাজ করে। তার গ্রন্থগুলো সম্বন্ধে আমার প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করার কিছু নেই। এ মানুষটিকে আক্রমণ করার জন্য কিছু লোক আঙুল তুলে খাড়া হয়েছেন দেখে অবাক হব কি? অবশ্য এর আগেও যে এমন চেষ্টা হয়নি তা নয়। তার রবীন্দ্রদীক্ষাপ্রসূত মানবিকতাবাদ, হিন্দুত্বের আগ্রাসী মনোভাব সম্বন্ধে সতর্কবাণী তাকে দিল্লির প্রভাবশালীদের প্রীতিভাজন করে তোলেনি, ফলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদ থেকে তাকে অশোভনভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমরা কতটা নিচে নামতে পারি, অমর্ত্য সেন সম্বন্ধে প্রচারিত নানা কুৎসা তার একটা প্রমাণ।
পবিত্র সরকার : খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা